লোকসভা নির্বাচন ২০২৪: বাংলায় মোট কত আসন পাবে বিজেপি?

Lok Sabha Election 2024: মানুষ জানে, রাজ্যের সরকার রাজ্যে তাঁদের আশ্রয়, রাজ্য সরকারের থেকেই যাবতীয় সুবিধা তারা পাচ্ছেন। ফলে কেন্দ্রে মোদি আর রাজ্যে দিদি এই সমীকরণ মেনে ভোট দেন রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষই।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি আসনের মধ্যে ২২ টি জিতেছিল তৃণমূল। ১৮ টি আসন জেতে বিজেপি। কংগ্রেস পায় মাত্র ২ টি আসন আর বামেদের বরাদ্দ ছিল শূন্য! সিপিআইএম মোট ভোটের মাত্র ৬.৩% পেয়েছিল। বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে সত্যিই ছিল 'কাঁটে কা টক্কর'! বিজেপি মোট ভোটের ৪০.৬ শতাংশ পায় আর তৃণমূল পায় ৪৩.৭%। উত্তরবঙ্গে গেরুয়া রঙ দেখে আশঙ্কা জেগেছিল শাসকের মনে। এই আশঙ্কা কি আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ? এই মুহূর্তে ভোট হলে ঠিক কত আসন পাবে বিজেপি? তার আগে গত নির্বাচনের দিকে এক ঝলক তাকানো যাক।

গতবার বিজেপির হয়ে আলিপুরদুয়ারে জেতেন জন বার্লা (তপশিলি উপজাতি সংরক্ষিত আসন), কোচবিহারে নিশিথ প্রামাণিক (তপশিলি জাতি সংরক্ষিত আসন), দার্জিলিংয়ে রাজু বিস্তা, জলপাইগুড়িতে ড. জয়ন্ত কুমার রায় (তপশিলি জাতি সংরক্ষিত আসন), রায়গঞ্জে দেবশ্রী চৌধুরী, আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়, বালুরঘাটে সুকান্ত মজুমদার, বনগাঁয় শান্তনু ঠাকুর (তপশিলি জাতি সংরক্ষিত আসন), বাঁকুড়ায় ড. সুভাষ সরকার, ব্যারাকপুরে অর্জুন সিং, বিষ্ণুপুরে সৌমিত্র খান (তপশিলি জাতি সংরক্ষিত আসন), বর্ধমান – দুর্গাপুরে এস এস আহলুওয়ালিয়া, হুগলিতে লকেট চট্টোপাধ্যায়, ঝাড়গ্রামে কুনার হেমব্রম (তপশিলি উপজাতি সংরক্ষিত আসন), মালদহ উত্তরে খগেন মুর্মু, মেদিনীপুরে দিলীপ ঘোষ, পুরুলিয়ায় জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো, রানাঘাটে জগন্নাথ সরকার (তপশিলি জাতি সংরক্ষিত আসন)। কংগ্রেস বহরমপুর আর মালদহ দক্ষিণকে রাখে দখলে। জেতেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী আর আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। 

আরও পড়ুন: ‘অখণ্ড ভারত’ তুরুপের তাস! লোকসভা ভোটের আগেই ভারতের দখলে পাক অধিকৃত কাশ্মীর?


তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ১০ টি তপশিলি জাতির, আর ২ টি তপশিলি উপজাতির। ঝাড়গ্রাম ও আলিপুরদুয়ার তপশিলি উপজাতির সংরক্ষিত আসন। দু'টিই জেতে বিজেপি। অন্যদিকে তপশিলি জাতির ১০ টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে বিজেপি ৫ টি মাত্র। এই সাতটি সংরক্ষিত আসন বাদে সাধারণ ১১ টি আসন পায় বিজেপি। এবারেও কি এই আসন সংখ্যা ধরে রাখতে পারবে বিজেপি? নির্বাচন জিততে হলে, স্থায়ী সরকার গড়তে গেলে সেই রাজ্যে একটা ভিত্তি লাগেই।

