সংবিধানের জোরে মিইয়ে গেল 'জয় শ্রী রাম' ধ্বনি
Constitution of India: এবার লোকসভার প্রথম অধিবেশনেই রায়বরেলীর সাংসদ রাহুল গান্ধী বসলেন প্রথম সারিতে । এবং সেখান থেকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণের সময় সংবিধান দেখালেন।
প্রথমে সংবিধান প্রস্তাবনায় ছিল, ভারত একটি সার্বভৌম-গণতান্ত্রিক-প্রজাতন্ত্র। ১৯৭৬ সালে এর সাথে আরও দু'টি শব্দের যোগ করা হয় - 'ধর্মনিরপেক্ষ' ও 'সমাজতান্ত্রিক'। সূচনাকালে এই দু'টি শব্দ না থাকলেও, বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মধ্যে য়ে এই ধারণা স্পষ্ট করা হয়েছিল যে, ভারতের কোনও রাষ্ট্রধর্ম নেই। ফলত, রাষ্ট্র কোনও ধর্মের নেতৃত্ব দেবে না এটাই স্বাভাবিক। ১৯৭২ সালে 'কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল সরকার' মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, সংবিধানের মূল কাঠামোকে কোনও ভাবেই বদলানো যাবে না। সেখানে মূল কাঠামোর কিছু ক্ষেত্রও নির্দেশিত হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল— যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, গণতন্ত্র এবং ধর্মাচারণের স্বাধীনতা। পরবর্তী কালে শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগকেও এর সাথে জোড়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্টো পথে হেঁটে, এ বারের নির্বাচনে মূল প্রচার চালিয়েছিলেন— সংবিধান পরিবর্তন, হিন্দুরাষ্ট্র গঠন এবং 'এক দেশ-এক ভোট' নীতির বাস্তবায়ন নিয়ে।
১৮তম লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণের সময়, তাঁকে সংবিধান দেখালেন বিরোধীরা। আগে মোদিকে দেখা মাত্রই 'জয় শ্রী রাম' ধ্বনিতে গর্জে উঠতেন বিজেপি নেতারা। এবারেও তেমনটা হলেও, সেই জোর যেন ছিল না মোদির নেতাদের গলায়। বরং এবার সেই জোর দেখা গেল, লাল রঙের মলাট বাঁধানো সংবিধানে। গত এক দশক লোকসভার বিরোধী বেঞ্চের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির কোণার একটি আসনে বসতেন এবারের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। এবার লোকসভার প্রথম অধিবেশনেই রায়বরেলীর সাংসদ রাহুল গান্ধী বসলেন প্রথম সারিতে । এবং সেখান থেকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণের সময় সংবিধান দেখালেন। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ আসনে রামমন্দিরের অবস্থান। এই আসনেই বিজেপিকে কুপোকাত করা দলিত নেতা অবধেশ প্রসাদকে সাথে নিয়ে সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদবও প্রথম সারিতে বসেছিলেন। এ দিন বিরোধীরা সকলে মিলেই সংবিধান দেখিয়েছেন মোদিকে। এ যেন স্পষ্ট বার্তা— সংবিধান মেনেই দেশ চালাতে হবে। এই দিন আবার ইন্দিরা গান্ধির 'জরুরি অবস্থা'র কথা মনে করিয়েছেন মোদি। তবে, ৫০ বছর আগের ঘোষিত 'জরুরি অবস্থা' থেকেও ২০২৪-র অঘোষিত 'জরুরি অবস্থা' যেন আরও বেশি আশঙ্কার। সংবিধানের মূল কাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখা বর্তমান ভারতে প্রধান জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, কেন ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও, নরেন্দ্র মোদিকে শপথ গ্রহণের সময় সংবিধান দেখানো হল? কেন দলিত নেতা অবধেশকে সামনের সারিতে বসিয়ে সংবিধানের কথা মনে করানো হল? এই সকল কিছু খোলসা হওয়া দরকার।
