জিনঘটিত রোগের মুশকিল আসান! যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল বিজ্ঞানীদের
Nobel Prize in Physiology or Medicine 2024: এই বিজ্ঞানীরা আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের ল্যাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্স নামে একটি পরজীবি প্রাণীকে নিয়ে।
২০২৪ সালে শারীরবিদ্যা বা মেডিসিনে যৌথভাবে নোবেল পেলেন ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকান। মাইক্রো আরএনএ-এর আবিষ্কার এবং আরএনএ-র প্রতিলিপিকরণের পরে জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণে মাইক্রো আরএনএ-এর ভূমিকা কী – এই বিষয়ে গবেষণার জন্য তাঁদের নোবেল পুরস্কারজয়ী বলে ঘোষণা করে নোবেল কমিটি।
১৯৫৩ সালে আমেরিকার হ্যানোভারে জন্ম ডঃ অ্যামব্রোসের। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস মেডিক্যাল স্কুলের ন্যাচারাল সায়েন্স বিভাগে সিলভারম্যান প্রফেসর তিনি। অন্যদিকে, ডঃ রাভকানের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়াতে। ১৯৫২ সাল। বর্তমানে তিনি ম্যাসাচ্যুসেটস জেনেরাল হসপিটাল এবং হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে জেনেটিকসের অধ্যক্ষ। যে গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য গ্যারি অ্যামব্রোস নোবেল পেলেন, সেই কাজের পুরোটাই তিনি করেছিলেন ম্যাসাচ্যুসেটস জেনেরাল হসপিটাল এবং হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে। অন্যদিকে, ডঃ অ্যামব্রোসের গবেষণার পুরোটাই হয়েছে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। তাঁদের কাজ কী নিয়ে, সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক।
স্মল আরএনএ বা এসআরএনএ আদতে একটি নন-কোডিং আরএনএ অণু। জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মাইক্রো আরএনএ-এর। কিন্তু নন-কোডিং কথাটা কেন বলা হচ্ছে, সেটা জানতে গেলে আগে জানতে হবে আরএনএ কী? খুব সোজা ভাবে বলতে গেলে, আরএনএ অর্থাৎ রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড একটি অণু, যারা কোশের ভেতরে প্রোটিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের ছাড়া একটি জীবন্ত শরীরে প্রোটিন তৈরি হবেই না।
আরএনএ আবার তৈরি হয় ডিএনএ থেকে। যে কোনও জীবের ডিএনএ-তে লুকিয়ে থাকে তার জিনগত সমস্ত তথ্য। ডিএনএ-এ চারটি আলাদা-আলাদা নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরি। আর এখানেই সেই জীবের সমস্ত জিনগত তথ্য যেন সংকেতের মাধ্যেমে লেখা হয়েছে। একটি ডিএনএ-ও তাই নির্দিষ্ট গঠনেরই আরএনএ তৈরি করে।
আরও পড়ুন- সমুদ্রের রঙ দেখে কৌতূহল! যে ঘটনা পরাধীন ভারতে প্রথম নোবেল এনে দিয়েছিল
ডিএনএ-এর মতোই চারটি আলাদা-আলাদা নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরি হয় একটি আরএনএ অণু। আরএনএ-র ক্ষেত্রে এই নিউক্লিওটাইডগুলি হল অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থিয়ামিন, ইউরাসিল। পরপর সাজানো যে কোনও তিনটি নিউক্লিওটাইডের একটি ‘সেট’ থেকে তৈরি হয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা কিনা প্রোটিনের গঠনগত একক। একটি সেটে থাকা নানা রকম ক্রম একটি নির্দিষ্ট অ্যামাইনো অ্যাসিডের সংকেত বা কোড। অনেকগুলি অ্যামাইনো অ্যাসিড সঙ্গবদ্ধ হয়ে আবার একটি প্রোটিন তৈরি হয়।
কিন্তু স্মল আরএনএ-র ক্ষেত্রে নিউক্লিওটাইড থাকলেও, এদের থেকে ‘কোডিং’ হয়ে অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি হয় না। কাজেই প্রোটিন তৈরি হয় না। তাই এই অণুকে নন-কোডিং আরএনএ বলা হয়। তাহলে স্মল আরএনএ-র কাজ কী? কেনই বা তাদের জীবকোশে থাকা দরকার? সেই উত্তর অনেকদিন ধরে খুঁজছিলেন ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকান।
