মহাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত পদার্থ! কী দিয়ে তৈরি এই ডার্ক ম্যাটার?
Dark Matter of Universe: ডার্ক ম্যাটার মানে এটি যে কালো বর্ণের তা কিন্তু নয়। যে কোনও আলো এদের ভেদ করে যেতে পারে।
সব হিসাব মেলে কি? মেলে না। জীবনের মতো মহাবিশ্বের বেলাতেও বুঝি এই কথা আরও বেশি করে খাটে। এই যে মহাবিশ্বে এত কিছু আছে, গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, এমনকী ব্ল্যাক হোল, এই সব কিছুর সম্মিলিত ভর কত হবে? ওই মেরেকেটে মহাবিশ্বের মোট ভরের পাঁচ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা কিন্ত এই হিসেবের সময় একটা প্রোটন, নিউট্রন, এমনকী কোনও ইলেকট্রনকেও বাদ দেননি। অবাক কাণ্ড না! সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাকি ৯৫% কী আছে তা আমরা কেউই ঠিক করে জানি না। এইখানেই বাঁধে গণ্ডগোল।
হিসেবের এই গলদ প্রথম ধরা পড়ে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। জুইকি নামে এক বিজ্ঞানী সেই সময় ক্লাস্টার বা ছায়াপথগুলোর পাড়া নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখেন, অজস্র ছায়াপথগুলি ক্লাস্টারের কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেইরকম কিছু ছায়াপথের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি দেখেন, ছায়াপথগুলোর গড় গতিশক্তি অত্যন্ত বেশি। তাঁর গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, ক্লাস্টারের সবক'টা ছায়াপথই তাদের মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বেগ নিয়ে ছুটছে। আমাদের পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনও বস্তুর মুক্তি বেগ ১১.২ কিমি প্রতি সেকেন্ড। অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনও বস্তুকে এই বেগে ছোটালে সে মহাকর্ষের মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে যাবে। তাহলেই বোঝা যায়, ছায়াপথ বা গ্যালাক্সিগুলির বেগ কতটা!
পদার্থবিজ্ঞানের চিরাচরিত ধারণা অনুসারে, এত জোরে ছুটে চলা গ্যালাক্সিগুলোর সব ক'টিই এদিক-ওদিক ছুটে চলে যাওয়ার কথা এবং ক্লাস্টারটির কোনও হদিশ এতদিনে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু মজার ব্যপার হলো, প্রায় দশ বিলিয়ন বছর ধরে ক্লাস্টারটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে! সেই থেকে,পদার্থবিজ্ঞানীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এই রহস্যের মোড়ক উন্মোচনের জন্য।
আরও পড়ুন- মহাবিশ্ব মোটা হচ্ছে! এর বয়স কত? যেভাবে মেপেছিলেন এই বিজ্ঞানী
জুইকি কাজ করেছিলেন 'কোমো ক্লাস্টার' নিয়ে। পরবর্তীতে অন্যান্য দিকপালরা দেখলেন আরও অন্যান্য ক্লাস্টারের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। অর্থাৎ গণ্ডগোল তো কিছু একটা হচ্ছেই। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব কি এক্ষেত্রে খাটছে না? আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, নিউটনের তত্ত্বের পরিমার্জিত ও ব্যাপক রূপ? কিন্তু ক্লাস্টারদের মধ্যে মহাকর্ষ বল এখনও এত বিশাল হয়ে ওঠেনি যে আইনস্টাইনের তত্ত্ব ব্যবহার করা যাবে। বিজ্ঞানীরা সেই সময় একটা অদৃশ্য ভরের সম্ভাবনা অনুভব করলেন, তার শনাক্তকরণ সেই সময় অসম্ভব ছিল। বিজ্ঞানীরা সেই পদার্থের নাম দিলেন 'ডার্ক ম্যাটার' বা 'তমোপদার্থ'।