পশ্চিমবঙ্গ আন্দোলনের রাজ্য। এই রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল একের পর এক আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই। জমি আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে এই রাজ্যের রাজনীতিতে। সেই একের পর এক রক্ত ঝরানো আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ৩৪ বছরের ক্ষমতা ধরে রাখে সিপিএম। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামও কিন্তু জমি আন্দোলনই ছিল। মমতা পেরেছিলেন ওই ইস্যুটিকে ব্যবহার করে সিপিএমকে ক্ষমতাচ্যুত করে তৃণমূল জমানা প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু বিজেপি এই রাজ্যে কোনও আন্দোলনকেই গতি দিতে পারেননি। একদিন আধদিন চাকরিপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে কোনও কাজের কাজ হয়নি। হাতে রইল দুর্নীতির তাস। কয়লা দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, এমনকী ১০০ দিনের কাজের দুর্নীতি পর পর সামনে এনে তৃণমূল যে আসলে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার তা প্রমাণ করে ফেলেছে বিজেপি। তার প্রভাব কি ভোটবাক্সে পড়বে? বারেবারেই ইডি আর সিবিআইকে ব্যবহার করেছে বিরোধী নেতাদের জেলবন্দি করতে। ইডি-সিবিআই অস্ত্রটি এতই সাধারণ হয়ে গিয়েছে যে আম জনতার কাছে এরও ধার কমেছে।

মানুষ জানে, কোনও নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে কেন্দ্রের কোপ বাঁচাতে তারা দল বদলে নেন। দল বদলে নিলেই তাঁর পিছনে আর ইডি-সিবিআই লাগিয়ে দেওয়া হয় না। যেমন শুভেন্দু অধিকারী ঘুষ নিচ্ছেন প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যান। দুর্নীতি দিয়ে যদি সত্যিই ক্ষমতাচ্যুত করা যেত তাহলে তো সারদা-নারদা কেলেঙ্কারির পর তৃণমূল সরকার পড়ে যাওয়ার কথা। এ রাজ্যের মানুষ তা করেনি।

মানুষ জানে, রাজ্যের সরকার রাজ্যে তাঁদের আশ্রয়, রাজ্য সরকারের থেকেই যাবতীয় সুবিধা তারা পাচ্ছেন। ফলে কেন্দ্রে মোদি আর রাজ্যে দিদি এই সমীকরণ মেনে ভোট দেন রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষই। তাহলে বিজেপি নিজের দখল বাড়াবে ভাবছে কোন ভিত্তিতে?

বিজেপি তাহলে এই রাজ্যে কাদের ভোট পায়? মাঠ ময়দানের খবর বলছে বিজেপির অবস্থা এমনই যে বুথে এজেন্ট দেওয়ারও লোক নেই। তাহলে কি 'ভূতের ভোট' পাচ্ছে বিজেপি? বুথে ভোটার ধরে আনার ক্ষমতা বিজেপির এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু বিজেপির নিজস্ব ভোটার আছে কিছু যারা মেরুকরণে আস্থা রাখেন এবং হিন্দুত্বের ভরসাতেই, রামের নামে প্রভাবিত হয়েই ভোট দিচ্ছে। তাতেই বিজেপি গত নির্বাচনে ১৮ টা সিট পায়।
এই ১৮ টি মধ্যে দলিত ও উপজাতির ভোট ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বনগাঁ আসনে মতুয়া ভোট নিজেদের বাক্সবন্দি করতে পেরেছিল বিজেপি। সেখানে শান্তনু ঠাকুর মোট ৬,৮৭,৬২২ টি ভোট পান। তৃণমূলের মমতা ঠাকুর পান ৫,৬৭,০২৮ ভোট। সেবার সিএএ ছিল শান্তনু ঠাকুরকে দিয়ে ভোট পাইয়ে নেবার অব্যর্থ টোপ। কিন্তু পাঁচ বছরেও তা হলো না। সিএএ চালু নিয়ে শান্তনু ঠাকুর পিছু হটেই এসেছেন প্রায়। মতুয়া ভক্তরাও বলছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আগেও মতুয়া নেতা শান্তনু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। ফলে শান্তনুর কথার দাম নেই। গত ২৮ জানুয়ারি ডায়মন্ড হারবারে গিয়ে শান্তনু ঠাকুর দাবি করেন, আগামী সাত দিনের মধ্যেই সিএএ কার্যকর হয়ে যাবে। কিচ্ছু হয়নি, ফলে শান্তনু সুর বদলে বলেছেন, “মুখ ফস্কে সিএএ কার্যকর হবে বলে ফেলেছিলাম।’’ মতুয়া ভক্তদের আর আস্থা নেই তাঁর উপর।

২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ঠিক ক'টা আসন পাবে এই বিষয়ে বিবেচনা করতে গেলে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসছে তা খতিয়ে দেখা দরকার!

