প্রতিবাদের এই সমষ্টি-স্বর, এই ‘দেশে’র কথাই কি বলতে চেয়েছিল ঋতুর বিনোদিনী?
Rituparno Ghosh: চিঠিটির পরবর্তী অংশে, বিনোদিনী স্বীকার করছে, ওই দর্জিপাড়া স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে কাশীর ঘাটে পৌঁছে সে অন্য এক ‘দেশ’-এর অর্থ খুঁজে পেয়েছিল। — এইখানেই আজ আসতে চাই আমরা।
বহু বছর আগে বলা ঋতুপর্ণ ঘোষের এই কথাগুলি আজ বোধহয় আরও বেশি প্রাসঙ্গিক :
“বড় কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। একটার পর একটা দিন নতুন করে তীব্র হতে তীব্রতর কশাঘাতের চিহ্ন রেখে বিদায় নিচ্ছে।
কে পথ দেখাবে? কে দেবে আলো? কে অভয় দিয়ে বলবে— পাশে আছি।… অগ্রজরা, যাঁরা আদর্শ হয়ে ছিলেন চোখের সামনে; যাঁদের বাক্য-কর্ম-যুক্তি চিরকাল ঈর্ষণীয়ভাবে অনুকরণযোগ্য ছিল, তাঁরা কোথায়? যাঁদের জীবনচর্যা শিখিয়েছে কী করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, পাড়ি দিতে হয় নৃশংসতম মারের সাগর, তারা চুপ কেন?
বাবা-মাকে বেছে নেবার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু জীবনের পথে চেতনে-অবচেতনে আমরা সবাই তো বেছে নিই কোনও-না-কোনও অভিভাবক। তাঁরা কোথায়? না কি, তাঁরা সব আছেন পাশেই— আমারই চিনতে ভুল হচ্ছে কেবল?”
এ-রাজ্যের ফেলে-আসা এক অগ্নিময় সময়ের ভেতর দাঁড়িয়ে এমনই মনে হয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের। তিনি আজ নেই। কিন্তু তাঁর প্রশ্নগুলি, এখন আমাদেরও প্রশ্ন।
সম্প্রতি আরজি কর-এর চিকিৎসককে নৃশংস খুন ও অত্যাচার একটি জিনিস অন্তত স্পষ্ট করে দিল, আর তা হল— এমন পৈশাচিক ঘটনা এখনও জাগিয়ে তুলতে পারে প্রায় সমস্ত স্তরের মানুষের অধিকার-স্বর! এই জেগে-ওঠার সঙ্গে আমি একটি শব্দের সংযোগ খুঁজে পাই, তা হল: ‘দেশ’। শব্দটিকে একটু ভেঙে, তার অর্থবিস্তারের দিকে যেতে চাইব আজ, ঋতুপর্ণ ঘোষের হাত ধরে।
আরও পড়ুন: প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’
‘নির্জন সিনেমন’-এ, এর আগে ‘চোখের বালি’-র কথা লিখেছি। প্রতিশোধের সমান্তরাল ভূমি কেমন হতে পারে, বলার চেষ্টা করেছি সে-লেখায়। আজ, আরও একবার ‘চোখের বালি’-র শরণাপন্ন হই। অনেকেরই মনে থাকবে, ছবিটির শেষের কয়েকটি দৃশ্য। বিহারী বিনোদিনীকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে এসে দ্যাখে, বিনোদিনী চলে গেছে। রেখে গিয়েছে আশালতার জন্য একটি চিঠি। চিঠিটি এরকম:
