গাল দিয়ে ঢুকে খুলি দিয়ে বেরিয়েছিল রড! ১৮৪৮ সালের যে ঘটনা বদলে দেয় চিকিৎসা বিজ্ঞানকে...

Brain Damage: যে লোহার রডটি গেজের মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল তা প্রথমে তাঁর বাম গাল দিয়ে ঢুকে যায়।

সাল ১৮৪৮। ১৩ সেপ্টেম্বর। দুর্ঘটনাজনিত এক বিস্ফোরণ ঘটল! রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে তখন। রেলপথ নির্মাণের ফোরম্যান ফিনিয়াস পি. গেজ ছিটকে গিয়ে পড়লের বিস্ফোরণের জায়গা থেকে বেশ কয়েকফুট দূরে। বাকি বর্ণনা শুনলে শিরশির করে উঠবে গা-মাথা। যে অবস্থায় ফিনিয়াস গেজকে পাওয়া গেল তা চোখে দেখা যায় না। মাথার মধ্য দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে একটি লোহার রড! কেউ আশাও করতে পারেনি যে তিনি বেঁচে যাবেন। অথচ তিনি বাঁচলেন, চিকিৎসা জগতের ইতিহাসে এক অন্যতম বিতর্কিত থেরাপির জন্ম দিয়ে বেঁচে উঠলেন তিনি।

যে লোহার রডটি গেজের মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল তা প্রথমে তাঁর বাম গাল দিয়ে ঢুকে যায়, তারপরে মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে গিয়ে সোজা মাথার খুলির উপরের অংশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বিস্ফোরণটি যেখানে হয়েছিল সেখান থেকে কয়েক ফুট দূরে ছিটকে গিয়ে পড়েছিলেন গেজ। রক্তে ভেসে যাচ্ছেন, খুলি চৌচির! একটা লোহার রড ব্যবহার করে একটি গর্তে বিস্ফোরক পাউডার ভরছিলেন গেজ। ওই লোহার রডের সঙ্গে একটি পাথরের আঘাত হতেই বিস্ফোরণটি ঘটে যায়। লোহার রড ছিটকে এসে তাঁর মুখ মাথা ভেদ করে দেয়। ১৩.২৫ পাউন্ডের লোহার রড, ১ মিটার লম্বা, ১.২৫ ইঞ্চি চওড়া৷ এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর ততোধিক ভয়াবহ আঘাত সত্ত্বেও তিনি বেঁচে যান।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই মুহূর্তে যখন গেজকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, ডক্টর জন হার্লোকে দেখে গেজ প্রথম বলেন, "নিন, ভালো ব্যবসার সুযোগ পেলেন।" গেজের বেঁচে থাকা যেমন অস্বাভাবিক ছিল, ততটাই অস্বাভাবিক ছিল সেরে ওঠার সময়ে গেজের মধ্যে ঘটা পরিবর্তনগুলি। এই ভয়াবহ আঘাতের পরে, গেজের সহকর্মী এবং বন্ধুরা তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। এই ঘটনাটি মন এবং মস্তিষ্কের মধ্যেকার এমন সম্পর্কের উপর আলোকপাত করে যা আগে কখনও সেভাবে ভাবাই হয়নি। ১৯৯৮ সালের একটি নিবন্ধে নিউরোসায়েন্টিস্ট কাইরান ও'ড্রিসকল এবং জন পল লিচ সেই ঘটনাগুলি বা পরিবর্তনগুলির ব্যাখ্যা করেন যার ফলে বোঝা যায় দুর্ঘটনার পরে গেজ আর সেই গেজ ছিলেন না।

রডটি গেজের মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে এভাবেই ঢুকে যায়।

গেজের সহকর্মীরা বলতেন, সবচেয়ে দক্ষ এবং সক্ষম ফোরম্যান ছিলেন গেজ। তবে মনের পরিবর্তন ঘটার পর সহকর্মীরা আর সেই মানুষটিকে চিনতেই পারেন না যেন! আগের মতো সেই চনমনে লোক নন, আগের মতো সেই দক্ষতা নেই, অস্বাভাবিক আচরণ, মাঝে মাঝে চরম অশ্লীল হয়ে যাওয়া, সঙ্গীদের প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাও নেই, সংযম নেই, অধৈর্য একজন মানুষ! যেন শিশুর মতো বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণ, অন্যদিকে পশুর মতো শক্তিশালী আবেগ! গেজের মন আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায় এই দুর্ঘটনার পরে।

বিজ্ঞানীরা দেখেন, ফ্রন্টাল লোবে গেজের অরবিফ্রন্টাল কর্টেক্সের ক্ষতি হয়েছে। এই আঘাতটিই পরবর্তীতে ফ্রন্টাল লোবোটমি নামে পরিচিত একটি অত্যন্ত বিতর্কিত পদ্ধতির জন্ম দেয়। ১৯০০-এর দশকের মাঝামাঝি হাজার হাজার লোবোটমি করা হতে থাকে। মস্তিষ্কে সরাসরি অ্যালকোহল ইনজেক্ট করা থেকে শুরু করে চোখের সকেটে বরফের দেওয়া পর্যন্ত অজস্র কৌশল ব্যবহার করা হয়। মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলির চিকিত্সার লক্ষ্যে, বা রোগীদের পরিচালনা সহজ করার লক্ষ্যে এই পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হয় যাতে মস্তিষ্কের সামনের লোবের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সেই কোনকালে মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে একটি লোহার রড ঢুকে যাওয়ার মতো ঘটনা থেকেই স্নায়ুর চিকিৎসায় একটি সম্পূর্ণ নতুন শাখার জন্ম হয়।

More Articles