বহুত্ববাদী ভারতবর্ষই গণতন্ত্রের মৃত্যু রুখবে?
Indian Right Wing Politics: মোদি-শাহরা যেভাবে রাজনৈতিক জমি দখল করতে চেয়েছিলেন, তাতে হয়তো ভারতবর্ষ বাধ সাধল।
ফিলাডেলফিয়া শহরে গেলে ফ্রিডম স্কোয়ারে একবার যেতে হবে। আমেরিকার সাবেক রাজধানীতে, ওয়াশিংটন তৈরি হওয়ার আগে যেখানে বসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়া তৈরি হয়েছিল, সেই চত্বরটা ঘুরে দেখলে একটা শিহরণ হয়, কীভাবে আধুনিক পৃথিবীর গণতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি হচ্ছিল। হ্যাঁ, অস্বীকার করা যায় না যে, তখনও আমেরিকা দাসপ্রথার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আর আজকের পৃথিবীর আরও বড় চ্যালেঞ্জ, ডোনাল্ড ট্রাম্প নামে একজন ভদ্রলোক, ভুল বললাম, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আবার হোয়াইট হাউজে ফিরে মার্কিন গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই বদলে দিতে চাইছেন। আসলে আমরা ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যখন শুধু আমেরিকা নয়, গোটা ইওরোপ জুড়ে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হচ্ছে। গত নভেম্বরে নেদারল্যান্ডের ভোটে চমকপ্রদ সাফল্যের পর পরিচিত ইসলাম বিদ্বেষী, অভিবাসন বিরোধী রাজনীতিক গির্ত উইল্ডার্স এই সপ্তাহেই শেষ পর্যন্ত সেদেশের সরকার গঠনের জন্য চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছেছেন। হতে পারে, উইল্ডার্স নিজে হয়তো প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন না, বা সরকার গড়ার জন্য তাঁকে অনেক কট্টরপন্থী নীতি ছাড়তে হলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যে ইওরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রক হয়ে গেলেন, সেটাই গোটা মহাদেশ জুড়ে রাজনৈতিক চাঞ্চল্য তৈরি করেছে।
ঠিক যে সময় ভারতবর্ষে সাত দফায় নির্বাচন হচ্ছে, সেই সময় ইওরোপিয় ইউনিয়নেরও ভোট হতে চলেছে, অর্থাৎ যে মহাদেশ থেকে গোটা পৃথিবী আধুনিক গণতন্ত্র শিখেছে, সেই ইওরোপই অতি দক্ষিণপন্থার মোকাবিলা নিয়ে তটস্থ। শুধু তো নেদারল্যান্ড নয়, বা ইতালিতে মুসোলিনি অনুগামী মেলোনির প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়া নয়, যে ফ্রান্সে বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্র এবং সমান অধিকার শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম সেই প্যারিসও কাঁপাচ্ছে ২৮ বছরের এক অতি দক্ষিণপন্থী তরুণ জর্ডান বারদেলা। অর্থাৎ, নেদারল্যান্ড থেকে ফ্রান্স, ইওরোপের সব বড় দেশই এখন উত্তাল ‘উই অ্যান্ড দ্য আদার’ তত্ত্বে এবং রাজনৈতিক প্রতর্কে, যেখানে ‘আদার’ মানে মুসলিমরা অথবা আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীরা। উদারমনা বলে পরিচিত ইওরোপে তাই ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে এই অতি দক্ষিণপন্থী নেতাদের তোলা প্রশ্নগুলো, কেন আমরা আমাদের সংস্কৃতিতে (পড়ুন ‘শ্বেতাঙ্গদের সংস্কৃতি’তে) ‘বহিরাগত’দের জায়গা দেব? ‘তাঁরা’ তো আমাদের উন্নত অর্থনীতি, চাকরি-বাকরির সুযোগ সুবিধা নেবেই!
আরও পড়ুন- ভণ্ড সেনা প্রেম! ইজরায়েলের হাতে ভারতীয় কর্নেলের মৃত্যুতে কেন মুখে কুলুপ মোদির?