আমাদের শরীরের বাইরে ও ভেতরে যা যা অঙ্গ রয়েছে, তার মূল কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান প্রোটিন। এই যে পাঠক ফোন বা ল্যাপটপটা খুলে এই প্রতিবেদন পড়ছেন, হাত নাড়ছেন, লেখাটা পড়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন – এই সব ক’টা কাজ করতে নানারকম প্রোটিন সঙ্গবদ্ধ ভাবে কাজ করছে। সে আপনার শরীরের পেশিতেই হোক কিংবা নার্ভকোশে।
ডিএনএ-র থেকে আরএনএ তৈরির সময়েই যদি কিছু ভুলভ্রান্তি হয়,তার প্রভাব কিন্তু প্রোটিন তৈরির সময়েও পড়বে। আর সেই দিকে কড়া নজর থাকে নানারকম অণুর, যাদের বিজ্ঞানের পরিভাষায় ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর বলে। ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো খেয়াল রাখে, নির্দিষ্ট কোশে যেন নির্দিষ্ট ধরনের প্রোটিনই তৈরি হয়। মানে নার্ভকোশের জন্য দরকারি প্রোটিন যেন নার্ভকোশেই তৈরি হয়, তা যেন আবার ভুল করে অন্ত্রের কোশে তৈরি না হয়ে যায়। কিংবা যদি ডিএনএ বা আরএনএ-তে মিউটেশন হয়ে, তাদের নিউক্লিওটাইডের ক্রম যদি হেরফের হয়, তাতেও ওলোটপালট হয়ে যেতে পারে সমস্ত হিসেব।
এই বিজ্ঞানীরা আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের ল্যাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্স নামে একটি পরজীবি প্রাণীকে নিয়ে। পরজীবি প্রাণী মাত্রই এরা আকারে ছোট হয়। সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্সও এক্ষেত্রে কোনও ব্যতিক্রম নয়। গুনেগেঁথে এক হাজারটা মাত্র কোশ দিয়ে তৈরি এই পরজীবি। কিন্তু আকারে ছোট হলে কী হবে, এদের শরীরে কিন্তু নানারকমের প্রোটিন তৈরি হয়, ঠিক মানুষেরই মতো। সে জন্যই বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্টের জন্য সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্স বেশ পছন্দের একটি প্রাণী।
বিজ্ঞানীরা এর আগেই এই প্রাণীর কোশে লিন-৪ আর লিন-১৪ নামে দু'টি আলাদা আলাদা জিনের সন্ধান পেয়েছিলেন, যেগুলির মিউটেশন হয়ে গেছিল। এরকম জিনকে মিউট্যান্ট বলে। আর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এরকম মিউট্যান্ট যে ভুলভাল প্রোটিন তৈরি করে, তার ফলে একটি জীবের গঠন ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। তাদের শরীরে নানারকম কাজে ব্যাঘাতও ঘটতে পারে একই কারণে। লিন-৪ আর লিন-১৪-এর ক্ষেত্রেও তাই হল। ডিম ফুটে যখন পরজীবিটি পূর্ণতা পাচ্ছে ধীরে ধীরে, দেখা গেল তার শরীর আর দশটা স্বাভাবিক সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্সের শরীরের মতো নয়। লিন-৪ মিউট্যান্ট যে সমস্ত সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্সের শরীরে পাওয়া গেল, দেখা গেল তাদের আকৃতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বড়। লিন-১৪ মিউট্যান্টের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উলটো। এদের কারণে সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্স শরীর স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট হয়ে যায়।
ভিক্টর অ্যামব্রোস দেখলেন লিন-৪ মিউট্যান্ট গিয়ে লিন-১৪-র কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ফলে এই দু'টি মিউট্যান্ট একসঙ্গে থাকলে, লিন-১৪ আর কাজ করতে পারছে না। কিন্তু তখনও এই দু'টি মিউট্যান্টকে ক্লোন করা হয়নি। তাই ডঃ অ্যামব্রোস চেষ্টা করলেন লিন-৪-কে আগে ক্লোন করতে। কিন্তু বহু বছর কাজ করার পরেও তিনি বুঝতে পারছিলেন না, সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্সের জিনের ঠিক কোন অংশে এই মিউট্যান্টকে পাওয়া যাবে। দীর্ঘ চেষ্টার পরে তিনি সফল হলেন এবং এই মিউট্যান্ট থেকে লিন-৪ আরএনএ তৈরি করলেন। কিন্তু তিনি দেখলেন সেই আরএনএ বড্ড ছোট আকারের। এদিকে তার থেকে আবার প্রোটিনও তৈরি হয় না।
