দুর্গম দ্বীপে কাটিয়েছিলেন ২ টি বছর! রহস্যময় ধূমকেতুকে যেভাবে খুঁজেছিলেন এই বিজ্ঞানী

Halley's Comet: হ্যালি ঘোষণা করে দিলেন ১৭৫৮ সালে আবার দেখা মিলবে এই মহাজাগতিক বস্তুর। যদিও সেই সৌভাগ্য হ্যালির হয়নি। তবে সত্যি হয়েছিল তাঁর ভবিষ্যৎবাণী।

ভিক্ষুকদের মৃত্যুতে ধূমকেতু ওঠে না, আকাশ ঝলসে ওঠে রাজপুত্রের মৃত্যুতে।

 
-শেক্সপিয়র (জুলিয়াস সিজার)
শুধু শেক্সপিয়ারই নন মার্ক টোয়েন সহ দুনিয়াজোড়া খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা ধূমকেতু নিয়ে প্রাচীন কাল থেকেই নানা কিছু ভেবেছেন, লিখেওছেন। ধূমকেতু তো আসলে মহাজাগতিক এক বস্তু! ধুলো, বরফ আর গ্যাসের সংমিশ্রণে তৈরি। ব্যাপারটার সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ ছোটবেলায় বিজ্ঞানের বই আর ভূগোল বইয়ে। মনে আছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে এক ভূগোল ক্লাসে মাইক হাতে হঠাৎ হাজির এক সাংবাদিক। বুম নিয়ে আচমকা আমার সামনে- "বলো তো হ্যালির ধূমকেতু কী?" কী আর বলব! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশ থেকে আমারই এক সহপাঠী বলে উঠল- "৭৬ বছর অন্তর আকাশে যে ধূমায়িত আলোকপুঞ্জ দেখা যায়, তাকেই হ্যালির ধূমকেতু বলে।" সেই থেকে মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, ৭৬ বছর পর পর কেন? এ কি পর্যায়বৃত্ত ধূমকেতু? অন্য আর পাঁচটা ধূমকেতু থেকে এ বেচারিকে নিয়ে এত কেন উন্মাদনা? এই ধূমকেতুর সঙ্গে বিশ্ববাসীকে পরিচিত করিয়েছিলেন যিনি, সেই এডমন্ড হ্যালি জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানের এক মজার চরিত্র। এই হ্যালিই আবার প্রবাদপ্রতিম নিউটনের অন্তরঙ্গ বন্ধুও বটে।

শেষবার হ্যালির ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল ১৯৮৬ সালে। এই ধূমকেতু মূলত সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা সৌরজগতের একটি ছোট্ট অংশ। ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের কাছে এসে পড়লে তার একপাশে লম্বা আলোর রেখার মতো দেখা যায়,যেটাকে লোকজন ধূমকেতুর লেজ নামে চেনে। সূর্যের যত কাছে অবস্থিত হবে, ততই এই লেজ তৈরির সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কী দিয়ে তৈরি এই লেজ? সোজা উত্তর -জল, কার্বন ডাই অক্সাইড, সঙ্গে কিছু যৌগ বাষ্পীভূত হয়ে এর জন্ম। আসলে ধূমকেতু হলো হিমায়িত বরফ, গ্যাস ও ধূলিকণার মিশ্রণ। সূর্যের কাছে এসে পড়লে, সূর্যের তাপে এর বরফ বাষ্পীভূত হতে শুরু করে। ফলত বরফের ফাঁকে আটকে থাকা ধুলোর কণিকাগুলো মুক্ত হয়। সূর্যালোক ও সৌরঝড়ের আয়নিত কণাগুলি, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই ধুলোকণাগুলিকে ঠেলে পিছনে ফেলে দেয়। তখন এদেরকে লেজের মতো মনে হয়। গঠনগত কারণে এই লেজ দু' প্রকার হয়, ধুলিকণার লেজ ও গ্যাসিয় আয়নিত কণার লেজ। এই দুই ধরনের লেজই কয়েক লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদিকে এর কেন্দ্র আকারে অনেক ছোট- কয়েক হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।

