মহাবিশ্ব মোটা হচ্ছে! এর বয়স কত? যেভাবে মেপেছিলেন এই বিজ্ঞানী
Hubble's law: হলভর্তি দর্শকের সামনে হাবল প্রমাণ করেন, আমাদের চেনা শাশ্বত মহাবিশ্ব আর আগের মতো চিরন্তন নয়, এ সতত পরিবর্তনশীল!
রাত্রে পরিষ্কার নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনওদিন অবাক হয়নি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নীল শামিয়ানায় হরেকরকম তারার ঝিকিমিকি। কেবল রাতেই নয়, দিনের বেলায়তেও আকাশে থাকে ওরা, সূর্যের আলোতে ঢাকা পড়ে যায় মাত্র। সেই কবেই তো রবি লিকেহ গেছেন, "রাতের সব তারাই আছে, দিনের আলোর গভীরে"। সূর্য কিন্ত ওই মিটমিট করা তারাদের থেকে আকারে অনেক ছোট, যেহেতু আমাদের অনেক কাছে থাকে, সেজন্য গোল থালার মতো বড় মনে হয়।
ছোটবেলায় মনে হতো তারারা কত দূরে! বিমানে করে ওদের কাছে যাওয়া যাবে? যদি যায়, কতদিন সময় লাগবে? পূর্ণিমার দিনগুলোতে আবার চাঁদকে বেশিই আপন লাগে যেন! তার আর একটা কারণ অবশ্য আছে। বড়দের মুখে চাঁদের গল্প শুনেই তো বেড়ে ওঠা! সময় সারণী বেয়ে এক সময় চাঁদে পৌঁছল মানুষ, আমরাও সেই চন্দ্র বিজয়ে শামিল হয়েছি গতবছরে। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের পাঠানো মহাকাশযান সফলভাবে অবতরণ করেছে চাঁদে। বড় হওয়ার পাশাপাশি জেনেছি তারারা আমাদের থেকে অনেক দূরে, কয়েক লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ (এক বছরে আলো যত দূরত্ব অতিক্রম করে) দূরে!
ছোটবেলায় খেয়ালবশত বেশ কিছুক্ষণ তারা গোনার পর হাঁপিয়ে উঠতাম! এরা সংখ্যায় কত বেশি! গুনে শেষ করা দায়। কত হবে? কয়েক হাজার? বড় হয়ে জানলাম, সংখ্যা অগণিত। শুধু দৃশ্যমান নক্ষত্র নয়, সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, যাদেরকে আমরা রাতের আকাশে দেখতে পাই, তাদের চেয়ে যাদের দেখতে পাওয়া যায় না, তাদের সংখ্যা অনেক বেশি।
আরও পড়ুন- স্টারলাইন-দুর্বিপাকে মহাকাশেই আটকে সুনীতারা! আদৌ ফেরা হবে ৯ নভোশ্চরের?
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এমন অনেক তারা আছে, যাদেরকে আমরা এখনও দেখতে পাইনি। কবে পাব তাও জানা নেই। কীভাবে তারাদের দেখি আমরা? ওদের থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছনোর পর। কিছু কিছু তারা তো এতই দূরে আছে যে, ওদের থেকে পৃথিবীতে এখনও আলো এসে পৌঁছতেই পারেনি। বোঝো কাণ্ড! আলো কিন্ত অনেক জোরে ছোটে, শূন্যস্থানে এক বছরে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল যেতে পারে। তাহলে কত দূরে ওইসব নক্ষত্রেরা? এদের মাঝে অনেকগুলো নক্ষত্র হয়তো মারাও গেছে এতদিনে, তারপরেও তাদের ঝিকিমিকি হাসি ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে।
এই তারাগুলো মহাকাশে আবার একা থাকে না। নিজেরা দল বেঁধে একটা সভা-সমিতি গড়ে থাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যাদের নাম দিয়েছেন 'তারার দল' বা 'ক্লাস্টার'। আর এইরকম অনেকগুলো তারার দল মিলেমিশে যে অঞ্চলে থাকে, তাকে আমরা বলি 'গ্যালাক্সি' বা 'ছায়াপথ'। এদের আবার বেশ গালভারী নাম আছে, যেমন 'আকাশ গঙ্গা', 'অ্যান্ড্রমিডা গ্যালাক্সি', প্রভৃতি। আমাদের সূর্য যেমন আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সদস্য।
তারাকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে নির্দিষ্ট কক্ষপথে। কোনও কোনও গ্রহগুলিকে কেন্দ্র করে আবার আর একটা বস্তু ঘুরপাক খাচ্ছে, যাকে বলে উপগ্রহ। যেমন, আমাদের চাঁদ। বৃহস্পতির, শনির আবার অনেকগুলো করে চাঁদ আছে। ছায়াপথে এরকম নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ আরও কত কীই যে থাকে! এরকম অজস্র ছায়াপথ নিয়েই আমাদের এই বিরাট মহাবিশ্ব। বিজ্ঞানীদের অনুমান, দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বে ছায়াপথের সংখ্যা কমবেশি দশ হাজার কোটি! অর্থাৎ একের পিঠে এগারোটা শূন্য। ধরা যাক, কোনও মানমন্দিরে (যেখান থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়) সেকেন্ডে যদি একটা করে ছায়াপথও গণনা করা যায়, তাও সময় লাগবে প্রায় ৭৬ হাজার বছর!
বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রতিমুহূর্তে এই মহাবিশ্বের আয়তন বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। ফলে এর মধ্যে ফাঁকা স্থান ক্রমশ বাড়ছে। একটু আগে যে বিভিন্ন ছায়াপথের কথা বলছিলাম, তাদের ভিতরে দূরত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সুদীর্ঘ ন'বছর গবেষণার পর ১৯২৯ সালে, হাবল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, "ছায়াপথগুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যার দূরত্ব যত বেশি, তার পরস্পর থেকে দূরে যাওয়ার বেগও তত বেশি।" এটিই হাবলসের সূত্র নামে পরিচিত। একটা সোজা পরীক্ষার দ্বারা এর ব্যখ্যা করা যায়। একটা বেলুন নেওয়া যাক। তার উপরে লাল মার্কার পেন দিয়ে কাছাকাছি দুটো বিন্দু আঁকতে হবে। আর একটা নীল মার্কার দিয়ে একটু দূরে দু'টি বিন্দু আঁকতে হবে। এবারে ফুঁ দিয়ে সেই বেলুন ফোলালে দেখতে পাওয়া যাবে নীল বিন্দু দু'টির মধ্যে দুরত্ব বাড়ছে দ্রুত। তার মানে এই মহাবিশ্বে দূরে দূরে থাকা গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে তাদের পেটের ভিতরে থাকা তারাগুলোও দূরে সরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মহীনের ঘোড়াগুলির সেই বিখ্যাত গান, "তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে... তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে," এই প্রসঙ্গে মনে তো আসেই তাই।
এই যে মহাবিশ্ব সময়ের সঙ্গে বেড়ে চলেছে, তো এর গতি কত? মানে সেকেন্ডে কতটা করে ফুলে ফেঁপে মোটা হচ্ছে মহাবিশ্বের পেট? আর আদিকাল থেকে যে মহাবিশ্বের কথা শুনে আসছে মানুষ, তার বয়স কত? এর কি কোনও সীমা আছে? এই সমস্ত অদ্ভুত প্রশ্ন আলোচনা হচ্ছিল বিজ্ঞানের এক সেমিনারে, আজ থেকে ৯৫ বছর আগে। বক্তা, বিশিষ্ট মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল। অনেকদিন ধরেই তিনি মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তখন সদ্য সদ্য মেপেছেন মহাবিশ্বের বয়স, এর সম্প্রসারণের গতি, প্রভৃতি। হলভর্তি দর্শকের সামনে হাবল প্রমাণ করেন, আমাদের চেনা শাশ্বত মহাবিশ্ব আর আগের মতো চিরন্তন নয়, এ সতত পরিবর্তনশীল! উপস্থিত দর্শকদের মাঝে হইহই রব পড়ে যায়। এই তরুণ বিজ্ঞানীকে অভিবাদন জানাতে সকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন।
মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ আবিষ্কার অনেকদিন হয়ে গেছে (প্রায় ১৪ বছর) ততদিনে। এদিকে, ১৯২২ সালে আর এক মহারথী, আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান দেখান, আইনস্টাইনের সমীকরণকে সমাধান করার সময় আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। সে সময় অধিকাংশ দিকপালরা একথা মানতে চাননি, এমনকী আইনস্টাইন নিজেও সেটা স্বীকার করতে নারাজ ছিলেন। আমাদের চিরচারিত এই মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল হয়ে যাবে? এই ভয় থেকেই তাঁর সমীকরণে একটা নতুন ধ্রুবক জুড়ে দিলেন, আইনস্টাইন যার নাম মহাজাগতিক ধ্রুবক। যদিও, পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
