আমূল বদল ভারতীয় রেলে, বদলে যাওয়া ইঞ্জিনে পাল্টা হাওয়া রেলসফরে

Indian Railways: দেশ যদি পরিবহণ ক্ষেত্রে আইসি ইঞ্জিন থেকে বৈদ্যুতিক মোটর-চালিত ইঞ্জিনে সুইচ করতে পারে তাহলে তা নিঃসন্দেহে উন্নতির নতুন পথ খুলে দেবে।

ভারতীয়দের লাইফলাইন বলা হয় রেল ব্যবস্থাকে। প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষ যাতায়াত করেন ট্রেনের মাধ্যমে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতকে ১০০ শতাংশ বৈদ্যুতিক যানবাহন বা ইভি সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। ভারতে বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্প একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প এবং বিশেষজ্ঞদের মতে ইভি-ই দেশের ভবিষ্যৎ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি দেশে বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রচার এবং প্রসারের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবহণ ক্ষেত্রে ক্রমশ ডিকার্বনাইজেশনের দিকে এগোচ্ছে দেশ। সেই পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে ভারতে ইভি-র প্রচলনের জন্য বর্তমানে একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে ভারতীয় রেল। আমাদের দেশ যদি পরিবহণ ক্ষেত্রে আইসি ইঞ্জিন থেকে বৈদ্যুতিক মোটর-চালিত ইঞ্জিনে সুইচ করতে পারে তাহলে তা দেশের পক্ষে নিঃসন্দেহে উন্নতির নতুন পথ খুলে দেবে। এই মর্মে একটি কালজয়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় রেল। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতীয় রেল তার মালিকানাধীন বা ভাড়া নেওয়া বা লিজপ্রাপ্ত ইন্টারনাল কম্বাসশন ইঞ্জিন (আইসিই) গাড়িগুলিকে সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক যানবাহন বা ইভি দ্বারা প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বলাই বাহুল্য, এই নীতি প্রণয়ন করার জন্য বিভিন্ন স্টেশনে চার্জিং স্টেশন থেকে শুরু করে পার্কিং লটের ডিজাইনের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা যেতে চলেছে। বিদেশে অনেক জায়গায় বর্তমানে ট্রেনের মধ্যে আইসিই-র বদলে ইভি ব্যবহার করা হয়। সেরকম আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে ভারতীয় রেলকে সারা দেশজুড়ে কমপক্ষে ৪৬ হাজার চার্জিং স্টেশন বসাতে হবে। এর জন্যে রেলপথটি ব্রডগেজ ট্র্যাকের ১০০ শতাংশ বিদ্যুতায়ন এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। গত ৭ অক্টোবর প্রকাশিত প্রস্তাবে রেলওয়ে এমনটাই প্রস্তাব দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে, রেলওয়ে জানিয়েছে যে রেলওয়ে বোর্ড, জোনাল অফিস-সহ অন্যান্য ইউনিটে ব্যবহৃত সমস্ত আইসিই যানবাহন প্রতিস্থাপিত করে ইভি ব্যবহার করা শুরু হবে শীঘ্রই।

ভারতীয় রেলের প্রস্তাবিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ২০ শতাংশ, ২০২৪ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ এবং ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ ইভি চার্জিং স্টেশন বসানো হবে। ভারতীয় রেলের তরফে জানানো হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব মেগাসিটিগুলিতে (যেই শহরের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষের বেশি) এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব বড় শহরগুলিতে (যেই শহরের জনসংখ্যা ১০ লক্ষের বেশি), ইভি চার্জিং স্টেশন লাগিয়ে দেওয়া হবে। এর পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রয়োজন অনুসারে ইভি চার্জিং স্টেশন লাগানো হবে।

আরও পড়ুন: মাতৃদুগ্ধেও পাওয়া গেল প্লাস্টিকের কণা! কতটা নিরাপদ আপনার শিশু

তবে এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, রেললাইন এবং অন্যান্য ইউনিটগুলি পরিদর্শন করার জন্য যে যানবাহন গুলি ব্যবহার করা হয় সেগুলিকে আপাতত ইভি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে না। ভারতীয় রেলের তরফে জানানো হয়েছে ওই যানবাহনগুলিকে অন্তত আগামী ৩ বছর তো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। কেন না পরিদর্শনের জন্য অনেক সময় যানবাহনগুলিকে নিয়ে দূর-দূরান্তের অঞ্চলে যেতে হয় আধিকারিকদের। সেই সমস্ত প্রত্যন্ত জায়গায় যদি চার্জিং পরিকাঠামো না থাকে তাহলে ইভি নিয়ে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না।