১। কোভিড পর্বে রেড ভলান্টিয়ারা যেভাবে কাজ করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে সিপিএম সামান্য হলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতিকূর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্ররা একজোট হয়েছে, রাস্তায় নেমেছে, মার খেয়েছে। আন্দোলনের পুরনো চেহারা দেখেছে রাজ্য। সিপিএমের নতুন মুখের প্রতি একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে নিঃসন্দেহে।

২। শান্তনু ঠাকুর সিএএ প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। মতুয়া ভোট যে বিজেপিই পাবে তার গ্যারান্টি নেই আর।

৩। দার্জিলিং ইস্যুতে কোনও সুষ্ঠু সমাধান নেই। দার্জিলিংয়ের মানুষের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি বিজেপি। রাজু বিস্তার উপর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। প্রাক্তন বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সেখানে দাঁড়াবেন এবার বিজেপির হয়ে। কিন্তু এখানেই গোষ্ঠী কোন্দল। দার্জিলিং আসন ছাড়তে রাজি নন বর্তমান সাংসদ রাজু বিস্তা। রাজু আদতে মণিপুরের বাসিন্দা। তাঁর টিকিট পাওয়ার ব্যপারে মণিপুর এবং আরও দু’একটি আসনের নাম উঠলেও দার্জিলিং ছাড়তে রাজি নন রাজু।

৪। রায়গঞ্জে দেবশ্রী চৌধুরীর কোনও গ্রহণযোগ্যতাই নেই। কংগ্রেস ধীরে ধীরে সেখানে নিজেদের হারানো দাপট ফেরাচ্ছে যে তা রাহুলের ন্যায় যাত্রায়তেই প্রমাণিত। ফলে এই আসনেও বিজেপি জিতবে কিনা সন্দেহ।

৫। রাহুল গান্ধি কিন্তু এখনও বলছেন মমতা জোটেই আছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে যেমন রেগেমেগে কংগ্রেসের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন, একাই লড়ব ইত্যাদি আস্ফালন করছিলেন- তাও সামান্য কমেছে। মমতা যদি চার পাঁচটি আসনেও একটু দুর্বল প্রার্থী দেন, আর সেখানে তুলনামূলক যোগ্য প্রার্থী বাছতে পারে কংগ্রেস, তাতেও বিজেপির ক্ষতি। কংগ্রেস নিজের ভোট ধরে রাখতে পারলে ডুববে বিজেপিই।

৬। বিজেপি যে ১৮ টি সিট পেয়েছে তার মধ্যে ১৩ টি আসনে গড়ে দেড় লক্ষ করে ভোট আছে বামেদের। বামের ভোট রামে গিয়ে তৃণমূলের ভোট কমানোর খেলা ছিল গতবার। এবার যদি বামের ভোট রামে না গিয়ে বামেই থাকে, আর তৃণমূল নিজের অংশের ভোটটুকুও পায় তাহলেই বিজেপি খুব বেশি হলে ৮ থেকে ১০ টা আসন পাবে।

 আরও পড়ুন: ‘‘INDIA জোট ক্ষমতায় এলেই… ’’ যে যে প্রতিশ্রুতি দিলেন রাহুল

৭। মমতার এই মুহূর্তে পাখির চোখ রাজ্য বাজেট। মনরেগার টাকা যে রাজ্য সরকারই দিয়ে দেবে তা একপ্রকার ঠিক করেই ফেলেছেন নেত্রী। সেটা হলে, এর চেয়ে বড় ভোটের তাস আর হয় না সাধারণ, গরিব মানুষের আস্থা জেতার!

ভোটে জিততে মানুষের ইস্যু লাগে। রামমন্দির হবে, এই ঘোষণা তো বিজেপি ২০১৪ থেকেই করে আসছে। ২০২৪ এ রাম মন্দির গড়ে ভোট টানার অঙ্ক খুব কি খুব কার্যকরি হবে বাংলায় ? যে ভোট বিজেপির তা বিজেপিরই থাকবে। কিন্তু যে ভোট অন্যের দল ভাঙিয়ে আনা, তা বিজেপি ধরে রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাহলে এ রাজ্যে বিজেপির  আসন বাড়বে কি আদৌ? লোকসভা ভোটের আগে বঙ্গ-বিজেপির সামনে এখন সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। 

More Articles