পরবর্তীকালে, ১৯৭৬ সালে বিশিষ্ট জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ভেরা রুবিন ছায়াপথগুলোর ভেতরে এরকম ভরের তারতম্য প্রত্যক্ষ করেন। ক্লাস্টারগুলির মতো ছায়াপথের কেন্দ্রকে ঘিরে নক্ষত্ররা প্রদক্ষিণ করে চলেছে অবিরত। যে নক্ষত্র ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে যত দূরে অবস্থিত, তার বেগ তত বেশি হওয়া উচিত ছিল। দূরের নক্ষত্র ক্রমাগত তাদের গতিশক্তির কারণে কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার ফলে কেন্দ্রমুখী বেগ হ্রাস পাওয়ার কথা। অথচ রুবিন দেখেন নক্ষত্রদের কেন্দ্রাভিমুখী বেগ আগের মতো একই আছে।
সময়রেখা ধরে আমরা যদি একটু পিছিয়ে যাই, ধরা যাক মহাবিশ্ব শুরুর সময়ের অর্ধ মিলিয়ন অর্থাৎ পাঁচ লাখ বছর পরে গেলে দেখতে পাব, তখনকার মহাবিশ্বের পদার্থরা সবেমাত্র বুদবুদের মতো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। এই বুদবুদগুলিই কালক্রমে বড় হতে হতে গ্যালাক্সি, ক্লাস্টার প্রভৃতির রূপ নেবে কিন্ত তার সঙ্গে মহাবিশ্বের আয়তনও বাড়তে থাকবে পাল্লা দিয়ে কারণ হাবল সাহেবের গবেষণা থেকে আমরা জানি, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদিকে আবার মহাকর্ষ চাইছে সবকিছুকে টেনে রাখতে। এই দুই বিপরীত শক্তির মাঝে টানাপড়েন চলছে ক্রমাগত।
আরও পড়ুন- মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্য আবিষ্কার! ৩০,০০০,০০০,০০০ সূর্যকে গিলে খেতে পারে এই দানব!
সাধারণত স্কুলে শেখা অঙ্ক কষলে দেখা যায়, চেনা পদার্থের জন্যে সৃষ্ট মহাকর্ষ বলের সাহায্যে এই অসম লড়াই লড়া সম্ভব নয়। কোথাও যেন একটা বাড়তি ভর লুকিয়ে আছে, তা না হলে এই মহাবিশ্বের কাঠামো এরকম হতো না, আর কোনও নক্ষত্র, ছায়াপথের অস্তিত্বও থাকত না। সেই লুকিয়ে থাকা পদার্থই ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত পদার্থ বা তমোপদার্থ নামে পরিচিত। মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৮ শতাংশ জুড়ে এরা বিরাজমান। ডার্ক ম্যাটার মানে এটি যে কালো বর্ণের তা কিন্তু নয়। যে কোনও আলো এদের ভেদ করে যেতে পারে। এই ডার্ক ম্যাটার কোনও ধরনের বিকিরণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না, এমনকী কোনও আলোতেও এরা দৃশ্যমান নয়।
ডার্ক ম্যাটার দেখতে কীরকম? এর প্রকৃতি কীরকম? অবস্থান কোথায়? এই ধরনের গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন গত এক শতাব্দী ধরে ব্যস্ত করে রেখেছে পৃথিবী বিখ্যাত একঝাঁক দিকপালদের। সার্নে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কণাত্বরক যন্ত্র, লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে বিভিন্ন ধরনের উচ্চ গতিসম্পন্ন কণাদের মাঝে সংঘর্ষে ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত ডার্ক ম্যাটারের কণা আবিষ্কারের চেষ্টা করে চলেছেন। এইসব জটিল পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো সবসময় মাটির নীচে করা হয়, যাতে কোনও অনাকাঙ্খিত মহাজাগতিক কণার হিসাব বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত ফলাফলে না চলে আসে।
আমরা জানি প্রকৃতিতে মোট মৌলিক বলের সংখ্যা চারটি। মহাকর্ষীয় বল, তড়িৎচুম্বকীয় বল, ক্ষীণ বল ও নিউক্লিয়ার স্ট্রং ফোর্স। ডার্ক ম্যাটারকে শনাক্ত করতে গেলে আমাদের আগে জানতে হবে, কোন বিশেষ জাতের বল ক্রিয়া করে তাদের মাঝে। পর্যবেক্ষণভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা এটা প্রমাণিত যে ডার্ক ম্যাটার বাস্তবে আছে কিন্ত তার প্রকৃতি আমাদের অজানা। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণায় খুলে যাবে ১৪ বিলিয়ন বছর ধরে গড়ে ওঠা মহাবিশ্বের বিভিন্ন জট।