গোদি মিডিয়ার সুধীর ভাই আর তাঁর সাংবাদিকতা

Journalist Sudhir Chaudhury: বিজেপি ঘনিষ্ঠ মিডিয়ার অত্যন্ত পরিচিত মুখ এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কর্ণাটক পুলিশ।

তিনি সংবাদ তুলে ধরেন। যেখানে বসে তুলে ধরেন, নিন্দুকেরা তার নাম দিয়েছেন গোদি। গোদি, মানে যার বাংলা করলে দাঁড়ায় কোল, সেই কোলটি কার? ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। বিজেপি ঘনিষ্ঠ মিডিয়ার অত্যন্ত পরিচিত মুখ এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কর্ণাটক পুলিশ। আজতক চ্যানেলের উপদেষ্টা সম্পাদক সুধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তপশিলি জাতি এবং উপজাতিদের জন্য বাণিজ্যিক যানবাহন ভর্তুকি প্রকল্প সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঘৃণা প্রচারের জন্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় মামলা করা হয়েছে। তবে এবারই তো প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক বিতর্ক খুব গুছিয়েই সামনে এনেছেন তিনি। নির্দিষ্ট প্রোপাগান্ডাকে সমর্থন ও প্রচারের লক্ষ্যে এমন যে হয়েই থাকে এদেশে, তা নতুন করে বলার নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকতার নামে যেভাবে চ্যানেলগুলি দলদাস হচ্ছে, যেভাবে সাংবাদিকতার নামে বিদ্বেষকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়, মগজে মগজে তা নিয়ে পাল্টা স্বর কোথায়? পাল্টা স্বর এলেই গৌরী লঙ্কেশের মতোই ভবিতব্য! গোদি মিডিয়ার বিশ্বস্ত সাংবাদিক সুধীর চৌধুরীর এমন কী কী কীর্তি রয়েছে দেখা যাক।

অন্যান্য কীর্তির কথা বলার আগে নতুন এই মামলাটির কথাই জানা যাক। কর্ণাটক সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিগমের একজন কর্মকর্তার দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে এই মামলা করা হয়েছে। মামলাতে আজতকের প্রধান সম্পাদক এবং চ্যানেলের সংগঠকের নামও রয়েছে। সুধীর চৌধুরী একটি শো-এ দাবি করেন, কর্ণাটক সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিগমের স্বাবলম্বী সারথি প্রকল্পটি হিন্দুদের দেওয়া হয় না। স্বাবলম্বী সারথি প্রকল্পে বাণিজ্যিক যানবাহন কেনার জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়। বার্ষিক ৪.৫ লক্ষ টাকার কম আয় এমন পরিবারসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ৫০% বা ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়। কর্ণাটক সরকার মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ এবং পার্সিদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।

সুধীর বলছেন, কংগ্রেস সরকার বলেছিল, এই প্রকল্পটি তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতিদেরও দেওয়া হবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই ধরনের কোনও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। আসল সত্য হচ্ছে, কর্ণাটকের তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতির মানুষরাও এই প্রকল্পের অধীনে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার জন্য ভর্তুকি পেতে পারেন। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ঐরাবত প্রকল্পের মাধ্যমে এই ধরনের সুবিধাগুলি পেতে পারেন। সুধীর দাবি করছেন, এই প্রকল্পটি রাজ্যের দরিদ্র হিন্দুদের প্রতি অবিচার করেছে। কর্ণাটকের মন্ত্রী প্রিয়াঙ্ক খাড়্গে বলছেন, সুধীর উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছেন। তাই ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৫০৫ (জনসাধারণের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বিবৃতি) এবং ১৫৩এ (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার)-এর অধীনে সুধীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- সাংবাদিক কি সাহিত্যিক হতে পারে : সুমন চট্টোপাধ্যায়

ভুয়ো খবর, ভুল তথ্য সাংবাদিকতার সমূহ সর্বনাশ করেছে গত এক দশকে। বিশেষ করে গেরুয়া বাহিনী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর আইটিসেলের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত, সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নিজেদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য যা খুশি তথ্য, ভিত্তিহীন তথ্য মুহুর্মুহু ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের চোখের সামনে। বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে কানের সামনে। সংবাদমাধ্যমের হয়ে এই কাজটি যারা করেন, সুধীর চৌধুরী তাঁদেরই একজন। জি নিউজে কাজ করার সময় এমন একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে তার নামে। কেরলের কোঝিকোড় কাসাবা থানা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননা করার অভিযোগ আনে সুধীরের বিরুদ্ধে।

১১ মার্চ নিজের শোয়ে সুধীর চৌধুরী একটি পরিসংখ্যানচিত্র ব্যবহার করেন। তাতে দেখান মুসলিমরা ভারতে হিন্দুদের উপর একাধিক 'জিহাদ' চালাচ্ছে, যেমন পপুলেশন জিহাদ, লাভ জিহাদ, ল্যান্ড জিহাদ, অর্থনৈতিক জিহাদ, ইতিহাস জিহাদ এবং মিডিয়া জিহাদ। দেখা যায় এই চিত্রটি আসলে বয়কট হালাল ইন্ডিয়া নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে কপি-পেস্ট করা।

