সারা শরীরে ২৬টি আঙুল! দেবতার জন্ম দেখছে রাজস্থান, আসল ব্যাপারটা কী?

Polydactyly: ১৪টি হাতের আঙুল এবং ১২টি পায়ের আঙুল নিয়ে এই শিশুটি জন্মেছে রাজস্থানের ভারতপুরে। পরিবার থেকে প্রতিবেশী, সকলেই একপ্রকার বিশ্বাস করে নিয়েছেন যে এ মানবশিশু নয়।

প্রতিটি হাতে সাতটি করে আঙুল, আর পায়ে ৬টি করে। দু'হাত মিলিয়ে ১৪টি আঙুল আর পায়ে মোট ১২টি। রাজস্থানে জন্মেছে এমনই আশ্চর্য শিশু। 'এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়'! শরীরে অতিরিক্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মানো অস্বাভাবিক শিশুকে দেবতার আসনে বসিয়ে দেওয়া এ দেশে নতুন কোনও বিষয় নয়। শুধু মানবশিশুই বা কেন! প্রায়শই দেখবেন অস্বাভাবিক অঙ্গ নিয়ে জন্মানো বাছুরকেও ছোট ম্যাটাডোরে সাজিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে অনেকে। ভক্তির বন্যা ছোটে। প্রণামীর বাক্স ভরে ওঠে দক্ষিণায়।

অথচ সকলেই কোথাও না কোথাও জানেন না। দেবত্ব, ঈশ্বরত্ব আসলে বাজে কথা। জিনগত তারতম্য বা অন্য কোনও শারীরিক বিভ্রাটেই আর পাঁচজন শিশুর মতো করে গড়ে ওঠেনি ভ্রূণটি। কখনও কখনও মাতৃগর্ভে যমজ ভ্রূণের একটি অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় ভ্রূণটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেড়ে উঠতে থাকে প্রথম জনের শরীরেই। পরজীবীর মতো প্রথম ভ্রূণের শরীর আঁকড়ে ধরে সেটি। তাদের আলাদা করা যায়না সাধারণ ভাবে। বাঁচতে গেলে এই ধরনের শিশুটির অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রয়োজন অস্ত্রোপচারের।

আরও পড়ুন: মায়ের গন্ধ, হারানো মানুষের গন্ধ সত্যিই আলাদা? শরীরের গন্ধ দিয়ে কীভাবে মানুষ চেনা যায়?

কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটে না। হয় পরিবার, সমাজ তাদের উপর দেবত্ব আরোপ করে, নয়তো তাদের ঠাঁই হয় সার্কাসের তাবুতে। আশ্চর্য সেই শরীর কোনও না কোনও ভাবে হয়ে ওঠেই টাকা উপার্জনের জায়গা। কখনও দেবতা তো কখনও জোকার, এই ধরনের 'স্পেশাল' শিশুর ভবিষ্যৎ ঝুলতে থাকে মানুষের ভক্তি কিংবা বিনোদনের উপরে।

১৪টি হাতের আঙুল এবং ১২টি পায়ের আঙুল নিয়ে এই শিশুটি জন্মেছে রাজস্থানের ভারতপুরে। পরিবার থেকে প্রতিবেশী, সকলেই একপ্রকার বিশ্বাস করে নিয়েছেন যে এ মানবশিশু নয়। কোনও দেবতা, কোনও ঈশ্বরের পুনর্জন্ম হয়েছে নিশ্চয়ই তাঁদের ঘরে। শুরু হয়ে গিয়েছে পুজোআচ্চা।

চেনা চেনা লাগছে না ছবিটা? কিছুদিন আগেই এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর ছবি বানিয়ে ফেলেছিলেন পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি। 'লক্ষ্মীছেলে' ছবিতে আমরা দেখেছি, প্রত্য়ন্ত ধাঙর গ্রামে জন্মানো এক চার হাতওলা কন্যাসন্তানকে। যাকে সমাজ মেনেছে দেবী লক্ষ্মী হিসেবে। যে ধাঙর গ্রামের ছায়াটুকু মাড়াতো না উচ্চবর্ণ মানুষেরা, সে গ্রাম থেকে এখন তাদের সরানো কঠিন। ছোট্ট মেয়েটিকে ঘিরে বসে গিয়েছে বিরাট মেলা, সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত সমাগম। যে ভিড়, ধূপধুনোর নিচে চাপা পড়ে যায় শিশুটির জ্বর, উচ্চস্বরে কান্না। আর সেই চাপা কান্নার উপরে গড়ে ওঠে কারওর রাজনৈতিক কেরিয়ার, মন্দির গড়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন। আখের ঠিকই গুছিয়ে নেয় কয়েকজন সুযোগসন্ধানী মানুষ। এমনটা আখছাড় ঘটে। গ্রামেগঞ্জে তো বটেই, শহরেও ঘটে।

