স্পষ্ট যুক্তি, ঠান্ডা মাথা! হৃদয় জিতলেন দেবাশিস, অনিকেত, শতরূপারা
Junior Doctor's at Nabanna Meet: কার্যত ঠান্ডা মাথায়, শান্তভাবে, স্পষ্ট কথায় একের পর এক নিজেদের দাবি একঘর লোকের সামনে তুলে ধরলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
জুনিয়র ডাক্তারদের আমরণ অনশনের ১৭তম বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নে আয়োজন হয়েছিল বৈঠকের। আন্দোলনকারীদের অবাক করে এদিন নবান্নের বৈঠকে ছিল লাইভ স্ট্রিমিংয়ের ব্যবস্থা। অথচ এর আগে এই লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবি একাধিক বার জানালেও তাতে আমল দেয়নি নবান্ন। একাধিক বার বৈঠক না করেই খালি হাতে ফিরেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সে সময় সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে বলে লাইভ স্ট্রিমিং এড়িয়েছিল প্রশাসন। এবার মেঘ না চাইতেই জল। না চাইতেই ব্যবস্থা হল লাইভ স্ট্রিমিংয়ের। এদিন বৈঠকের জন্য মেপে দেওয়া হয়েছিল সময়। বলা হয়েছিল, মাত্র ৪৫ মিনিট সময় দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ বৈঠক শেষে দেখা গেল, পেরিয়ে গিয়েছে ২ ঘণ্টা। কোন কোন দাবিতে সরব হলেন সেখানে আন্দোলনকারীরা? কোন কোন অভিযোগ মমতাকে জানালেন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি কিঞ্জল, অনিকেত বা দেবাশিসরা? কার্যত ঠান্ডা মাথায়, শান্তভাবে, স্পষ্ট কথায় একের পর এক নিজেদের দাবি একঘর লোকের সামনে তুলে ধরলেন তাঁরা এদিন।
বৈঠকের গোড়াতেই জুনিয়র ডাক্তাদের হয়ে কথা বলেন তাঁদের প্রতিনিধি আসফাকুল্লা নাইয়া। তার আগে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী অনশনরত জুনিয়র ডাক্তার ও বৈঠকে আগত জুনিয়র ডাক্তার প্রতিনিধিদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজখবর নেন। পাশাপাশি সময়ে আসার জন্য তাঁদের ধন্যবাদও জানান। যার উত্তরে আন্দোলনকারী চিকিৎসক আসফাকুল্লা নাইয়া জানিয়েছেন, "প্রতিবার আমরা দেরি করে আসি বলে একটা অভিযোগ আছে। কিন্তু প্রতিবার যোগাযোগাটা দেরিতে হয়। তাই আমাদের আসতে একটু দেরি হয়। এবার সেটা হয়নি বলে আমাদের আসতে দেরি হয়নি। আর অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের শারীরিক অবস্থা খুব ভালো নেই। তবে তাঁরা অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন।"
নবান্নের বৈঠক থেকে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষ এবং থ্রেট কালচারে অভিযুক্ত আশিস পান্ডের নাম নেন জুনিয়র ডাক্তারদের আরেক প্রতিনিধি দেবাশিস হালদার। তাতে আপত্তি জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, যাঁরা এখানে নেই, তাঁদের নাম নেওয়া উচিত নয়। যে বিষয়টা বলতে চান, সেটা যেন বলেন ডাক্তাররা। তাতে দেবাশিস পালটা বলেন যে তাঁদের কয়েকজনের নামে অভিযোগ আছে। সেক্ষেত্রে কী করবেন? মুখ্যমন্ত্রী পালটা বলেন, অভিযোগ তো অনেকের বিরুদ্ধেই আছে।
আরও পড়ুন: জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে দু’ঘণ্টার বৈঠক মুখ্যমন্ত্রীর, অম্লমধুর কথাবার্তায় অনশন উঠবে?
