বিক্ষোভ-প্রতিবাদের নয়া হাতিয়ার এখন 'বীরুগিরি'! এলাকায় ট্যাঙ্ক দেখলেই ভয়ে কাঁপছে পুলিশ
Virugiri, Tool Of Protest: প্রশাসনের টনক নড়াতে বাসিন্দাদের অস্ত্র তাই বীরুগিরি! বহু সময়েই নিজেদের অসুবিধা জানাতে ওই ট্যাঙ্কের মাথায় চেপে বসেন গ্রামবাসীরা। তাতে আর কিছু হোক বা না হোক, পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তারা ছুটে আসব...
গ্রামের প্রান্তে এক আকাশছোঁয়া জলের ট্যাঙ্ক। বেশিক্ষণ তাকাতে গেলে ঘাড় টনটনিয়ে ওঠে, এমনই উঁচু সে। গ্রীষ্মের রোদ-ঝলসানো দুপুরে সেই গগনচুম্বী ট্যাঙ্কের মাথায় উঠে বসেছে এক যুবক। সামান্য মত্ত সে, অপ্রকৃতস্থও কি! রামগড়ের সমস্ত মানুষ জড়ো হয়েছে সেই ট্যাঙ্কের তলায়। আজ কি তবে একটা এস্পার ওস্পার হয়েই যাবে! ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ । ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে যুবকের চিৎকার- 'সুসাইড করুঙ্গা।' আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্তু প্রেমের আগুন আর রূপালি পর্দার জৌলুসে সেই 'মহাপাপ' কেমন যেন রূপকথার গল্প হয়ে যায়। স্থানীয় টাঙ্গিওয়ালা বাসন্তির প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক মানতে নারাজ বাসন্তির অভিভাবক তথা তাঁর সবেধন নীলমণি মাসি। মাসিরও নীলমণি ওই বাসন্তীই। ফলে তিনি একটু বেশিই সতর্ক। যার তার হাতে মেয়েকে দেবেন কেন! তবে ছাড়বার পাত্র নয় বীরু। তিনিও শেষ দেখে ছাড়বেন। ব্যস, উঠে পড়লেন ট্যাঙ্কের এক্কেবারে মাথায় নিজের প্রেম জাহির করা এবং সেই প্রেমের বিরুদ্ধে যারা, তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এমন সহজ পন্থা আর কী-ই বা খোলা ছিল যুবকের কাছে।
এতক্ষণ যা বললাম, সবই সিনেমার গল্প। যে সে সিনেমা নয়। সর্বকালের সেরা হিট, কার্যত কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া সিনেমা- শোলে। যেখানে গল্প আবর্তিত হয়েছে রাজস্থানের ছোট্ট গ্রাম রামগড়কে কেন্দ্র করে। এ গল্পে দুর্ধর্ষ দুশমন আছে, দুশমনকে জব্দ করা আছে। প্রেম আছে, জব্বর বন্ধুত্ব আছে। তবে রামগড়বাসীর কাছে এই ছবি দিয়ে গিয়েছে জোরদার এক অস্ত্র। প্রতিবাদের ভাষা বলতে পারেন। রমেশ সিপ্পি পরিচালিত শোলে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। যেখানে গ্রামের ট্যাঙ্কের মাথায় উঠে সামান্য কয়েকটা সংলাপের জোরে মাসির কাছ থেকে বাসন্তীকে জিতে নিয়েছিল প্রেমিক-যুবক বীরু। আর সেই দৃশ্যই যেন রাজস্থানের হনুমানগড় ও শ্রীগঙ্গানগরের বাসিন্দাদের মনে রেখে গিয়েছে গভীর ছাপ। তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছে প্রতিবাদের এক আশ্চর্য ভাষা।
আরও পড়ুন: আজও সেরা ছবির তালিকায় ‘পথের পাঁচালী’, ‘শোলে’! কতটা ক্ষতি হচ্ছে ভারতীয় সিনেমার
এই হনুমানগড় ও শ্রীগঙ্গানগরের মাঝামাঝি এলাকায় রয়েছে একাধিক সুউচ্চ জলের ট্যাঙ্ক। শোলে সিনেমার সেই কিংবদন্তি দৃশ্যের কথা মাথায় রেখছে সেই সব গ্রামের মানুষ। গ্রামবাসীদের কাছে ওই ট্যাঙ্কগুলি পরিচিত বীরুগিরির জন্য। হবে না-ই বা কেন! ওই ট্যাঙ্কগুলিই যে তাঁদের কাছে প্রতিবাদের হাতিয়ার এবং প্রতিবাদের মঞ্চও। আজ থেকে নয়, এই ব্যাপারটি চলে আসছে বিগত ২৫-৩০ বছর ধরে। আগে হনুমানগড় আর শ্রীগঙ্গানগর ছিল একটিই জেলা। ১৯৯৪ সালে ভেঙে দুটি জেলা করা হয় তাকে। সম্প্রতি গত অগস্ট মাসে শ্রীগঙ্গানগর ভেঙে তৈরি হয়েছে অনুপগড় নামে আরও একটি জেলা। ফলে প্রশাসনিক ভাবে শ্রীগঙ্গানগর ভেঙে তিন টুকরো তো হয়েছে, কিন্তু এলাকার মানুষের রোজের সমস্যা মেটেনি এক ফোঁটাও। আজও নানাবিধ অসুবিধা লেগেই থাকে সম্বৎসরব্যাপী। কখনও পানীয় জল সরবরাহে বিঘ্ন তো, কখনও রেশন পেতে দেরি। কখনও বা একটু বৃষ্টিতেই বানভাসি গ্রাম অথচ সেচের কাজে জল অমিল।
