'জ্বলে গেল', বোমার আঘাতে আর্তনাদ করতে করতে ছোটা মেয়েটি আজ বিশ্বশান্তির দূত

৬ জুন 'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর একটি প্রতিবেদনে কিম লেখেন, “বছরপঞ্চাশেক কেটে গিয়েছে, আমি আর সেই ‘নাপলাম গার্ল’ নই।" পাঁচ দশক আগে তোলা ছবিটির প্রতি তাঁর মনোভাব বেশ খানিকটা জটিল।

ইউক্রেনে একের পর এক ঘটে চলা যুদ্ধহিংসার ঘটনা নিয়ে চিন্তিত গোটা বিশ্ব। ফেব্রুয়ারির আক্রমণের পর ক্রমে পিছু হটতে বাধ্য হয় রাশিয়া। কিন্তু তারপরেও নানারকম খবর উঠে আসছে। এই পরিস্থিতির মাঝেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি বিখ্যাত ছবি তার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল। যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জীবনে কী বীভৎস প্রভাব ফেলে, সেই কথাই যেন আরও একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ছবিটি। কিন্তু রাষ্ট্রের যুদ্ধের খিদে অত সহজে কি মরে? ইতিহাস থেকে এইসব বিষয়ে তারা শিক্ষা নেয় না কোনওদিনই।

১৯৭২ সালের ৮ জুন, নিক উৎ নামে এক আমেরিকান-ভিয়েতনামিজ ফটোগ্রাফার সমস্ত যুদ্ধের চিত্র যেন তুলে ধরলেন তাঁর একটি মাত্র ফোটোগ্রাফের মধ্যে দিয়ে। আকাশ ধোঁয়ায় ঢাকা, উন্মুক্ত রাস্তার দুই পাশে হাতে রাইফেল সৈন্যেরা হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে একঝাঁক খুদে ছেলেমেয়ে। তারই মধ্যে একটি মেয়ে একেবারে নগ্ন। নাপালাম বম্বিং-এর হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের শিশুরা দৌড়ে পালিয়ে আসছে গ্রামের বাইরে। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছবি ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। 'যুদ্ধের আতঙ্ক’ শিরোনামের এই ছবিটি পুলিৎজার জেতে। ছবির নগ্ন মেয়েটি দ্রুত গোটা পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে যায় ‘নাপালাম গার্ল’ নামে। সময়ের ফেরে আজ সেই খুদে শিশু এক বয়স্ক মহিলা, থাকেন কানাডার ওন্টারিওতে। নাম তাঁর কিম ফুকফানথি। গোটা বিশ্বে শান্তি ছড়ানোর কাজই বেছে নিয়েছেন কিম। ৬ জুন 'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর একটি প্রতিবেদনে কিম লেখেন, “বছরপঞ্চাশেক কেটে গিয়েছে, আমি আর সেই ‘নাপলাম গার্ল’ নই।" পাঁচ দশক আগে তোলা ছবিটির প্রতি তাঁর মনোভাব বেশ খানিকটা জটিল।

Vietnam napalam girl

নিক উতের তোলা সেই ছবি

 

'নং কুয়া! নং কুয়া!' (জ্বলে গেল! জ্বলে গেল) 
১৯৭২ এর ৭ জুন। নিক উৎ তখন কাজ করেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের হয়ে। হঠাৎ খবর এল, সাইগন থেকে ৫০ কিমি দূরে ট্র্যাং ব্যাং নামে একটি গ্রামে গোলাগুলি চলছে। সাইগনের বর্তমান নাম হো চি মিন সিটি। পরদিনই ক্যামেরা নিয়ে সেখানে হাজির হলেন উৎ। তার চোখে পড়ল এক নির্মম দৃশ্য। ইতিউতি পড়ে আছে লাশ, সেগুলিকে এড়িয়ে রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন শয়ে শয়ে রিফিউজি। বহু লোক বোমার হাত থেকে বাঁচতে মন্দিরে গিয়ে লুকিয়েছে। ঠিক সেই সময় একটি দক্ষিণ ভিয়েতনামিজ প্লেন থেকে আমেরিকা তাদের কুখ্যাত নাপালাম বোমা বর্ষন শুরু করে। পরপর চারটি বোম পড়ে গ্রামের ওপর। এর অনেকদিন পর, ১৯৮১ সালে, এই বোমা নাগরিকদের ওপর ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ।

আরও পড়ুন: শয়ে শয়ে পাখি, হাজার হাজার ডলফিনের মৃত্যু! যুদ্ধের মাশুল যেভাবে গুনতে হচ্ছে ইউক্রেনের প্রাণীদের