এরপরেই মুখ খোলেন কিঞ্জল নন্দ। তিনি বলেন, ‘গত ১৪ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনায় যাঁরা অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হল। এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাইছি।’ তার উত্তরে পালটা মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে এটা কি নতুন দাবি নাকি? তখন ডাক্তাররা জানান যে এটা স্রেফ বলছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে একাধিক জিজ্ঞাসা, একাধিক প্রশ্ন নিয়ে সরব হয়েছিলেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের পিজিটি অনিকেত মাহাতো। তিনি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অপরাধ চক্র নিয়ে মুখ খোলেন। অনিকেত দাবি করেন যে এমন একটা কমিটি থাকা দরকার, যে কমিটি নিরপেক্ষ হবে। আর কারও অভিযোগ থাকলে তাঁরা সেখানে গিয়ে নিদেনপক্ষে অভিযোগ জানাতে পারবেন। তাঁর কথায়, ‘‘আরজি করের মতো দ্বিতীয় ঘটনা যাতে না হয়, তা দেখা হোক। মেয়েদের নিরাপত্তার জায়গাটা দেখা হোক।’’ তাঁর দাবি, ‘থ্রেট কালচার’-এর পাশাপাশি যৌন হেনস্থাও চলে হাসপাতালগুলিতে। এই প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের পাশাপাশি সাগরদত্তের পরিস্থিতির কথাও তুলে ধরেন। কোন পরিস্থিতিতে ডাক্তারি পড়তে আসা পড়ুয়ারা নটোরিয়াস ক্রিমিনালে পরিণত হচ্ছে, সে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বাঙুরের চিকিৎসক সত্যদীপ সরকার দাবি তোলেন, স্টেট লেভেল গ্রিভ্যান্স সেলের যে কথা বলছেন, তাতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই হাসপাতালের যে কমিটি রয়েছে, তাকে জোরালো করলে ভালো হয় বলে দাবি তোলেন তিনি। কলেজ লেভেল গ্রিভ্যান্স সেল গড়ার কথা জানান তিনি। যেখানে সিনিয়র ডাক্তারের পাশাপাশি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধি থাকা জরুরি। এর সঙ্গেই অ্যান্টি ব়্যাগিং কমিটির কথাও বলেন তিনি।

হাওড়ার জেলা হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার অগ্নিবীন কুন্ডু জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে জানান বৈঠকে স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে অপসারণের দাবি তোলেন। যা ইতিমধ্যেই তাঁদের দশ দফা দাবিতে রয়েছে। সেইসময় অভিযুক্ত আর দোষীর মধ্যে পার্থক্য বোঝালেন এক যুবতী। ‘স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ রয়েছে। আপনি প্রমাণ চেয়েছেন। স্যরের হাত দিয়ে বেশ কিছু চিঠি বেরিয়েছে।’’ আন্দোলনকারী চিকিৎসক শতরূপা সেসময়ে বলেন, ‘‘দোষ প্রমাণের আগে তাঁকে দোষী বলা যাবে না। তবে অভিযুক্ত বলা যেতে পারে।’’মমতা বলেন, ‘‘একটা মানুষ অভিযুক্ত কি না, প্রমাণ না পেলে তাঁকে অভিযুক্ত করা যায় না।’’
এনআরএসের সপ্তদীপা প্রশ্ন তোলেন নিয়োগ নিয়ে। এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ তুলতে চান তিনি, যা শুনতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। পক্ষপাতহীন ব্যক্তিকে কাউন্সিলে বসানোর দাবিও তোলেন সপ্তদীপা। একই সঙ্গে বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি জানান তিনি। এর পরে কিঞ্জল ফের থ্রেট কালচার নিয়ে মুখ খোলেন। যাতে মানুষ ভালো পরিষেবা পান, এবং পড়ুয়ারা ভালো করে পড়াশোনা করতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করা নিয়ে কথা বলেন। এই প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি নাম বারবার উঠে আসছে, যারা প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পড়ুয়াকে ভয় দেখিয়েছেন বলে দাবি করেন। তারা কীভাবে ক্ষমতায় রয়েছে এখনও সেই বিষয়টি বিবেচনার কথা তুলে ধরেন তিনি। এই পরিবেশে উঠে আসে হাসপাতালের পরিবেশের বিষয়টিও।
আরও পড়ুন:অনশন, ধর্না কতদিন? জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে রফাসূত্র কেন বের করতে পারছে না রাজ্য?
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত উষ্মাপ্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি দাবি করলেন, "আপনি নিজেই ৪৭ জনকে সাসপেন্ড করে দিলেন? আপনি স্বাস্থ্য দফতরকে সেটার প্রস্তাব পাঠালেন না কেন? সেখান থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিতাম। এটা থ্রেট কালচার নয়?" মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কার্যত সরাসরি সংঘাতে জড়ালেন অনিকেত মাহাতো। তিনি দাবি করেন, তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তিনি আরজি করের প্রিন্সিপালের হয়ে মুখ খোলেন।
এদিনের বৈঠক ৪৫ মিনিটে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা দীর্ঘায়িত হতে হতে কেটে যায় প্রায় ২ ঘণ্টা। একটা সময় পর চেয়ার ছাড়েন মমতা। আদৌ এ দিনের বৈঠক কি কার্যকরী হল? অনশন থেকে সরে এসে কাজে ফিরবেন জুনিয়র ডাক্তারেরা? নাকি অন্ধকার এখনও কাটল না, তার উত্তর মিলবে অচিরেই।

Whatsapp
