আর প্রধানমন্ত্রী নন ইমরান, কেন এত বড় সঙ্কট পাকিস্তানে

গোটা দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে নিয়েই আজ দ্বিখণ্ডিত দেশ। ২২ গজ থেকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি—খেলার মাঠের মতোই কালঘাম ছুটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে (Pakistan Political Crisis) হারতে হারতে জিতে গিয়েও ‘বাজিগর’ হয়ে ওঠা হল না ইমরান খানের (Imran Khan)। কৌশলে আস্থাভোট বানচাল করে দিতে পেরেছেন বটে তিনি। নতুন করে নির্বাচনের আগে তিন মাস সময়ও বার করে ফেলেছেন নিজের জন্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে গায়ের জোরে সংবিধান লঙ্ঘনে অভিযুক্ত হলেন তিনি। একই সঙ্গে পূর্বসূরিদের মতোই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারা প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় সামিল হতে হল।

চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট, লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি (Pakistan Inflation), সরকার বিরোধী বিক্ষোভে বিগত কয়েক মাস ধরেই একটু একটু করে তেতে উঠছিল পাকিস্তান। ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অপশাসন, সরকারি কোষাগারের টাকা অপ্রয়োজনে খরচের অভিযোগে সরব হতে শুরু করেন দেশবাসী। প্রাথমিক পর্যায়ে পেট্রল-ডিজেলের শুল্ক করে কমিয়ে ক্ষোভ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন ইমরান। কিন্তু বিক্ষোভের আঁচ চাপা দেওয়া যায়নি তাতেও। বরং একে একে বিশ্বস্তরা ইমরানের সঙ্গত্যাগ করতে শুরু করেন। বিরোধী শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভকে আরও তাতিয়ে তোলেন।

তারই ফলস্বরূপ গত ৮ মার্চ ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব (No Trust Motion) জমা পড়ে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর রবিবার, ৩ এপ্রিল দেশের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ভোটাভুটি (Trust Vote) হবে বলে ঠিক হয়। সেই মতো অধিবেশন শুরু হলেও এই ভোটাভুটিকে দেশের সংবিধান এবং পাকিস্তানের নীতির পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে আস্থাভোট বাতিল করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। রবিবারের অধিবেশনে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না ইমরান। আস্থাভোট বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ভিডিও বার্তায় অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের ডাক দেন তিনি।

পাকিস্তান সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, অ্যাসেম্বলিতে আস্থাভোট বাতিল হয়ে যাওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট আরিফ আলির সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন ইমরান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং আইনি পরামর্শদাতারাও। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক সেরেই ইমরান ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন এবং তার কয়েক মুহূর্ত পরই প্রেসিডেন্ট অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেন এবং নতুন করে নির্বাচনের জন্য তিন মাসের সময় বেঁধে দেন বলে খবর। ভোটাভুটি বাতিলের সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে ডেপুটি স্পিকার দেশের সংবিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদটির উল্লেখ করেন, যাতে বলা রয়েছে— ১) রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য, ২) পাকিস্তানের নাগরিক পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, সঙ্কটের সময় দেশের সংবিধান এবং আইন মেনে চলতে বাধ্য তাঁরা। পাকিস্তানের মাটিতে থাকাকালীন অন্য যে কারও ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

কিন্তু এই যুক্তি ধোপে টিকছে না বিরোধীদের কাছে। তাঁদের অভিযোগ, ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে সংবিধান এবং আইনের প্রতি আনুগত্যের কথা বলা রয়েছে। সেই নিরিখে আস্থাভোট গণতন্ত্রেরই অংশ। অনাস্থা প্রস্তাব যখন পেশ হয়ে গিয়েছে অ্যাসেম্বলিতে, ভোটাভুটি হবে বলে শীর্ষ আদালতে কথা দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল, তার পরেও আস্থাভোট বাতিল করে ইমরান সরকার দেশের সংবিধানকেই লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। পাকিস্তানের আইনি বিশেষজ্ঞরাও সে ব্যাপারে একমত। আর তারই ফলস্বরূপ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বিষয়টি গ্রহণ করেছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট (Pakistan Supreme Court)। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান তথা দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাবল ভুট্টো জারদারি সাফ জানিয়েছেন, তাঁদের আইনজীবীরা বিষয়টি নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। যে কোনও  মূল্যে দেশের সংবিধানকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর তাঁরা।

আরও পড়ুন-প্রতি ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ভারতে! প্রতি চার মিনিটে একটি মৃত্যু!

দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আবার লন্ডন থেকে সরাসরি ইমরান এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সংবিধান অবমাননার দায়ে কড়া শাস্তির দাবি তুলেছেন তিনি। এর পরই সুপ্রিম কোর্টে নিজেদের তরফে পিটিশন জমা দিতে ছোটে ইমরান সরকার। সোমবার বিষয়টি নিয়ে শুনানি রয়েছে। তার আগে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বিমুক্ত করা হয়েছে ইমরানকে। অর্থাৎ কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আগামী ১৫ দিন নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন ইমরান। তবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না তিনি। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, ৩৪২ আসনের অ্যাসেম্বলিতে সরকার টিকিয়ে রাখতে ১৭২ আসন থাকা চাই। জোট সরকারে শরিক মুত্তাহিদা কাউমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান গত ৩০ মার্চই সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই ইমরান সরকারের। তাই পরাজয় নিশ্চিত জেনেই অসাংবিধানিক ভাবে আস্থাভোট বাতিল করা হয়।

কিন্তু সাড়ে তিন বছর আগে ‘জব লিডার আওয়ামি, ফির ক্যায়সি গুলামি’ রব তুলে ক্ষমতায় আসা ইমরানকে আজ মসনদ টিকিয়ে রাখতে কেন ছড়ি ঘোরাতে হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা ইমরান, গোটা পাকিস্তানকে একসুতোয় বেঁধে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ইমরান আজ এইসন্ধি ক্ষণে এসে উপস্থিত হলেন কী ভাবে, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক—

• ক্রিকেট জীবনে সক্রিয় থাকাকালীনই রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন ইমরান। নওয়াজ শরিফ নিজে তাঁকে দলে পেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে নিজের দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (Pakistan Tehreek-e-Insaf)-এর সূচনা করেন ইমরান, যার অর্থ হল ন্যায় বিচারের দাবিতে গণ আন্দোলন।

• ২০০২ সালে ভোটে জিতে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যতা পান ইমরান।

• ২০১৩ সালে ফের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রবেশ ঘটে।

• ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভ করে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইমরান।

• ২০২১-এর ৩ মার্চ বিরোধী নেতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রজা গিলানি ইমরান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবদুল হাফিজ শেখকে সেনেট নির্বাচনে পরাজিত করেন।

• অর্থমন্ত্রীর পরাজয়ের পর ২০২১-র ৬ মার্চ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আস্থাভোটে জয়ী হন ইমরান।

• ২০২২-এর ৮ মার্চ বিরোধী শিবির ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য তাঁর সরকারকে দায়ী করে।

• ২০২২-এর ১৯ মার্চ নিজেদের শিবিরে বিদ্রোহী নেতাদের শো-কজ নোটিস ধরায় ইমরানের দল।

• ২০ মার্চ অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ডাকেন স্পিকার।

• ২৫ মার্চ অ্যাসেম্বলিতে ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হয়।

• ২৩ মার্চ ইমরান জানিয়ে দেন, কনও মতেই ইস্তফা দেবেন না তিনি। তত ক্ষণে তাঁর বিরুদ্ধে ভোটদানের ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেছে তিন শরিক দল।

• ২৫ মার্চ অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার আগেই ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায়।

• ২৭ মার্চ লহৌর, ইসলামাবাদ, কারচি-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকার বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। বিদেশি শক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হটানোর চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন ইমরান।

• পিএমএল-এন সভাপতি শেহবাজ শরিফ ইমরান খানের বিরুদ্ধে অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন।

• আস্থাভোটের আগে ৩০ মার্চ ইমরানের শরিক সব দল বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় ইমরান সরকার।

• ৩১ মার্চ অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে অ্যাসেম্বলিতে তর্ক—বিতর্ক।

• ১ এপ্রিল ইমরান জানান যে, তাঁকে খুনের চেষ্টা চলছে। তিনি কাউকে ভয় পান না। স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন।

• ৩ এপ্রিল অ্যাসেম্বলিতে আস্থাভোট শুরু হতে গেলে বাতিল করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। ইমরান খানের নির্দেশে অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরানের বিমুক্তি।

More Articles