অপ্রাপ্তির ভিতর দিয়ে বন্ধুত্বের সেতু গড়ে দেয় যে কবিতারা
Rituparna Ghosh: আমরা যদি খেয়াল করি বুঝতে পারব ‘তিতলি’-তে ‘মা’ শব্দটির একটি বিবর্তন রয়েছে। ঊর্মি প্রথমাবধি তিতলি-র ‘মা’, তারপর নিজের মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, শেষে পৌঁছে তিতলি-র সঙ্গে ঊর্মির এক সখীসম্পর্ক জন্ম নেয়।
খুব ছোটো একটি শব্দ ‘অধিকারবোধ’, কিন্তু যা আমাদের মনে জন্মানোমাত্র কেবলই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন অজস্র অধিকারবোধের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমরা বাস করছি। কখনও-কখনও তাকে চিনতে পারছি। কখনও পারছি না।
চিনতে পারলেও ঠিক কীভাবে চিনছি সেই অধিকারবোধকে? ‘পাওয়ার ইচ্ছে’ কিংবা প্রেমের সমার্থকরূপে? হয়তো তা-ই!
কিন্তু যে-অধিকারবোধকে আমি চিনতে পারছি না, সামাজিকভাবে পরিচিত অধিকারের সংজ্ঞাগুলির সঙ্গে যার মিল নেই, তবুও তার অস্তিত্ব প্রতি মুহূর্তে রয়েছে, সেইরকম নীরব, প্রচ্ছন্ন, একাকী অধিকারের এক অনুভবকে সদ্যই দেখতে পেলাম একটি কবিতায়।
বহুল পরিচিত কোনও লেখা কিংবা গানের একটি সমস্যা হল, তাদের শিল্পরহস্যের দরজাগুলির সামনে প্রহরীর মতো জেগে বসে থাকে জনপ্রিয়তার ক্লান্তি। আর নতুন কিছুই পাওয়ার নেই এখান থেকে— অনেক ক্ষেত্রেই এই ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মন। সত্য-অর্থে, এমনই তো ভাবতাম আমি জয় গোস্বামীর ‘প্রাক্তন’ কবিতাটির সম্পর্কেও। আজ নয়, অনেকদিন ধরেই।
কবিতাটি প্রায় সকলেই জানেন। নিজের প্রাক্তনের সম্পর্কে কতগুলি স্মৃতিচিত্র বলতে-বলতে শেষে পৌঁছে শুধু লেখাটি জানতে চায় তার বিগত প্রেম, ‘কার গায়ে হাত তোলে এখন?’ আমি ভাবতাম, এ তো এক সংগত অত্যাচারপ্রশ্ন! এখনও যে তা ভাবি না, এমন নয়। এক বন্ধুকে পড়ে শোনাচ্ছিলাম কবিতাটি। সে-ই বদলে দিল আমার ভাবনা।
আরও পড়ুন: প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’
‘কার গায়ে হাত তোলে এখন?— কথাটির মধ্যে অতীতপীড়নের পাশাপাশি, একটি নীরব অধিকারের প্রশ্নও কি নেই? কী অধিকার? সম্পর্কের মধ্যে বাস করতে-করতে পুরুষের ‘গায়ে হাত তোলাটা’ সেই মেয়েটির কাছে নিত্য এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিল। সেই অভ্যাস, আসলে সম্পর্কগত এক অধিকারের ভূমি।
আজ যখন সম্পর্ক নেই, শুধু পুরুষটি নয়, তার ‘গায়ে হাত তোলার’ ঘটনাটিও মেয়েটির কাছে প্রাক্তন হয়ে গেছে। তার সেই অধিকারভূমিটুকু আজ কোথায়? কার হস্তগত?— এই হাহাকার-জিজ্ঞাসাও হয়তো লাইনটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে! আর, এই অধিকার-প্রশ্নটি সামনে আসামাত্র তা কেবল অত্যাচার নয়, এক প্রকারের আহত বাসনার স্তরযুক্ত মনকেও আমাদের সামনে খুলে ধরে। কবিতাটিকে এভাবে কখনও ভাবিনি। তবে লাইনটির মধ্যে যে এই ভাবনার সুড়ঙ্গপথ খোঁড়া রয়েছে, তা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমাদের মন, একই সঙ্গে বহু দিকে ধাবিত। একটি কবিতার মধ্যেও তাই থাকতে পারে বহু চিন্তার স্তর। পরিচিত কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়।
ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমাতেও এ-ঘটনা ঘটতে দেখি। সম্পূর্ণ নতুন অর্থ উন্মোচনের দ্বারা এমনই জনপ্রিয় এক কবিতাকে ব্যবহার করেছিলেন ঋতুপর্ণ। কোন কবিতা? বলছি।
‘তিতলি’-র মধ্যপর্বের একটি দৃশ্য মনে করা যাক। তিতলি ও তার মা ঊর্মির সঙ্গে পাহাড়ের রাস্তায় আচমকাই দেখা হয় বম্বের ফিল্মস্টার রোহিত রায়ের। তিতলি রোহিতের প্রেমমুগ্ধ ভক্ত। আর রোহিত? তিতলির মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক। ছবিতে তিতলির সামনে, রোহিত ও ঊর্মি দু-জনেই অপরিচিতের মতো এক পোশাকি আচরণ করতে থাকে। তিতলি যখন উপরের পাহাড়ি দোকানে কিছু জিনিস কিনতে যায়, রোহিত ও ঊর্মি গাড়ি থেকে নেমে আসে। এই নেমে-আসা কিন্তু ঊর্মির বিবাহিত জীবন ও রোহিতের স্টার-লাইফকে ছেড়ে তাদের ব্যক্তিগত অতীতের দিকে এগিয়ে যাওয়ারও সমার্থক। পাহাড়ের ঢালু পথে যত তারা হাঁটতে থাকে আমরা ততই সেই অতীতচিহ্নগুলি খুঁজে পাই।
আমরা জানতে পারি, রোহিতের প্রথম ছবি যখন হিট করেছে, তখন সেই সাফল্যের মধ্যে তাঁর একটি কথাই মনে পড়ছিল, ঊর্মি ছবিটি দেখেছে কিনা? ছবিটি কেমন লাগল ঊর্মির? ঊর্মি জানায়, সে গিয়েছিল ছবিটি দেখতে, তাঁর স্বামী নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। ওঁদের সেই কথোপকথনের একটি অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি:
রোহিত।। আচ্ছা এখানে জমি কিনতে গেলে কী করতে হয় বলো তো?
ঊর্মি।। আমি জানি না, কর্তা বলতে পারবে। কে কিনবে? তুমি?
রোহিত।। ভাবছিলাম। যখন কাজ করব না তখন এখানে একটা বাংলো করে থাকব।
ঊর্মি।। হঠাৎ এখানে?
রোহিত।। মনে হল!
ঊর্মি।। ভালো লাগবে? লোকজন, হইচই, লাইম লাইট, ফ্যান— সব ছেড়ে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এসে থাকতে?
রোহিত।। [অল্প হেসে] চা বাগানে থেকে সত্যি তুমি মেমসাহেব হয়ে গেছো। শাস্ত্রবাক্য মনে নেই? পঞ্চাশ বছর পার হলে বানপ্রস্থে যেতে হয়।
ঊর্মি।। তা হয়। কিন্তু তার আগে গার্হস্থ্যটাও করতে হয়।
রোহিত।। করছি তো।
ঊর্মি।। [বিস্ময়মুখে] করছ?
রোহিত।। হুম। মেয়ের কাছে শুনলে না কত বড়ো বাংলো আমার বম্বে-তে!
ঊর্মি।। শুধু বাংলো থাকলেই হবে? দেখার লোক লাগবে না?
রোহিত।। দেখার লোক নেই জানলে কী করে?
ঊর্মি।। মেয়ের কাছে শুনেছি। [একটু থেমে] বিয়ে করলে না কেন?
রোহিত।। করলাম না।
ঊর্মি। করলে না তো দেখতেই পাচ্ছি।
রোহিত।। তোমার কী মনে হয়, তোমায় ভুলতে পারলাম না বলে?
ঊর্মি।। [সংকুচিতভাবে] আমি তা বলিনি। এত সুন্দরী-সুন্দরী নায়িকা তোমার! কাউকে মনে ধরল না?
রোহিত।। সিনেমার নায়কদের নায়িকা ছাড়া বিয়ে করতে নেই বুঝি!
ঊর্মি।। তা কেন? কদ্দিন বিয়ে না করে কাটাবে বলো! এখন তুমি ব্যস্ত। আজ এখানে, কাল সেখানে। কিন্তু এক সময় তো বয়স হয়ে যাবে। শক্তি কমে আসবে। কাজ কমে আসবে। তখন দেখবে ভীষণ একা হয়ে গেছো। তখন মনে হবে একজন সঙ্গীর দরকার।
রোহিত।। কেন? বললাম তো! এখানে একটা বাংলো করব। কখনো-কখনো তোমাদের কাছে আসব চা খেতে, ক্যাসেলটন টি! খাওয়াবে না?