তবে শুধুমাত্র ইন্টারনাল কম্বাসশন ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেই নয়, রেলওয়ে ইলেকট্রিক্যাল যানবাহনের জন্য চার্জিং স্টেশন বানাতে উদ্যোগী। ভারতে ইভি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা চার্জিং পরিকাঠামোর অভাব। জানা যাচ্ছে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্যে রেলওয়ে প্ল‍্যাটফর্ম প্রাঙ্গণে ইভি বা বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহার কারীদের জন্য চার্জিং স্টেশন বানাতে চলেছে ভারতীয় রেলওয়ে। ভারতীয় রেলের তরফ থেকে ইতিমধ্যেই জোনাল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারদের তাদের কর্মীদের সঙ্গে মিটিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন কোন জায়গায় চার্জিং স্টেশন তৈরি করা হবে, অফিস কমপ্লেক্স এবং স্টেশন চত্বরে চার্জিং স্টেশনে কিভাবে বানানো হবে, সেক্ষেত্রে পার্কিং লটের ডিজাইন কেমন হবে - ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শীঘ্রই মিটিংয়ে বসতে চলেছেন জোনাল অফিসাররা। বলাই বাহুল্য, কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের জারি করা সেফটি গাইডলাইন মেনেই চার্জারগুলি ইনস্টল করা হবে।

বৈদ্যুতিক যানবাহন বা ইভি-র জন্য চার্জিং স্টেশন তৈরির ক্ষেত্রে চার্জিং পয়েন্ট অপারেটরদের (সিপিও) নিয়োগ করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। চার্জিং পরিকাঠামো ব্যবহার করার জন্য রেলওয়ে দ্বারা একটি নির্দিষ্ট পার্কিং ফি ধার্য করা হবে। এই চার্জিং পয়েন্ট অপারেটররা সকল ব্যবহারকারী অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ইভি চার্জিং পয়েন্ট গুলি ব্যবহার করতে পারেন। ডিজিটাল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেনের প্রচার করতে ভারতীয় রেলওয়ের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে চার্জিং করার পর যে টাকাটি দিতে হবে তা সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে হবে।

ভারতে যদি বৈদ্যুতিক যানবাহন (Electrical Vehicle) পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করতে হয় তাহলে চার্জিং স্টেশনের প্রয়োজন হবে। কোন সময়ের মধ্যে কতটা চার্জিং স্টেশন বানানো হবে তার একটা মোটামুটি রোডম্যাপ ভারতীয় রেলওয়ে প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ইভি গুলি চার্জ হবে কিভাবে ? কেননা যদি বিদ্যুতের মাধ্যমেই চার্জিং করাতে হয় তাহলে ইভি বাজারে আনার মূল উদ্দেশ্যটিই খর্ব হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ভরসা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি। বর্তমানে ভারতবর্ষে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির অবস্থা কেমন ? বর্তমানে ভারতের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদিত হয়। এমন ভাবেই চলতে থাকলে মনে করা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৫৩ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদিত হবে। তবে আশার আলো আছে, বিশেষজ্ঞদের মতে সেই পরিস্থিতি তৈরি হবার আগেই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনে ভারত যথেষ্ট সাবলীল হয়ে উঠবে। কেননা এই বছর দেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ২০ গিগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে বায়ু শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারত বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিশ্বে ভারতের স্থান সপ্তমে। মোটামুটি বলতে গেলে বর্তমানে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ভারতে ঠিকঠাক পরিমাণেই হচ্ছে। কিন্তু এত বড় জনসংখ্যার দেশের সকল ইভি চার্জ করাতে হলে যেই পরিমান শক্তি প্রয়োজন তা উৎপাদন করা এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

এই তো গেল পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির কথা। তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে আইসি ইঞ্জিন সরিয়ে এই ইভি আনার উদ্যোগ কিন্তু নিয়েছে ভারতীয় রেল। সারা ভারতের কয়েক কোটি মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন ট্রেনের মাধ্যমে। তারমধ্যে অনেকেই পরিষেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ করে থাকেন। অভিযোগের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। আজও মানুষ রেলের পাতলা ট্যালট্যালে ডাল নিয়ে মিম বানায়। অপর পক্ষে রেলের বেসরকারিকরণ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিঃসন্দেহে ভারতীয় রেল ইভি এবং ইভি চার্জিং স্টেশনের যা পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে অনেকাংশে লাভবান হবেন মানুষ। একইসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে বর্তমান আবহে, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তা কতটা গ্রহণযোগ্য মানুষের কাছে।

More Articles