বিজ্ঞানীদের দেওয়া হিসেব অনুসারে মহাকাশে বিভিন্ন ধরনের ধূমকেতুর সংখ্যা কয়েক হাজার (প্রায় ৩ হাজার ৭৪৩টি)। এদের মধ্যেই যারা ক্ষণস্থায়ী, তাদের ঘূর্ণনকাল ২০০ বছরের নীচে, আর দীর্ঘস্থায়ীদের তার চেয়েও বেশি। যদিও অন্য ধূমকেতুদের চেয়ে হ্যালির ধূমকেতুই বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত। এই ধূমকেতুর কক্ষপথের হিসাব করেন স্যার এডমন্ড হ্যালি। তাঁর নাম অনুসারেই নামকরণ করা হয় এই বহুল আলোচিত মহাজাগতিক বস্তুটির।

আরও পড়ুন- চাঁদে যেতে গিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলেন ওঁরা

সপ্তদশ শতকে, ১৬৫৬ সালে হ্যালির জন্ম। তাঁর জন্মের ৪ বছর পরেই রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটেন তখন পৃথিবীর দিকপালদের মিলনভূমি। কিশোর বয়সে রয়্যাল সোসাইটির এক সদস্য ফ্লামস্টিডের সঙ্গে পরিচয় হয় হ্যালির। সেই থেকেই তাঁর পছন্দের বিষয় জোতির্বিদ্যা। ঘটনাক্রমে ফ্লামস্টিড সেসময় টেলিস্কোপে উত্তর আকাশে বিভিন্ন তারার তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। হ্যালিও সেই কাজে যুক্ত হয়ে যান। কিন্তু তিনি বাছলেন দক্ষিণ আকাশ। এই কাজে এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করেই জাহাজে চেপে চলে আসেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে- নিকটবর্তী ভূখণ্ড রিও ডি জেনিরো থেকে প্রায় আড়াই হাজার মাইল পূর্বে। সেই শুরু। এইরকম এক দুর্গম দ্বীপে প্রায় দু' বছর কাজ করেন হ্যালি। তাঁর ঝুলিতে তখন ৩৪১ টি নক্ষত্রের খুঁটিনাটি। সেই সময়ে বিজ্ঞানে এ ছিল এক বিরাট কাজ। আজকের গবেষকরা কাজ করার সময় যেমন তথ্য-তালিকা তালাশ করেন হ্যালি সেই পথের গোড়ার দিকের যাত্রী। দক্ষিণ আকাশের তারাগুলি নিয়ে কেউ এমন পূর্ণাঙ্গ তথ্য তালিকা তৈরি করেনি আগে। এই অসামান্য কাজের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করে। এই সময় রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন ২২ বছরের তরুণ হ্যালি।

এর পর হ্যালি ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। ভ্রমণকালে বহু বিখ্যাত জ্যোতির্বিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। বেশ কয়েক বছর পর, ১৬৮৪ সালে তিনি কেমব্রিজে যান। সেখানে আলাপ হয় নিউটনের সঙ্গে। সেই সময় অক্সফোর্ডে রবার্ট হুক ক্রিস্টোফার রেন সহ আরও কিছু দিকপালেরা খোঁজার চেষ্টা করছিলেন গ্রহদের গতিবিধির রহস্য। তাঁদের কষা অঙ্ক অনেকটা জটিল ঠেকল দূরদর্শী জ্যোতির্বিদ হ্যালির কাছে। অপরদিকে কেমব্রিজে নিউটন স্বতন্ত্রভাবে মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে অনেক গণনা করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই সময়ে নিউটন ও হুকের ভেতরে এক রেষারেষি ছিলো। অন্য একসময় এই দুই মহান বিজ্ঞানীর দ্বৈরথ নিয়ে চৰ্চা করা যাবে। সবাই সেসময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন গ্রহগুলি সূর্যের চারপাশে কেন একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে? এ ওর রাস্তায় ঢুকে পড়ছে না, এমনকী দিক ভুল করে সূর্যের দিকেও ধেয়েও যাচ্ছে না। সবাই ভাবছেন আমাকে সর্বাগ্রে এর একটা যুতসই ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেই হবে। এমতাবস্থায় হ্যালি ও হুক যৌথভাবে এক বলের প্রস্তাবনা করেন, যেটি কিনা গ্রহগুলিকে সূর্যের দিকে টেনে রাখে। সেই বলের প্রকৃতি কেমন হবে? সে নিয়ে এক সম্যক ধারণাও তাঁরা দেন। এই বল কার্যকরী বস্তু দু'টির মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক। সঠিক রাস্তাতেই এগোচ্ছিলেন তাঁরা, কিন্তু এর যথাযথ ধারণা দিতে পারেননি- যা গ্রহদের গতিবিধিকে পূর্ণাঙ্গরূপে চিত্রায়িত করে। এহেন অবস্থায়, হ্যালি নিউটনের শরণাপন্ন হন এবং তাঁদের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরেন। হ্যালিদের ধারণা নিউটনের কাছে এসে যেন পালে হাওয়া পেল, যার ফলস্বরূপ জন্ম নিল প্রিন্সিপিয়া- বিজ্ঞানের আকর গ্রন্থ! হুকের বিরোধিতার পরও হ্যালি নিজের খরচায় প্রিন্সিপিয়া ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এতেই ক্ষান্ত হননি হ্যালি, বইটির আগাগোড়া প্রুফ দেখেছেন, এমনকী বন্ধুর বইয়ের জন্য ল্যাটিন ভাষায় একপ্রস্থ ভূমিকাও লিখে দেন। প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের পর নিউটন রীতিমতো তারকা, যদিও হ্যালির প্রচেষ্টা ছাড়া এই কালজয়ী গ্রন্থ প্রকাশ পেত কিনা সন্দেহ!

আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া

যদিও বন্ধুকে কখনও ভোলেননি নিউটন। ছাত্রজীবনের গুরু ফ্লামস্টিডের তৈরি জোয়ার ভাটার তালিকায় ভুল ধরেন তিনি। পরিণামে স্থায়ী চাকরি জুটছিল না। এদিকে রয়্যাল সোসাইটির আর্থিক অবস্থা তখন সঙ্গিন। কর্মসচিব হিসেবে কাজ করলেও কোনও বেতন পাচ্ছিলেন না। নিউটনের খ্যাতির পারদ তখন ঊর্ধ্বমুখী। নিজের প্রভাব খাটিয়ে তিনি রাজকীয় মোহর গলানোর অফিসে হ্যালির একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন।

এরপর হ্যালি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে লাগলেন- ভূ পদার্থ, বিশুদ্ধ গণিত, আবহাওয়া, এমনকী মানুষ কত বয়সে মারা যাচ্ছেন সে বিষয়েও কাজ করেন তিনি। যেটা পরবর্তীকালে আজকের জীবনবিমায় প্রভূত কাজে লাগে। এর মধ্যে আঠারো শতকের গোড়ার দিকে হ্যালি যোগ দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াতেন জ্যামিতি। ১৭০৫ সালে বেরোয় তাঁর বিখ্যাত বই 'আ সিনোপসিস ইন আস্ট্রোনমি অফ কমেটস'। ১৩৩৭ সাল থেকে ১৬৯৮-এর মধ্যে দেখতে পাওয়া দু' ডজন ধূমকেতুর কক্ষপথের বিবরণ আছে বইটিতে। পাণ্ডুলিপি তৈরির সময় তিনটি ধূমকেতু যা কিনা ১৫৩১, ১৬০৭ ও ১৬৮২ সালে দেখা গিয়েছিল- সেগুলোর মধ্যে কোথাও একটা মিল অনুভব করেন তিনি। এদের গতিপথ অনেকটা একই ধরনের, আবার উদয় হচ্ছে ৭৬ বছর অন্তর! তিনি ঘোষণা করে দিলেন ১৭৫৮ সালে আবার দেখা মিলবে এই মহাজাগতিক বস্তুর। যদিও সেই সৌভাগ্য হ্যালির হয়নি। তবে সত্যি হয়েছিল তাঁর ভবিষ্যৎবাণী। তবে ১৭৫৮ নয়, তার পরের বছর দেখা মিলেছিল সেই বিশেষ লেজওয়ালা ধূমকেতুর। একেবারে ৭৬ বছর অন্তর নয়, মাঝে মধ্যে সামান্য আগে পরেও হয় আর কী। তাঁরই নামানুসারে নাম হয় হ্যালির ধূমকেতু। বিজ্ঞানীদের হিসেব মতো আবার ২০৬১ সালের ২৮ জুলাই দেখা মিলবে এই মহাজাগতিক রতনের। এখনো চার যুগ অপেক্ষায় থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে!

More Articles