আরও পড়ুন: ১০ বছর পর প্রথম! কেন রাহুল গান্ধিকে সংসদে বিরোধী দলনেতা করল কংগ্রেস?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন যে বছর, সে বছর ২৬ জানুয়ারির একটি সরকারি বিজ্ঞাপনে 'সমাজতান্ত্রিক' ও 'ধর্মনিরপেক্ষ' কথাটির উল্লেখ ছিল না। জানানো হয়েছিল, ত্রুটির কারণেই নাকি এমনটা হয়েছিল। এত দিনে বোঝা গিয়েছে, হয়তো তা নিছক ত্রুটি ছিল না, ইচ্ছাকৃত ভাবেই শব্দ দু'টির ব্যবহার করেনি মোদি সরকার। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু বলেছিলেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতা হৃদয়ে আছে।' কিন্তু জোর দিয়ে দেশবাসীকে বলতে শোনা যায়নি, সংবিধানের 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি মেনেই দেশ চলবে। এখন এগুলিকে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।
২০২০ সালের ৫ অগস্ট, দেশ জুড়ে লকডাউন, করোনার জেরে ঘরবন্দি ছিলেন দেশবাসী। রাস্তায় ছিলেন শুধুই পরিযায়ী শ্রমিকেরা। বিপন্ন দেশবাসীর জন্য সেসময় কী করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি? যা করেছিলেন, তা আসলেই সংবিধানের জন্য বড় আঘাত ছিল। দেশবাসীর অসহায় সময়ে সাড়ম্বরে অযোধ্যার রামমন্দিরের শিলান্যাস করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শিলান্যাস বলেই মনে করে পদ্মশিবির। প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান কোনও ধর্মেরই উপাসনাস্থলের শিলান্যাসের মতো ধর্মীয় কাজ করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, লকডাউনের সময় রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ অনুসারে বন্ধ রাখা হয়েছিল— নানা ধর্মাবলম্বী মানুষের উৎসব, অনুষ্ঠান, একত্রিত হয়ে উপাসনা করা। প্রশ্ন ওঠে, প্রধানমন্ত্রী বলেই কি বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি? বিজেপি নেতারা দাবি করেছিলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই মোদি শিলান্যাস করেছিলেন রামমন্দিরের। সত্যিই কি তাই! আশ্চর্যের কথা, মোদির এই শিলান্যাসের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা কিন্তু বামদলগুলি ছাড়া আর কাউকে তেমন ভাবে করতে দেখা যায়নি।
আবার, ঘৃণাভাষণ, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষের কারণে পিটিয়ে মারার ঘটনাতেও মোদি সরকার নির্বিকার থেকেছে। তথ্য বলছে, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ঘৃণাভাষণের ঘটনা অন্তত ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এনসিআরবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ঘৃণাভাষণের সংখ্যা ছিল ৩২৩টি, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছিল ১৮০৪। ভারতে ঘৃণাভাষণের অপরাধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারায় বিধান থাকলেও, মোদি শাসনে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যায়নি। যেমন— ২০১৫ সালে, উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরপুরে বজরং দলের সমর্থক বিবেক প্রেমী নামে এক যুবক, তার দলবল নিয়ে এক মুসলিম ব্যক্তিকে মারে। উত্তরপ্রদেশে তখন অখিলেশ যাদবের সমজাবাদী পার্টির সরকার। জাতীয় সুরক্ষা আইনে বজরং দলের ওই যুবককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, কয়েক মাস পরেই কেন্দ্র সরকার মুক্তি দিয়ে দিয়েছে তাঁকে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে অভিযুক্ত যুবককে ফুল মালা দিয়ে বরণ করা হয়। স্লোগান ওঠে - 'দেখো দেখো কওন আয়া, হিন্দুয়োকা শের আয়া।' সম্প্রতি ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নিজে, মুসলমানদের 'ঘুসপেটিয়া' বলে কটাক্ষ করেছেন। এ বার লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্যের এক প্রকার ট্রেন্ড শুরু করেছিলেন মোদি। তাহলে কি বলা যায়, ঘৃণাভাষণের উৎসই বিজেপি? কখনও গো-হত্যা বন্ধ করার নামে তো কখনও লাভ জিহাদের নামে, যে কোনও ব্যক্তিই মুসলিমদের মারতে পারেন। সেই অধিকার দিয়েছে বিজেপি সরকার। সিএএ-তেও শুধুমাত্র মুসলিমদের কথাই উল্লেখ নেই। শাসকগোষ্ঠী নিজেই 'ধর্মনিরপেক্ষ' দেশের মানুষদের ধর্মীয় বিভেদ, বিদ্বেষের দিকে ঢেলে দিয়েছে।
