আমাদের ভুলে চরম বিশৃঙ্খলা প্রকৃতিতে, ভয়াবহ মাশুল গুণতে হবে, বলছে গবেষণা

মানুষের কার্যকলাপের জন্যে প্রকৃতি ক্রমেই তুমুল বিশৃঙ্খলতার দিকে এগোচ্ছে, এমনই জানাচ্ছে পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অফ পোর্তোর গবেষকদের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা। যেখান থেকে জানা যাচ্ছে, যত সময় এগোবে, প্রকট হবে সেই বিশৃঙ্খলতা।

মেঘনাদবধ কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে ইন্দ্রজিৎ বিভীষণকে বলছেন-

তুমি! নিজ কর্মদোষে হায় মজাইলা এ কণক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!

গবেষণা বলছে, ঠিক এমন জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা, এই মানবসভ্য়তা। মানুষের কার্যকলাপের জন্যে প্রকৃতি ক্রমেই তুমুল বিশৃঙ্খলতার দিকে এগোচ্ছে, এমনই জানাচ্ছে পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অফ পোর্তোর গবেষকদের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা। যেখান থেকে জানা যাচ্ছে, যত সময় এগোবে, প্রকট হবে সেই বিশৃঙ্খলতা।


এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ইউনিভার্সিটি অফ পোর্তোর (University of Porto) পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড: অরফিউ বার্তোলামি (Dr. Orfeu Bertolami) ইন্সক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, "পরিবেশের উপর মানুষের যথেচ্চাচার যদি এই ভাবে চলতে থাকে বা আরও বিরূপ হয়, তাহলে এক সময়ে এসে প্রকৃতি অনিশ্চিত রূপ ধারণ করবে, গণিতের ভাষায় যাকে বলে (পরিবেশের) বিশৃঙ্খল আচরণ (Chaotic behaviour)"।

বিশৃঙ্খলতার মানে রাতারাতি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া নয়, ধরণী দ্বিধা হয়ে যাওয়া নয়। প্রলয় এসে এক মূহুর্তে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এমনটাও নয়। ছন্দপতন হবে তিলে তিলে, আর যতই চরমে পৌঁছবে সেই বিশৃঙ্খলা, এমন একটা মুহুর্ত আসবে যখন মানুষ আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার শক্তিটাই হারিয়ে ফেলবে। বলা ভালো বিপর্যয়ের সামনে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে ফেলবে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকেই নগরায়ণ, শিল্পের প্রসার, বৃক্ষচ্ছেদন প্রভৃতি বেড়েছে। যার প্রভাব যে সরাসরি গিয়ে পড়েছে পরিবেশের উপর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হলোসিন (Holocene) যুগ, যা স্থায়ী হয়েছিলো সুদীর্ঘ বারো সহস্রাব্দ জুড়ে, তার স্থান দখল করল অ্যান্থ্রোপোসিন (Anthropocene) যুগ। হলোসিন থেকে অ্যান্থ্রোপোসিন যুগে রূপান্তর - যাকে আবার বিজ্ঞান, বিশেষত পদার্থবিদ্যার ভাষায় ফেজ় ট্রানজি়শন বলা যায়।

আরও পড়ুন-কেউ অ্যাসিড-আক্রান্ত, কেউ রূপান্তরকামী || বইয়ের বদলে মানুষ পড়া যাবে এই লাইব্রেরিতে

 

"অ্যান্থ্রো",যার অর্থ হল মানুষ বা মানুষ-সম্বন্ধীয়। অ্যান্থ্রোপোসিন বলতে বর্তমান ভৌগোলিক সময়কালকে বোঝায়, যখন পরিবেশ-প্রকৃতি মূলত মানুষের কার্যকলাপের ফলে নিয়ন্ত্রিত হয়। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সিস্টেমের ওপর মানুষের প্রভাব এতই বেশি, বর্তমানে প্রকৃতির চরিত্র ও তার ভবিষ্যত মানুষই নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষের ভবিষ্যত কার্যকলাপের সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায় লজিস্টিক ম্যাপের সাহায্যে।

ল্যান্ডাও-জিনজ়বার্গ থিওরির সাহায্যে হলোসিন থেকে অ্যান্থ্রোপোসিন যুগের যে ভাবে রূপান্তর ঘটেছে, তার গাণিতিক সমীকরণ নির্ণয় করা অনেক সোজা হয়েছে। করেছে, মানুষের আচার-আচরণের ভবিষ্যতদ্রষ্টা লজিস্টিক ম্যাপও।