যে দেশে পাথরের দেবতা হতে সময় লাগে না, যে দেশে গণেশকে দুধ খাওয়াতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, যে দেশে ধর্মের নামে একে অন্যকে মারতে-কাটতে দু'বার ভাবে না কেউ, সে দেশে এ আর এমন কী কথা। পুরনো সার্কাসের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অনেক শিল্পী বা পারফর্মারকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের শরীরে এমন অসঙ্গতি ছিল। সেই অসঙ্গতিই হয়ে উঠত সার্কাসের ইউএসপি। শুধু ভারতে বলে নয়, এ রীতি প্রচলিত ছিল গোটা বিশ্ব জুড়ে। তবে শারীরিক অসঙ্গতিপূর্ণ শিশুকে দেবতা বানিয়ে তোলার চর্চা যে এ দেশে কিঞ্চিৎ বেশি, তাতে সন্দেহ নেই।

রাজস্থানের শিশুটিকে ঈশ্বর ভেবে হইচই পড়ে গেলেও চিকিৎসকেরা কিন্তু এক বাক্যে নাকচ করেছেন এই ধরনের দেবতার পুনর্জন্ম মার্কা বুজরুকি তত্ত্ব। এই ধরনের অস্বাভাবিক সংখ্যক আঙুল নিয়ে জন্মানোকে তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলছেন পলিড্যাক্টিলি।

ব্যাপারটা কী? সহজ কথায় বললে এক ধরনের জিনগত অসুখ। যেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সংখ্যক আঙুল নিয়ে জন্মায় শিশুরা। বহু সময়েই এই সমস্যা বংশপরম্পরায় জিনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের শরীরে ছড়াতে থাকে। সাধারণ ভাবে এই আঙুলগুলি স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট হয়। এবং এগুলো বাড়েও অস্বাভাবিক ভাবে। রাজস্থানের এই শিশুটি জন্মেছিল আট মাসের মাথায়। তবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছে, এই ধরনের অতিরিক্ত আঙুল একেবারেই বিপজ্জনক নয়।

আরও পড়ুন:বেশি অথবা কম ঘুম দুইই কাল হতে পারে শরীরের! জানেন সুস্থ থাকতে কোন বয়সে কতটা ঘুম জরুরি?

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যে কোনও সদ্যজাত শিশুই এই পলিড্যাক্টলি নিয়ে জন্মাতে পারে। আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের শিশুর মধ্যেই বেশি সংখ্যায় দেখা যায় এই সমস্যা। আদতে গর্ভে বেড়ে ওঠার সময় জিনগত সমস্যার কারণেই এই ধরনের অসঙ্গতি শরীরে বেড়ে ওঠে। একটি রিপোর্ট বলছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়। অনেকেই জানেন, বলিউড তারকা হৃত্বিক রোশনও এই পলিড্যাক্টলির শিকার। তবে তার সুপারস্টার হওয়ার পথে কোনও দিনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আঙুলের অসঙ্গতি। কোনওদিন সে ব্যাপারটিকে পর্দায় লুকানোরও চেষ্টা করেননি হৃত্বিক।

তবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চাইলেই অতিরিক্ত আঙুল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাদ দেওয়া সম্ভব হাত এবং পা থেকে। খুবই সহজ সেই অস্ত্রোপচার। তবে সমস্যাটা বেধে যায়, সমাজ এবং পরিবারের দ্বারা এই ধরনের দেবত্ব আরোপে। এর ফলে শিশুটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। নষ্ট হয়ে যায় শৈশব। ২০২৩ সালে পৌঁছেও সেই কুসংস্কারের অন্ধকার তাড়ানো যায়নি দেশ থেকে। ভারত ডিজিট্যাল হয়েছে, আত্মনির্ভর হয়েছে। কিন্তু দেশ রয়েছে সেই তিমিরেই। আর সেঅ অন্ধকারে আলো আসতে বোধহয় আরও একশো বছর কেটে যাবে।

More Articles