মোদির শাসনে ভারতের পরিযায়ী অর্থনীতিও প্রশ্নের মুখে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যার বন্ধক রাখার মতো সম্পদ রয়েছে, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা তাঁকেই সম্পদ বাড়ানোর সুবিধে করে দেয়। বেসরকারিকরণ মোবাইল, ইন্টারনেটেরও। বিএসএনএল-কে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে শেষ করা হয়েছে। রেলের বাজেট আর নেই। ফলত, বলা চলে 'সমাজতান্ত্রিক' শব্দটিকেও গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শব্দটির মূল অর্থ— রাষ্ট্রের সকলের মধ্যে সম্পদের সমান ভাগের নিশ্চয়তা। কিন্তু রাষ্ট্রের সম্পদ এখন গুটি কয়েক পরিবারের হাতে। দেশবাসীকে উদার অর্থনীতির লোভ দেখানো হলেও, আদতে তা দেশের উন্নতিসাধনের লক্ষ্যকে আরও পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ এই ব্যবস্থা নিম্নবর্গের মানুষকে আরও তলানিতে ঠেলে দিচ্ছে। তথ্য বলছে, দেশে ব্রিটিশ আমল থেকেও এখন বেশি বৈষম্য তৈরি হয়েছে। 'বিশ্ব ক্ষুধা সূচক'-এ ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭। এদিকে বিশ্বের অন্যতম 'ধনী' দেশ ভারত। কিন্তু এখানে পুষ্টির মতো মৌলিক অধিকারটি নেই।
বিদেশের একটি সংবাদমাধ্যম 'Verfassungsblog'-এ “The Right to Education and Democratic Backsliding in India”- শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়েছিল, ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজেপি সরকার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেখানে NEP-এর তথ্য সামনে রেখে দাবি করা হয়েছে, ২০২০ সালে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। শিক্ষার গেরুয়াকরণ নিয়েও দাবি করেছে সংবাদমাধ্যমটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ গিয়েছে মুঘল ইতিহাস। শ্রেণিকক্ষে ধর্মীয়করণ করতে গিয়ে বিজেপি সরকারের হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও সমালোচিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি দাবি করে,পাঠ্যপুস্তকের বহুদিনের ধারাকে বদল করে শিক্ষার মানকে লঘু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, এর পরেও ভারত কীভাবে বৈচিত্র্যময় পরিচয়ের ভারসাম্য বজায় রাখবে? কীভাবে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি পাবে? সম্প্রতি, কেন্দ্রীয় সরকারের নেট ও নিট নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা সামনে এসেছে। বলা হচ্ছে, এই পরীক্ষাগুলির আয়োজক সংস্থা ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ)-র ডিজি সুবোধকুমার সিং বিজেপি নেতা ও আরএসএসের ঘনিষ্ঠ। রাজনীতি-শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি সব যেন উল্টেপাল্টে গেছে।
'সার্বভৌম' কথার অর্থ হল— দেশের জনগণ এবং সংসদের বিচারে তৈরি হবে রাষ্ট্রের আইন, বিধি। কিন্তু দেখা গেছে, দ্বিতীয় বারের মোদি সরকারের বড় সহায় ছিল লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা। এ বার তো বিরোধীরাও শক্তিশালী। এই কথা মাথায় রেখেই আবারও ওম বিড়লার মতো স্পিকারকে হাতছাড়া করতে চাইলেন না মোদি-শাহরা। লোকসভা থেকে ১৩০-এরও বেশি সাংসদকে বহিষ্কার করেছিলেন ওম বিড়লা, যা কার্যত ইতিহাসে প্রথম। মহুয়া মৈত্রকে এমন একটি কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বহিষ্কার করা হয়েছিল, যারা বিজেপিরই পক্ষ নেয়। সংসদ ভবনের মধ্যেই মুসলিম সাংসদকে 'সন্ত্রাসবাদী' বলা হয়েছিল। এখানেও বিড়লা তাঁর স্পিকারের ভূমিকা পালন করেননি। আবার, ২০১৯ থেকে ২০২৪-র লোকসভায় ডেপুটি স্পিকারের পদ খালি ছিল। মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফায়, ইতিহাসে প্রথমবার ৫ বছর এই পদ খালি ছিল। সংবিধান অনুযায়ী, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে দু'জনকে নির্বাচন এবং এই পদ বিরোধীদের দেওয়াই দস্তুর।
সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক কথার অর্থ হল— জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের কাছে উত্তর দিতে বাধ্য থাকবেন। আর এই প্রশ্নোত্তরের প্রধান মঞ্চ হল— সংসদ ভবন। যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজেই দিনের পর দিন মুখ দেখাননি। ২০১৯-র ৫ অগস্ট, সংসদে আচমকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাটি প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেন। এরপর সাংসদে আলোচনা ছাড়া ৩টি কৃষি বিল পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ খোলাতেও বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হয়েছিল। চিন ভারতের জমির দখল নিয়েছে কি না সেই নিয়েও কোনও স্পষ্ট উত্তর মোদি সরকার দেয় না। লাদাখবাসীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও, তা রাখা হয়নি। এরপরও কি বলা যায়, মোদি সরকার দেশ শাসনে সংবিধানের সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক শব্দটিকে টিকিয়ে রেখেছেন?
শিশুরও অজানা নেই ভারতের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু গত ১০ বছর উল্টো চিত্রই দেখেছে দেশবাসী। 'গণতন্ত্র'- এর মূল কথা, অভাব-অভিযোগ-সমালোচনাকে স্বাধীনতা দেওয়া। কিন্তু দেশে এখন নির্বাচিত দলের কথাই শেষ কথা। যা সরাসরি গণতন্ত্র বিরোধী। বিজেপি সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সর্বদা হাতিয়ার বানিয়ে ছিল। অভাব-অভিযোগ-সমালোচনাকে অঙ্কুর থেকেই বিনাশ করেছে। দেশে এখন ভিন্নমতও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যাঁরা প্রশ্ন তুলতো, তাঁদের ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। যেমন - ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মোট ১৬জনকে গ্রেফতার করেছিল এনআইএ। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই এই মামলায় ৮৪ বছরের স্ট্যানস্বামীকে গ্রেফতার করা হয়। এনআইএ তাঁকে গ্রেফতার করলেও একদিনও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। অসুস্থতার (আগে থেকেই পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত ছিলেন) জন্য জামিন চাইলেও দেওয়া হয়নি। ইউএপিএ-এর সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর, কিন্তু উমর খালিদকে প্রমাণ ছাড়া ৪ বছর জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম, প্রশাসন, বিচারবিভাগ সব ক্ষেত্রই সরকারের হাত। মোদি সরকার লাগামছাড়া ভাবে মুসলিমদের আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া সকল কিছুতেই মন্তব্যও করেন।
গেরুয়া শিবির যে সংরক্ষণেরও বিরোধী। মোহন ভাগবত ২০১৫ সালে বলেছিলেন, 'সংরক্ষণ নীতি পর্যালোচনা করা উচিত'। ২০১৯ সালে বলেছিলেন, 'সংরক্ষণের পক্ষে এবং বিপক্ষের লোকেরা সম্প্রীতির পরিবেশে আলোচনা করলেই সুরাহা মিলবে।' আরএসএসের প্রচার বিভাগের মনমোহন বিদ্যা, ২০১৭ সালে বলেছিলেন 'সংরক্ষণ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত'। ২০১৬ সালে কে . এন গোবিন্দআচার্য বলেছিলেন, 'সংবিধানে সংরক্ষণ ব্যবস্থার উল্লেখ থাকা উচিত নয়'। আরএসএসের আদর্শবাদী এম.জি. বিদ্যা ২০১৫ সালে 'The Hindu'-কে বলেছিলেন, সংরক্ষণ তুলে দেওয়া উচিত। তাঁর দাবি, 'জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই, কারণ কোনও জাতি আর পিছিয়ে পড়া নয়। এসসি এবং এসটিদের জন্য আর ১০ বছর সংরক্ষণ থাকলেই হবে। তারপর সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষণ তুলে দেওয়া উচিত।' সংবিধানপ্রণেতারা সামাজিক ন্যায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা এনেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়নি। মোদি সরকার 'সাফারিং ইন্ডিয়া'র চিত্র ধামাচাপা দিয়ে 'শাইনিং ইন্ডিয়া'র বিজ্ঞাপন দেয়। এটি আসলেই সংবিধানকে মূল থেকে ছেঁটে ফেলার ভাবনা।