একটি বিষয় এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, রোহিত এবং ঊর্মি দু'জনেই তাঁদের জীবনে নিজেদের মতো অগ্রসর হলেও, দু'জনের সম্পর্কজনিত অনুভব এখনও তাঁদের মনে জাগ্রত রয়েছে। ঠিক এইখানে পৌঁছেই ঋতুপর্ণ ডেকে আনেন অতি পরিচিত এই রবীন্দ্র-কবিতাটিকে— ‘আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি/সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ’। নিঃসঙ্গ পাহাড়ি-পথে যখন ঊর্মির উচ্চারণে এই কবিতা আমরা শুনতে পাই, তখন ‘আমরা দু-জন একটি গাঁয়ে থাকি’-র সেই ‘গ্রাম’ যে আসলে রোহিত ও ঊর্মির অতীতের সম্পর্কভূমি, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সিনেমাতে, কবিতাটির এই নতুন ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু ছবির শেষে পৌঁছে সেই মুগ্ধতা বিস্ময়ের দিগন্তে মিশে যায়। ছবিতে, তিতলি এক সময় জানতে পারে যার প্রেমমাধুর্যে সে বিভোর হয়ে আছে সেই পুরুষ তার মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক।
এখানে একটি বিষয় অপূর্ব সূক্ষ্মতায় ‘ঊর্মি’ এবং ‘তিতলি’ চরিত্র দু'টির মধ্যে গ্রন্থিত করেছিলেন ঋতুপর্ণ। আমরা যদি খেয়াল করি বুঝতে পারব ‘তিতলি’-তে ‘মা’ শব্দটির একটি বিবর্তন রয়েছে। ঊর্মি প্রথমাবধি তিতলি-র ‘মা’, তারপর নিজের মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, শেষে পৌঁছে তিতলি-র সঙ্গে ঊর্মির এক সখীসম্পর্ক জন্ম নেয়। রোহিতের ইচ্ছে, সিনেমা থেকে রিটায়ারমেন্ট-এর পর পাহাড়েই ঊর্মির বাড়ির কাছে জমি কিনে থাকবে। সেই ইচ্ছেমুহূর্তেই ঊর্মির গলায় শোনা যায় এই কবিতা, ‘আমরা দু-জন একটি গাঁয়ে থাকি’। কিন্তু ছবির শেষে রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণকে ফিরিয়ে আনেন ঋতুপর্ণ অন্য দ্যোতনায়।
আরও পড়ুন:প্রাইড মান্থ, প্রান্তিক অস্তিত্ব ও ঋতুপর্ণ ঘোষ
রোহিতের বিবাহসংবাদ এসে পৌঁছলে— মা নয়, একই প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, কেবল দুই সখিকে দেখতে পাই আমরা, যাদের মনের বিরহঅস্তিত্ব এক। ঊর্মি যখন পাহাড়ি-পথে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি এক-মনে বলে যাচ্ছিল, তা দূর থেকে শুনতে পেয়েছিল তিতলি। তখন সে-কবিতাটির অভ্যন্তরীণ অর্থের প্রতি তিতলির অনুভব ছিল ঈর্ষাপ্রবণ। ছবির শেষে সেই কবিতাটিই মায়ের কাছে তিতলি আরেকবার শুনতে চায়। শোনেও।
কবিতাটিতে প্রথমবার ‘আমরা দু-জন’ কথাটির অর্থ ধরে ছিল ঊর্মি আর রোহিতের পুরনো সম্পর্ককে। এবার সেখানে এসে যেন দাঁড়াল তিতলি ও তার মা। একটি পুরুষকে না-পাওয়ার ভিতরে মা-মেয়ের একত্র বসবাস, সেটাই এখন তাদের গ্রাম! এখানেই অবাক হই, ঋতুপর্ণ ঘোষের কবিতাভাবনার প্রতি। একটি কবিতাকেই পরিচালক সম্পূর্ণ ছবিটির সারাংশচিত্র করে দিলেন! কবিতাকে, রবীন্দ্রচিন্তাকেও, সংকেতের সংমিশ্রণে এভাবেই বিস্তার দিতে পারতেন ঋতুপর্ণ।
বন্ধুত্বঋণ : অভিনন্দন ভট্টাচার্য্য