কী করে হাবল মহাবিশ্বের বয়স মাপলেন? ধরুন, আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। এমন সময় দেখলেন, একটা অ্যাম্বুলেন্স লালবাতি জ্বালিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্সটি যখন আপনার দিকে আসছিল তখন তার হুইসেলের আওয়াজ, আর যখন বেরিয়ে গেল, তখনকার হুইসেলের আওয়াজ কি কানে একইরকম ঠেকে? একটু হেরফের হয় না? এই ঘটনাকেই পদার্থবিদ্যার ভাষায় বলে 'ডপলার এফেক্ট'। এ ঘটনা শুধু শব্দ তরঙ্গ নয়, আলোর ক্ষেত্রেও দেখতে পাওয়া যায়।
ধরুন, একটি আলোক উৎস আপনার দিকে ছুটে আসছে , তখন আপনি তাকে তার আসল রঙের থেকে কিছুটা নীলাভ দেখতে পাবেন, বিজ্ঞানীরা যার নাম দেন 'নীল সরণ' বা Blue shift, আবার আলোক উৎস যদি আপনার থেকে দূরে চলে যেতে থাকে, তবে তাকে লালচে দেখবেন, যাকে পদার্থবিজ্ঞানীরা ' লাল সরণ' বা Red shift নামে চেনেন। আপনার আর অলোক উৎসের ভেতরে আপেক্ষিক বেগের হেরফের যত বেশি হবে ততই এই লাল-নীল খেলা দেখতে পাবেন। এই মজাদার রঙের পার্থক্য থেকেই গতির হিসেব করা যায়। আর হাবল এই কাজটাই করেছিলেন আমেরিকার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে। তিনি অনেক বছর ধরে টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। পর্যবেক্ষণের সময়, প্রায়শই খেয়াল করেন, দূরের ছায়াপথগুলো কাছের ছায়াপথের থেকে বেশি লালচে দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যে ছায়াপথ যত দূরে, সে তত লালচে!
আরও পড়ুন- মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?
আমাদের থেকে যে ছায়াপথ যত দূরে, সে তত দ্রুত পালাচ্ছে! অদ্ভুত! আর এই ব্যাপারটিকে হাবল একটা নিয়ম আকারে প্রকাশ করলেন, যা হাবলের সূত্র নামে পরিচিত। অনেক অঙ্ক কষে হাবল একটা সোজা সূত্র দেন, V= Hd, যেখানে d হচ্ছে দু'টি ছায়াপথের ভিতরকার দূরত্ব, V হলো তাদের দূরে চলে যাওয়ার বেগ এবং H একটি ধ্রুবক, হাবলের সম্মানে তার নাম রাখা হয়, হাবল ধ্রুবক। হাবলের সমীকরণকে লেখচিত্রে আঁকলে একটা সরলরেখা পাওয়া যায়। সেখান থেকে সহজেই এই সরলরেখার নতি H, বের করা যায়। হাবল ধ্রুবক। এই H-ই হচ্ছে মহাবিশ্বের বয়স বের করার প্রধান চাবিকাঠি। হাবল এখান থেকেই বার করেছিলেন মহাবিশ্বের বয়স।
এই মহাবিশ্ব শুরু হয়েছে এক বিস্ফোরণ বা বিগ-ব্যাংয়ের মধ্য দিয়ে। সৃষ্টির শুরুতে সব ছায়াপথ একসঙ্গে মিলে মিশেই ছিল। বিস্ফোরণের পর এরা একে অপর থেকে ছিটকে দূরে চলে যায়। মহাবিশ্ব যেহেতু সম্প্রসারণশীল, ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সৃষ্টির পর থেকে, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে ধরা যাক, আজ হয়েছে d, আবার মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের বেগ যদি v হয়, এবং T যদি মহাবিশ্বের বয়স হয়, তবে T=d/v, ওদিকে হাবলের সমীকরণের সঙ্গে তুলনা করলে পাওয়া যায়, মহাবিশ্বের বয়স, T=1/H. বিজ্ঞানীরা অনেক হিসেব করে দেখেছেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের পুরানো। হাবলের শেখানো পদ্ধতি ছাড়াও অন্যভাবেও বার করা যায় মহাবিশ্বের বয়স। সে গল্প আর একদিন হবে।