“ভাই, বালি এতদিনে এই প্রথম তোকে চিঠি লিখছি। গোড়ার দিকে প্রয়োজন হয়নি, অষ্টপ্রহর একসঙ্গে ছিলুম। যখন আলাদা হলুম, তখন প্রয়োজন হয়তো ছিল কিন্তু লেখার কিছু ছিল না। মনে পড়ে, তুই বারবার জিজ্ঞেস করতিস ‘দেশ’ কী? পিসিমার ‘দেশের বাড়ি’ আর মকবুলের ‘দেশের বাড়ি’ আলাদা কেন? বিহারীবাবু যে-দেশের কাজ করেন সে কোন ‘দেশ’? তোর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে সে-চিন্তা আমায় বড় ভাবিয়েছে রে! তোর আর আমার মধ্যে বাইরে অনেক অমিল ছিল। তবু আমরা ‘সই’ পাতিয়েছিলাম। বেশ ছিলাম দর্জিপাড়া স্ট্রিটের দোতলার অন্তঃপুরে। সেটাই ছিল আমাদের রোজকার জগৎ। যদি ‘দেশ’ বলতে চাস, তা-ও বলতে পারিস।অমন বাইরের অমিল নিয়ে মিলেমিশে থাকা এ-দেশের ইতিহাসে নতুন নয়, তাই আমরাও নতুন কিছু করিনি বালি। তাই বলে অন্তরের মিল বলতে সত্যিই কি কিছু ছিল না? ছিল। সংসার করাবার সাধ। ওই যে বললাম, ওই দর্জিপাড়া স্ট্রিটের অন্তঃপুরের বাইরে আমরা আর কিচ্ছু দেখিনি। তাই আমাদের দেখা একটা মানুষকে নিয়ে দু'জনেই সে-সাধ মেটাতে চেয়েছি। তাতে সাধ-ও মেটেনি। আমাদের ছোট্ট ‘দেশ’-টুকুও ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। কার্জন সাহেবের আইন সত্যি যদি ফলে, তাহলে এখন থেকে আমি আর তুই দু'টো আলাদা দেশে থাকব। সেই দুই দেশে বসে আমরা যদি নিজের-নিজের এতদিনকার অপমান, দুঃখ আর বঞ্চনার কথাই শুধু ভাবি তাহলে তো আমরা প্রথম থেকেই হার মেনে নিলুম।
আসলে ‘দেশ’ তো মনের মধ্যে বালি। অন্তরের যোগ কোনওদিন যদি আমাদের কিছু থেকে থাকে, সই পাতানোর দিন সেই যে আমরা বলেছিলুম ‘ওপরে খই, নীচে দই/তুই আমার আধজন্মের সই’ যদি সেটা একবারের জন্যও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে থাকি, তাহলে কার্জন সাহেব আমাদের কী জব্দ করবে?
যেদিন ওই দর্জিপাড়া স্ট্রিট ছেড়ে গিয়ে কাশীর ঘাটে দাঁড়ালুম, সেদিন জানলুম সত্যিকারের ‘দেশ’ কাকে বলে? সেখানে হেঁশেল, উঠোন, খড়খড়ি-র বাইরেও যে একটা বিরাট জগৎ, তা তো কেবল বইয়ে পড়েছি রে আর ভেবেছি গল্পকথা! ‘মহাভারত’-এ আছে, মায়ের পেটে অভিমন্যু মস্ত বীর হয়েছিল। তোর পেটে যে সন্তান, সে তোর সাথে-সাথে রোজ গঙ্গার স্নান করেছে। দোহাই বালি, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, তাকে কেবল ওই দর্জিপাড়া স্ট্রিটের দোতলার বাড়িতে আটকে রাখিস না। দেখবি, সত্যিকারের ‘দেশ’ কাকে বলে, সে-ই একদিন তোকে বুঝিয়ে দেবে!”