বোমা বিস্ফোরণের পরপরই উৎ এবং অন্যান্য সাংবাদিকরা এই শিশুদের ছুটে আসতে দেখেন। এদের মধ্যে কিমও ছিল। তার জামায় আগুন লেগে গিয়েছিল। 'জ্বলে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে', কচি গলায় কান্নামেশা সেই আর্তনাদ শুনে উতের চোখ যায় কিমের দিকে। 'নং কুয়া, নং কুয়া' চেঁচাতে চেঁচাতেই আগুনধরা জামাকাপড় খুলে ফেলে সে। দৌড়ে পালাতে থাকে গ্রাম থেকে দূরে। সেদিন কিম ফুকের শরীরের ৩০ শতাংশে থার্ড ডিগ্রি মাংসপোড়া ক্ষত ছিল। তাড়াতাড়ি কিমকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন উৎ। কিন্তু সেখানে তখন প্রচুর ভিড়। ডাক্তারেরা ক্লান্ত, আর নতুন রোগী নিতে চাইছিলেন না তাঁরা। নিজের প্রেস ব্যাজ দেখিয়ে উৎ হুমকি দেন, 'একজনও যদি মারা যায় আপনাদের অবহেলায়, গোটা পৃথিবীকে জানিয়ে দেব, নিশ্চিত!' কিম ফুকের চিকিৎসা শুরু হয়। ধীরে ধীরে স্থিতাবস্থায় আসে ছোট্ট কিম, ১৪ মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছিল তাঁর। পরে উৎ কিম ও কিমের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন, তাঁদের গ্রামেও যান।

ঔষধশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা
পরে ভিয়েতনামের সরকার কিম ফুককে কিউবা পাঠান, ঔষধশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার জন্য। সেখানেই নিজের বর্তমান সঙ্গীর সঙ্গে আলাপ হয় কিমের। পরে তাঁরা কানাডায় চলে আসেন। সাম্প্রতিক সেই প্রতিবেদনে কিম উতের তোলা সেই ছবিটি সম্পর্কে বলেন, 'নিক উৎ এই ছবিটা তুলে আমার জীবনটাকেই পালটে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর জন্যই আমি বেঁচে গিয়েছিলাম সে যাত্রায়– এও তো অস্বীকারের উপায় নেই।' পরবর্তীতে নিজের ওই নগ্ন ছবি দেখে উতের ওপর খুব রাগ হতো তাঁর, কখনও কখনও নিজেকে কুৎসিত মনে হত, ঘেন্না হত নিজের ওপর। 'বহুবার জনসমক্ষ থেকে সরে যেতে চেষ্টা করেছি, অদৃশ্য হয়ে থাকার চেষ্টা করেছি, সে শুধু আমার শরীরজোড়া পোড়া দাগের জন্য নয়, শরীরের তিনভাগের একভাগ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেইসব দাগে অসহ্য ক্রনিক ব্যথা তো উঠতই মাঝে মাঝে, তবে এই বিকলাঙ্গ শরীর নিয়েও মানসিক ভোগান্তি কিছু কম ছিল না। নিজেকে রীতিমতো ঘেন্না করতাম।' লিখছেন কিম, আর প্রতিবেদনটির নাম দিচ্ছেন, 'পঞ্চাশ বছর কেটে গেল'।

শান্তির দূত
বর্তমানে ‘কিম ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি সংস্থা চালান কিম। যুদ্ধের শিকার হওয়া বাচ্চাদের মানসিক এবং ঔষধাদি সংক্রান্ত সাহায্য করার মধ্যেই নিজের বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন তিনি। 'সেই ভয়ংকর দিনের কিছু টুকরো টুকরো কথা মনে রয়েছে এখনও। আমি আর আমার এক আত্মীয় মন্দিরের বাইরের চত্বরটায় খেলছিলাম।' প্রতিবেদনে লিখছেন কিম, 'হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ আর ধোঁয়া, সঙ্গে সঙ্গে শরীরে সেই তীব্র ব্যাথা, উফফফ্‌।' পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতি। "যত জোরেই আপনি দৌড়ন না কেন, নাপালাম আপনার সঙ্গ ছাড়ে না, সারাজীবনের জন্য এই ভয়ংকর জ্বলে যাওয়ার দাগ আর অসহ্য ব্যথা আপনাকে সে উপহার দিয়ে যায়। সত্যি বলতে কি, কখন আমি ‘নং কুয়া নং কুয়া’ চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়েছি সে আমার নিজেরও মনে নেই, কিন্তু সেই সময়ের ফিল্ম ফুটেজ রয়েছে, আশেপাশের লোকজনও দেখেছে, তারা বলে, সত্যিই ওই কথা বলতে বলতে দৌড়চ্ছিলাম। সে সময় উতের ওপর প্রচণ্ড রাগ হতো- তা মনে আছে।” তাঁর মা বলতেন, ছোটবেলায় কিম নাকি খুব হাসতেন। 'আমাদের জীবন খুবই সাদামাটা ছিল। নিজেদের চাষাবাদ ছিল, শহরের সবথেকে সেরা রেস্তোরাঁটা চালাতেন মা। মনে আছে, স্কুলে যেতে খুবই ভালবাসতাম। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে লাফদড়ি খেলতাম। একে অন্যকে তাড়া করতাম। কিন্তু সেসব মরে গিয়েছিল যুদ্ধে। আজ পঞ্চাশ বছর পরে আমি পরিষ্কার বলছি, আমি আর যুদ্ধের শিকার নই। মা হয়েছি, ঠাকুমাও হয়েছি, আমি একজন সারভাইভর। শান্তি ছড়িয়ে দিতে চাই সারা পৃথিবীতে।' কিম ফুক দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, 'দিনের শেষে ওই ছবি একটা শক্তিশালী উপহার, যুদ্ধে আক্রান্ত শত শত মানুষকে কিছু দেওয়ার সুযোগ তো করে দিয়েছে আমাকে ওই ছবিটাই।'

More Articles