ড: বার্তোলামির পাশাপাশি, ইউনিভার্সিটি অফ পোর্তোর পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগের আরেক গবেষক এবং সাম্প্রতিকতম এই গবেষণায় অংশ গ্রহণকারী ড: ফ্রেডেরিকো ফ্রান্সিস্কো ২০১৯ -এর একটি গবেষণায় উল্লেখ করেছিলেন, পরিবেশের সার্বিক ভাবে যে পরিবর্তন ঘটছে - যে ভাবে তাপমাত্রার পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, কিংবা বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে - তাকে থার্মোডায়নামিক্স দিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।

সেই ব্যাখ্যার পেছনে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে অহরহ ঘটে চলা শক্তির আদান- প্রদান দায়ী। উদাহরণ হিসেবে তাপশক্তিকেই ধরা যায়, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই শক্তির আদান-প্রদান আমরা বৃহৎ পরিসরে (Macroscale) উপলব্ধি করলেও, তা কিন্তু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পরিসরে (Microscale) ঘটছে বলেই বৃহৎ আকার ধারণ করছে । ঠিক যেমন, পৃথিবীর অগুন্তি স্থানে মানুষের কর্মফলে তাপমাত্রা অল্প-অল্প করে বাড়তে বাড়তে, সার্বিক ভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছেও বটে।

অধ্যাপক বার্তোলামি আরও জানাচ্ছেন, "প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলতা চরমে পৌঁছনোর আগে, প্রকৃতিতে একটি মুহুর্ত আসে, যাকে বলে স্টেবিলিটি পয়েন্ট বাইফারকেশন"। স্টেবিলিটি পয়েন্ট বাইফারকেশন হলে প্রকৃতির সাম্ভাব্য ভবিষ্যত ক্রমাগত দ্বিধাবিভক্ত হয়। ফলে পৃথিবীর বা প্রকৃতির জন্যে অসংখ্য ভবিষ্যত সম্ভাবনা তৈরি হয়। "ঠিক এই অবস্থায়, স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর ভবিষ্যত কী হবে, পুরোটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে", জানাচ্ছেন ড: বার্তোলামি।

আগামী দিনে পৃথিবীর বিশৃঙ্খলতার রূপ কেমন হবে তাহলে?

পৃথিবীর বিশৃঙ্খলতা বাড়ার সঙ্গে বাড়বে আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা, পরিবেশের তাপমাত্রা হবে অসহনীয়, ঝড়ের রূপ হবে আগ্রাসী, কোথাও বন্যা ঘর-বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোথাও বা খরার ফলে ঊষর হয়ে যাবে ভূমি। বাস্তুতন্ত্রের কাঠামো ভেঙে পড়বে দ্রুত, একের পর এক জীবের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। শুধু তাই নয়,আরও কমবে ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর, সমস্যা আরও প্রকট হবে যখন খাদ্য-সঙ্কট পাল্লা দিয়ে বাড়বে, পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে রোগ-সৃষ্টিকারী জীবাণুরা।

আমরা ইতিমধ্যেই খেয়াল করেছি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাপপ্রবাহ কালঘাম ছোটাচ্ছে। আমফান থেকে ইয়াসের মত সাইক্লোনের সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে তারা। সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে ভারতের উপকূলবর্তী এলাকার একের তৃতীয়াংশ তলিয়ে গেছে সমুদ্রের গর্ভে এবং তার কারণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সুন্দরবন অঞ্চল। অন্য দিকে, স্রেফ ভারতেই ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর কমছে প্রতি বছর। মরুপ্রধান বা শুষ্ক দেশগুলির কথা না হয় বাদই দেওয়া হল।

তাহলে কি আমরা ধ্বংসের দিকেই এগোচ্ছি নিশ্চিত ভাবে? এই অবস্থায় পরিবেশ-প্রকৃতিকে কি কোনো ভাবেই আমরা রক্ষা করতে পারব না?

"অবশ্যই এখনও সময় আছে পৃথিবীর বেশ কিছু বাস্তুতন্ত্র এবং জীবকে রক্ষা করার”, ড: বার্তোলামি জানাচ্ছেন, “তবে যে হারে আমরা গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গত করছি বাতাসে, তা ভূমি থেকে সমুদ্র সর্বত্র ক্ষতিসাধন করবে। বাদ পড়বে না মানুষও এবং একদিন জনসংখ্যাও হ্রাস পাবে - ফলে পৃথিবীর বর্তমান যা জনসংখ্যা, তা-ও টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে"।

তিনি আরও জানাচ্ছেন, "প্রকৃতির সেই অপূরণীয় ক্ষতি যাতে আমরা না করি, তাই এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে বড্ড দেরি করে হয়ে যাবে"।

More Articles