প্রথমেই বলি, এই চিঠিটি মূল ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে নেই। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ এই চিঠি লেখেননি। সিনেমায় ব্যবহৃত এই চিঠি, ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা। চিঠিটির সম্পূর্ণ উল্লেখ এখানে করলাম কারণ, এর মধ্যে দিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দেশ’ চিন্তার আধারকে বোধহয় আমরা কিছুটা স্পর্শ করতে পারব।
চিঠিটিতে অনেকগুলি ‘দেশ’-এর কথা বলছেন ঋতুপর্ণ। বিনোদিনী বলছে, ‘পিসিমার ‘দেশের বাড়ি’ আর মকবুলের ‘দেশের বাড়ি’ আলাদা কেন?’ লক্ষ করে দেখুন, এখানে ‘দেশ’ কথাটির মানে আটকে রইল কেবল বাস্তুভিটের দোরগোড়ায়। আবার, এই বিনোদিনী-ই বলছে দর্জিপাড়া স্ট্রিটের একটি মানুষ (মহেন্দ্র)-কে নিয়ে তাদের দু'জনের সমস্ত ইচ্ছেও আসলে একটি ‘দেশ’। সে ‘দেশ’-এই তারা একসঙ্গে বাস করে।
চিঠিটির পরবর্তী অংশে, বিনোদিনী স্বীকার করছে, ওই দর্জিপাড়া স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে কাশীর ঘাটে পৌঁছে সে অন্য এক ‘দেশ’-এর অর্থ খুঁজে পেয়েছিল। — এইখানেই আজ আসতে চাই আমরা। একটি ‘দেশ’, ব্যক্তিগত। আরেকটি ‘দেশ’ ছড়িয়ে আছে সমগ্র মানবতাকে ঘিরে। ‘চোখের বালি’-র প্রায় সব কটি মানুষ যে-ব্যক্তির দ্বারা আবর্তিত হয় সেই ‘বিনোদিনী’ চরিত্রটির মধ্যেই ‘দেশ’ কথাটিকে দ্বি-অর্থে রোপণ করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। আশালতাকে লেখা এই চিঠিটির মধ্যে তো তার ভূমণ্ডল সহজেই দেখতে পাই।
এর বাইরেও, এ-চিন্তার আরও একটি চিহ্নসুর পরিচালক প্রয়োগ করেছিলেন এই ছবিতে। মনে করতে অনুরোধ করব, ‘চোখের বালি’-তে রবীন্দ্রনাথের দুটি পৃথক গানকে একত্রে যেন-বা একটি গানের শরীরে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। ‘আজি বাংলা দেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ এবং ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম প্রেম মেলে না’--- এই দুটি গানের সুরের ভাবপরিবেশ প্রায় এক। ছবিতে, দুটি গানকে একক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন পরিচালক।
এই সূত্রে জানিয়ে রাখি, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম’ ১৮৮৮ সালে ‘মায়ার খেলা’-র জন্য তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর, ১৯০৫ সালে গিরিডিতে থাকাকালীন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আবহাওয়ায় যে বাইশ-তেইশটি গান রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার মধ্যে একটি হল: ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’।
আরও পড়ুন: অনন্ত বিরহের বর্ষায় বৃষ্টি লুকোয় যে ‘রেইনকোট’
প্রশ্ন জাগে, গান দু'টিকে ঋতুপর্ণ ঘোষ একসঙ্গে, একটি গান হিসেবে প্রয়োগ করলেন কেন? হয়তো প্রয়োগ করলেন এই কারণে যে, গান দুটির মধ্যে বিনোদিনীর অস্তিত্ব অর্ধভাগে ছড়িয়ে রয়েছে। ‘চোখের বালি’-তে ‘প্রেম’ কি সত্যি অর্থে কেউ পায়? বরং সে-প্রেমের অন্বেষণে উপস্থিত হয় একের পর এক ঝঞ্ঝা। এখানেই, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম’। আবার, ওই যে বিনোদিনী বলছে সে কাশীর ঘাটে গিয়ে বহু মানুষের মাঝে নতুন ‘দেশ’-এর অর্থ খুঁজে পেয়েছে, রোজকার চাওয়া-পাওয়ার বাইরে দেখতে পেয়েছে উত্তরণের পথ, এখানেই হয়তো বেজে ওঠে, ‘আজি বাংলা দেশের হৃদয় হতে’ গানটি। হৃদয়, তখন একার হৃদয় নয়। সমষ্টির সঙ্গে সে জেগে উঠতে চায়। তাই ‘বাংলা দেশের হৃদয়’ কথাটিকে বিনোদিনীর উত্তরণের নির্দেশক-চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করলেন ঋতুপর্ণ!
আজ যখন, নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার ব্যক্তিগত দেশ-কে পেরিয়ে এসে, সমগ্র বাংলা এমনকি গোটা ভারতবর্ষ আরজি কর-এর সেই নির্যাতিতা মেয়েটির জন্য প্রতিবাদের একটিই জমাটবদ্ধ স্বরে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন সেই একত্র স্বর-ই তাদের ‘দেশ’।
যে-দেশের সংজ্ঞা বহু আগেই খুঁজে পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।