আরও পড়ুন: রাহুল গান্ধির সঙ্গে দু’ দশ মিনিট
উল্লেখ্য, বিজেপি 'এক দেশ, এক নির্বাচন' বাস্তবায়িত করার যে স্বপ্ন দেখছিল, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। অন্যদিকে, রাজ্যপালের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে - বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারের নিন্দা করা, ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাদের কথা মতো পদক্ষেপ নেওয়া, বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল আটকে রাখা। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা বলা যায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভে যখন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় আটকে গিয়েছিলেন, তখন বঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় তাঁকে উদ্ধার করতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাত, ইলেক্টোরাল বন্ড, বিরোধী দলনেতাদের গ্রেফতার, নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া - এই সকল কিছু ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী।
মোদি সরকার সংবিধানের মূল শব্দগুলিকে বাতিল করার কথা ঘোষণা না করলেও, এক দশক যে সংবিধানের মূল কাঠামো না মেনেই দেশ শাসন করা হয়েছে তা বলতে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। তাই, নরেন্দ্র মোদিকে বার বার সংবিধানের কথা মনে করিয়ে দেওয়া এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে শব্দগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলির যথাযথ প্রয়োগ না হলে তার বিরোধিতাও প্রয়োজন। প্রথম অধিবেশনে বিরোধীরা মোদিকে সংবিধান দেখানোর পাশাপাশি, বিজেপির এক সাংসদ মোবাইলে ছবি তুলেছেন বলেও অভিযোগ করেন। বিজেপির সাংসদ অস্বীকার করলে, রাহুল গান্ধি জোর গলায় জানান, সংসদে যেন মিথ্যে কথা না বলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন, বিজেপি থেকে তাঁকে 'শ্যাডো প্রাইম মিনিস্টার' তকমা দেওয়া হয়েছিল। এবারে যেন সেই ইঙ্গিত বিরোধী জোটের নেতা রাহুল গান্ধির দিকে। রাহুল শপথ নেওয়ার পর বলেছেন, 'জয় হিন্দ, জয় সংবিধান'। তারপর প্রোটেম স্পিকারকে নমস্কার জানিয়েছেন, সংসদের নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বিজেপি রাহুল গান্ধিকে 'অনিচ্ছুক রাজনীতিক' বলেই প্রচার চালিয়েছিল। বিজেপি যতই বলুক, বিরোধী দলনেতা রাহুলকে নিয়ে তারা চিন্তিত নয় তা মানা যায় না। এবার যে তাঁর জোরেই বিরোধীরা শক্তিশালী হয়েছে, তা-ও মানতেই হয়। ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের মূল ইস্যুই ছিল 'সংবিধান রক্ষা' করা। এতে বিরোধীরা যথেষ্ট সফলতাও পেয়েছে। তাই বিজেপি এখন শরিকনির্ভর সরকার। গত বছরগুলির মতো আর একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না বিজেপি। এ বার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর মতামতের ওপরেও ভরসা করতে হবে সরকারকে। মোদি সরকারের দুই দফা - নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া আইন, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা জীবন, মুসলমানদের জন্য জেনোসাইডের যুগ, লক্ষাধিক কৃষকের আত্মহত্যার দশক ছিল। সেই ক্ষোভ দেশবাসী ভোটবাক্সে উগরে দিয়েছেন। এখন দেখার তৃতীয়বারের মোদি সরকার ২০৪৭-এর সংবিধান বিরোধী কাল্পনিক ভারতের কথাই ভাববে নাকি সংবিধান রক্ষার কথা ভাববে? নাকি সাংবিধানিক সুরক্ষা পেতে দেশবাসীকে ফের রাহুল গান্ধির কাছেই ফিরে যেতে হবে?