এ সব নিয়ে নানাভাবে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয় না। সাধারণ মানুষের কথা শোনার কেউ নেই। যেমনটা কোথাওই থাকে না! রাজস্থানের এইসব প্রত্যন্ত জেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রশাসনের টনক নড়াতে তাঁদের অস্ত্র তাই বীরুগিরি! বহু সময়েই নিজেদের অসুবিধা জানাতে ওই ট্যাঙ্কের মাথায় চেপে বসেন গ্রামবাসীরা। তাতে আর কিছু হোক বা না হোক, পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তারা ছুটে আসবে ঠিকই। আর নিজেদের অভাব-অভিযোগ পৌঁছে দেওয়ার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কী-ই বা হতে পারে।
গত অগস্টেই ঘটেছিল এমন ঘটনা। স্থানীয় কাউন্সিলর লক্ষ্মণ গোয়েলের নেতৃত্বে গত সতেরো দিন ধরে মিউনিসিপ্যাল অফিসের সামনে ধর্না দিয়েছেন পিলিভাঙা এলাকার বাসিন্দারা। নিকাশিব্যবস্থার উন্নতি ও মিউনিসিপ্যালিটির দুর্নীতি শেষ করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে ব্রহ্মাস্ত্র ধরতে বাধ্য হন তাঁরা। গ্রামের কয়েকজনকে নিয়ে গয়াল উঠে পড়েন সেই 'বীরুগিরি' ট্য়াঙ্কের মাথায়। সাধে কি বলে অব্যর্থ দাওয়াই। অমনি পড়ি কি মরি করে ছুটে এলেন সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট থেকে তহসিলদার, থানা থেকে ছুটে এলেন কর্তা ব্যক্তিরা। দু'তরফের বেশ খানিক্ষণের দর কষাকষির পরে হার মানলেন প্রশাসনিক কর্তারা। মিউনসিপ্যালিটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে স্পেশাল অডিট করার প্রতিশ্রুতি লিখিত আকারে পেয়ে তবেই ওই ট্যাঙ্কের মাথা থেকে নামলেন গয়াল ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা।
হনুমানগড়, শ্রীগঙ্গানগরও অনুপগড় জেলায় শতাধিক জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে। যার বেশিরভাগই এখন বিক্ষোভের জায়গা। প্রায় প্রতি মাসেই ট্যাঙ্ক-বিক্ষোভের সাক্ষী থাকছে ওই তিন জেলা। কখনও ছাত্র ইউনিয়নের ভোট হচ্ছে না বলে প্রতিবাদ, তো কখনও জমি জবরদখল নিয়ে ক্ষোভ, কিংবা কৃষকদের আন্দোলন, সমস্ত বিক্ষোভ-প্রতিবাদের একমাত্র জায়গা এখন ওই সব ট্যাঙ্কের মাথা। কেউ কেউ তো আবার পতাকাও নিয়ে যান ঘাড়ে করে। কেউ সেচের জল পাচ্ছেন না বলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। কেউ জলসঙ্কটের প্রতিকার চাইছেন। কিছুদিন আগে তো এক মহিলা তাঁর কন্যা-সহ চেপে বসেন ট্যাঙ্কের মাথায়। দাবি, তাঁদের বাড়ি যেসব দুষ্কৃতিরা ভেঙেছে তাদের শাস্তি চাই। কেউ কেউ তো ধারশোধ চেয়েও চেপে বসছেন ট্যাঙ্কের মাথায়।
আরও পড়ুন: ফলের দোকান থেকে বলিউডের শেষ কথা! ধাপে ধাপে যেভাবে তৈরি হয়েছে টি-সিরিজের সাম্রাজ্য
এদিকে জেলাময় এই বিরুগিরির দাপটে প্রাণ ওষ্ঠাগত পুলিশের। এতদিন চোর-গুন্ডা ধরার কাজ ছিল, তার উপর জুটেছে লোককে ট্যাঙ্ক থেকে নামানোর কাজ। প্রায়শই ছুটতে হচ্ছে প্রশাসনিক কর্তাদেরও। সিনেমায় যতই ভালো দেখাক না কেন! বিক্ষোভ দেখানোর জন্য ট্যাঙ্ক মোটেও সুরক্ষিত জায়গা নয়। একবার এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ, দেহের চিহ্নটুকু খুঁজে পাওয়া যাবে না অত উঁচু থেকে পড়লে। ফলে সব সময় সজাগ থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। এই বুঝি বীরুগিরির খবর এল। বারবার চেষ্টা করে মানুষের এই প্রবণতাকে রুখতে পারেনি জেলাপুলিশ। মাঝখানে স্থানীয় জলের ট্য়াঙ্কগুলি থেকে সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাতেও কি সমস্যা মিটেছে পুরোপুরি। এ ধরনের প্রবণতা কমাতে আইনের সাহায্য় নিচ্ছে এখন পুলিশ। ট্যাঙ্কের মাথায় উঠলেই মিলবে শাস্তি, দিতে হতে পারে জরিমানা, এই মর্মে জারি করা হয়েছে নোটিসও। তার পরেও নিজেদের দাবি তুলে ধরার এম অব্যর্থ অস্ত্রকে নামিয়ে রাখতে মোটেই রাজি নন 'শোলে'-প্রিয় এই তিন জেলার মানুষ। বীরুগিরি তাই চলছে আপন ছন্দে ও আনন্দে।