আমেরিকা এবং ইওরোপের এই রাজনৈতিক প্রতর্ককে বুঝলে ভারতবর্ষের নির্বাচন কোন পরিপ্রেক্ষিতে হচ্ছে এবং এদেশের অতি দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি কোন দিকে ভারতীয় গণতন্ত্রকে ঠেলতে চাইছে সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না। ইওরোপ এবং আমেরিকায় অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা যে ‘আমরা এবং ওরা’র তত্ত্বকে প্রধান সামাজিক বিতর্ক বা রাজনৈতিক এজেন্ডাতে পরিণত করতে পেরেছে, ভারতবর্ষেও নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহেরা সেই চেষ্টাই করে চলেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অদ্ভুত মিল যে, তাঁরা কখনই নিজেদের বক্তব্য বা ‘কৃতকর্ম’-র জন্য অনুতপ্ত হন না। বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, হয়তো দশ বছর শাসনে থাকায় নরেন্দ্র মোদির যে পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা, অর্থনীতির বেহাল অবস্থা এবং দেশে ইডি-সিবিআই দিয়ে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চালু করার চেষ্টা, তা শেষ পর্যন্ত ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে বলেই গেরুয়া শিবিরের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার স্লোগান, ‘আব কি বার, ৪০০ পার’ ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে। ১৪০ কোটির দেশ ভারতবর্ষ শেষ পর্যন্ত হয়তো মোদি সাহেবের ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ’ প্রতিষ্ঠিত করার মরিয়া প্রচেষ্টাকে তেমন রাজনৈতিক জমি দিল না। কিন্তু আমেরিকার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত তার সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যিনি গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছিলেন, সেই ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেন নিজেই ইজরায়েলকে সমর্থন করতে গিয়ে মুক্তমনাদের জমিতেই কোণঠাসা। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে চলতে থাকা ছাত্র আন্দোলনই প্রমাণ করে দিচ্ছে মার্কিন সমাজে কী প্রবল উলটপুরাণ ঘটে গিয়েছে।
আরও পড়ুন- দশ বছরে দেশের বেকার, চাকরিপ্রার্থীদের কী দিলেন নরেন্দ্র মোদি?
ইওরোপের সংকট আমেরিকার চাইতেও তীব্রতর। যেকোনও ধরনের হিংসার নিন্দা করেও আমাদের জেনে রাখা ভালো, স্লোভাকিয়ার গুলিবিদ্ধ প্রধানমন্ত্রী আসলে নিজের দেশে রুশ একনায়ক পুতিনেরই সমর্থক ছিলেন। অর্থাৎ হাঙ্গেরির শাসক ভিক্টর ওর্বানের মতোই তিনিও ক্রেমলিনের দেখানো পথেই হাঁটছিলেন। ইওরোপ, যাকে একসময় আমরা উদারনীতি এবং আধুনিক মননের আঁতুড়ঘর বলে চিনতাম, সেই মহাদেশ তাই এখন অভিবাসন এবং ইসলামকে কী চোখে দেখা হবে সেই বিতর্কে দ্বিধাবিভক্ত। ইওরোপ যদি এই বিতর্ককে সামাল দিতে না পারে তাহলে ভারতবর্ষে আরএসএস বা তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি কী তাস খেলে এগোতে চাইছে, তা অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না। আশার কথা, মোদি-শাহরা যেভাবে রাজনৈতিক জমি দখল করতে চেয়েছিলেন, তাতে হয়তো ভারতবর্ষ বাধ সাধল। অদ্ভুত রাজনৈতিক সমাপতনে ঠিক আমেরিকাতেও যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প সেদেশের মধ্যভাগে বিপুল সমর্থন পেলেও দক্ষিণে গিয়ে আটকে যান, সবচেয়ে বড় প্রদেশ ক্যালিফোর্নিয়া তাঁকে বিমুখ করে। তেমনই এখানে, দক্ষিণ ভারত গেরুয়া আগ্রাসনকে রুখে দিচ্ছে। অর্থাৎ, অর্থনীতির বেহাল অবস্থার জন্য ‘আদার’-দের দায়ী করার অতি দক্ষিণপন্থী প্রবণতা ধাক্কা খেয়ে যায় উন্নত অর্থনীতিতে ঢুকেই, সেটা মার্কিন মুলুকের দক্ষিণে ক্যালিফোর্নিয়া হোক কিংবা এই ভারতে বিন্ধ্য পর্বতের ওপার।
বিশ্ব রাজনীতির এই প্রেক্ষাপটে আমাদের বুঝতে হবে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কীভাবে ক্ষমতা দখলের পথে এগোতে চায়। ‘উই অ্যান্ড দ্য আদার'-এর তত্ত্বে ভোটারদের কাছে টানা এবং নিজেদেরকে জনপ্রিয় করে তোলার পাশাপাশি একবার ক্ষমতা দখল করতে পারলে বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চায় এই রাজনীতি। আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে রাজনীতির মাঠের বাইরে ফেলে দেওয়াটাই তাদের কৌশল। ব্রাজিলে বোলসেনেরো জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা লুলুর সঙ্গে কী কী করেছিলেন সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। ভারতবর্ষেও গত দশ বছরের শাসনকালে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা একই পথে এগিয়েছেন। হতে পারে, এবারের নির্বাচনে তাদের আগ্রাসন সফল হলো না বা আটকে গেল, কিন্তু তাই বলে এটা ভেবে নিলে চলবে না যে, অতি দক্ষিণপন্থীরা হাল ছেড়ে দেবে। বিশ্বের কোনও দেশেই ছাড়েনি। ভারতবর্ষেও ছাড়বে না। তবে ১৪০ কোটির দেশ হওয়ার সুবাদে বা এত বৈচিত্র্য থাকার কারণেই হয়তো বিজেপি বা আরএসএসকে এত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী সমাজকে যেহেতু আরএসএস ধ্বংস করতে চায়, তাই হয়তো বহুত্ববাদী ভারতবর্ষ সেই পরিকল্পনাকে রুখে দিচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির নিয়মে এই লড়াই থামবে না, কোনও একপক্ষই বিশ্রাম নেবে না, চলতেই থাকবে।