 

এই জি নিউজই বলেছিল সমগ্র উত্তর-পূর্বে ১১ জন করোনভাইরাস রোগী রয়েছেন যারা তাবলিঘি জামাতে অংশ নিয়েছিলেন এবং করোনা ছড়িয়েছেন। সেই সময়ে দেশে মাত্র ১ টি কোভিড পজিটিভ কেস ছিল। অরুণাচল প্রদেশের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগ প্রমাণ করে, এমন কিছুই ঘটেনি। জি নিউজই উত্তর প্রদেশের একটি খবর প্রকাশ করে যাতে বলা হয় করোনভাইরাস-পজিটিভ তাবলিঘি জামাত সদস্যদের পাথর ছুঁড়ে মারা হয়েছে। প্রতিবারই মুসলিমদের নিশানা করে ভুয়ো তথ্য গিলতে বাধ্য করেছেন সুধীর। সুধীররা জানেন ভারতের ৯০% মানুষই তথ্য যাচাই করবেন না। যা বলা হবে তাই বিশ্বাস করবেন। বিদ্বেষে আস্থা রাখবেন।

২০১৭ সালে, জি নিউজ বলে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির কর্মকর্তারা আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের সম্পত্তির খোঁজে অভিযান চালিয়েছে। দেখা যায় এমন কিস্যুই ঘটেনি। বিজেপির কোন এক সদস্য এ নিয়ে কীসব টুইট করেছিলেন, তার ভিত্তিতেই এমন বড় খবর করে দেয় চ্যানেলটি!

২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন সংযুক্ত আরব আমিরশাহি যান, তখন জি নিউজ বলে, ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান জয় সিয়া রাম বলে নাকি তার বক্তৃতা শুরু করেন। পরে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওর ব্যক্তিটি আসলে সুলতান সৌদ আল কাসেমি, আরব আমিরশাহির একজন লেখক ও ভাষ্যকার। 'জয় শ্রীরাম' প্রচারের জন্য মরিয়া সুধীর ভাইয়ের একমাত্র লক্ষ্য মুসলিম মুখে শ্রীরাম বলানো!

সুধীর চৌধুরী তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে মার্টিন লংম্যানের একটি বক্তৃতা চুরি করার অভিযোগও আনেন। দেখা যায়, মার্টিন লংম্যান নিজেই একটি টুইট করে বিষয়টা নস্যাৎ করে দিয়েছেন। লংম্যান লেখেন,

“I’m internet famous in India because a politician is being falsely accused of plagiarizing me. It’s kind of funny, but right-wing assholes seem to be similar in every country.”

আরও পড়ুন- বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার

একটি গণতান্ত্রিক দেশের সাংবাদিক সুধীর চৌধুরী বলেছিলেন, দেশে যখন খুব বেশি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র থাকে তখনই দেশের মানুষ সেই আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে যা দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলনকে এভাবেই দেখেছিলেন সুধীর।

কৃষক-শ্রমিক তো দূর, স্বয়ং শাহজাহানকেও ছাড়েননি সুধীর। বলেচছিলেন, মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণকারী শ্রমিকদের হাত কেটে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের সত্য বলে, শাহজাহান তাজমহল নির্মাণকারী শ্রমিকদের হাত কাটেননি বরং আজীবন বেতন দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন যাতে আর অন্য কাজ না করতে হয়।

সুধীর চৌধুরীর সাধারণ জ্ঞানও অসাধারণ। সুধীর বলেছিলেন, কানাডা বিশ্বের বৃহত্তম দেশ। বাস্তব হচ্ছে, রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দেশ যার আয়তন প্রায় ১৭,১২৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার। কানাডার আয়তন প্রায় ৯,৯৮৪,৬৭০ বর্গ কিলোমিটার। সুধীর বলেছিলেন, ২০০০ এর প্রতিটি নোটে ন্যানো জিপিএস চিপ রয়েছে। যেকোনও জায়গা থেকে এই নোটকে নজরে রাখা যাবে। আরবিআই বলছে ২,০০০-এর নোটে এসব কিচ্ছু নেই। সুধীর চৌধুরী একটি ভিডিও শেয়ার করে বলেছিলেন, জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছেন। আসলে কিন্তু ওই পড়ুয়ারা ভারতীয় আদালত জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছিলেন।

এত এতবার ভুল প্রমাণিত হয়েও কীভাবে কাজ চালিয়ে যান সুধীররা? জি মিডিয়ার ভিডিও বিভাগের প্রাক্তন প্রধান নাসির আজমি এই একতরফা সাংবাদিকতা এবং সংগঠনের অবস্থান আর সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সম্পর্কে অনেক সত্য প্রকাশ করেছিলেন পরে। নাসির চ্যানেল থেকে পদত্যাগও করেন। তবে একটি বিষয় তিনি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছিলেন, ভারতীয় সাংবাদিকতার কালো দিন শুরু হয়ে গিয়েছে। এই কালো ব্ল্যাকহোলের চেয়েও আগ্রাসী। গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সততা, নিরপেক্ষতা গিলে খাওয়ার মতো আগ্রাসী।

More Articles