আরও পড়ুন- ৩১ বছর জেল, ১৫৪ বার বেত্রাঘাত! নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী জেল বন্দি মহম্মদির লড়াই অবাক করবে
ঠিক একই সময়ে ডঃ রাভকান লিন-১৪ জিনকে ক্লোন করে ফেললেন। দেখলেন, এই জিন থেকে যে লিন-১৪ আরএনএ তৈরি হল, সে দিব্যি প্রোটিন তৈরি করতে পারছে। রাভকান দেখলেন, সেনরহ্যাবিডিটিস এলিগেন্সের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক স্তরেই লিন-১৪ প্রোটিন তৈরি হয়। কিন্তু যদি সব কিছু স্বাভাবিক থাকে, তখন প্রাণীটি বেড়ে ওঠার শেষের স্তরে লিন-৪ আরএনএ গিয়ে লিন-১৪ প্রোটিনের তৈরি হওয়ার রাস্তাটাই বন্ধ করে দেয়। সে ক্ষেত্রে আর প্রাণীটি অস্বাভাবিক ছোট আকারের হয় না।
রাভকান এ সব কিছু দেখে খুব মজা পেলেন। আরও খতিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন, লিন-১৪ আরএনএ-র একদম শেষ প্রান্তটিকে একদম মুছেই ফেলে লিন-৪ আরএনএ। কিন্তু যত বেশি তাঁরা জানতে পারছেন, ততই যেন বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কিছুতেই বিন্দুগুলিকে জুড়তে পারছেন না। বুঝতেই পারছেন না, এই দুটো অণু, যারা চরিত্রগতভাবে ভীষণ আলাদা, তারা কীভাবে নিজেদের কাজকে প্রভাবিত করছে!
অ্যামব্রোস ও রাভকান দু’জনেই একে-অপরকে পোস্ট ডক্টরেট করার সময় থেকে চিনতেন। বিষয়টা যাই হোক না কেন, ভালো কাজ করতে গেলে একে অপরের সঙ্গে সঙ্গবদ্ধ হতে হয়। তাঁরাও তাই করলেন। নিজেদের আগের সমস্ত ডেটা আরও খতিয়ে বুঝলেন, এই দুইটি আলাদা আলাদা অণুর নিউক্লিওটাইডের ক্রম বেশ খানিকটা জুড়ে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আরএনএ-র ক্ষেত্রে এই নিউক্লিওটাইডগুলি হল অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থিয়ামিন, ইউরাসিল। অ্যাডেনিন জোট বাঁধতে পারে ইউরাসিলের সঙ্গে, আর সাইটোসিন গুয়ানিনের সঙ্গে। ফলে লিন-৪ আর লিন-১৪ এর আরএনএ-এর অনেকটা অংশ একে অপরের সঙ্গে খাপে-খাপে বসতে পারে। আর এভাবেই লিন-৪ বাধা দেয় লিন-১৪ আরএনএ-কে। ফলে সে আর লিন-১৪ প্রোটিন তৈরি করতে পারে না। তাঁরা জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক খুঁজে পান, যা এতদিন সবার অজানা ছিল। লিন-৪-এর মতো প্রোটিনকে তাঁরা স্মল আরএনএ নাম দেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, একটি প্রাণীর দেহ যত জটিল হয়েছে, ততই তাদের দেহে আলাদা আলাদা স্মল আরএনএ-র সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের শরীরেই এক হাজারেরও বেশি আলাদা আলাদা রকমের স্মল আরএনএ জিন রয়েছে। এক-একটি মাইক্রো আরএনএ একাধিক মেসেঞ্জার আরএনএ-এর কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার এক-একটি মেসেঞ্জার আরএনএ-র কাজকে একাধিক স্মল আরএনএ নিয়ন্ত্রণ করে।
মাইক্রো আরএনএ-এর আবিষ্কার ও তার কাজ নিয়ে গবেষণা, ভ্রূণের বেড়ে ওঠা, মানুষের নানা শারীরবৃত্তীয় বিষয়, বিভিন্ন অসুখ, এমনকী ক্যান্সারের জটিলতা বুঝতে পরবর্তীতে অনেক সাহায্য করেছে। যেমন ধরা যাক, ক্যান্সারের মতো জেনেটিক অসুখের নেপথ্যে মাইক্রো আরএনএ-র গুরুত্ব অনেক গভীর। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার সেল যেমন বেড়ে ওঠার আগে নানারকম স্মল আরএনএ-র একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। বিশেষজ্ঞদের আশা, মাইক্রো আরএনএ-কে নিয়ন্ত্রণ করে ভবিষ্যতে অনেক রোগের চিকিৎসা করা সহজ হবে।