চিকিৎসক-মৃত্যু নিয়ে উত্তাল আরজি কর! তদন্ত কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে
RG Kar Medical College Hospital: আরজি করের তরফে যে ১১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, প্রশ্ন উঠে গিয়েছে সেই কমিটি নিয়ে। কেন সেমিনার রুমের ভিতরে সিসিটিভি নেই, প্রশ্ন উঠেছে সে নিয়ে।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্ন ডাক্তারের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে একাধিক প্রশ্নের মুখে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। শুক্রবার সকালে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চার তলা থেকে উদ্ধার হয় এক স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর দেহ। বৃহস্পতিবার নাইট ডিউটি ছিল তাঁর। রাত দুটো নাগাদ খাওয়াদাওয়া শেষ করে সেমিনার রুমে পড়াশোনার জন্য যান ওই ট্রেনি চিকিৎসক। শুক্রবার সকাল থেকে ওই সেমিনার রুম থেকেই তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তাঁর শরীরে আঘাতের দাগ ছিল বলে অভিযোগ। জামাকাপড়ও অবিন্যস্ত ছিল বলে অভিযোগ।
ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে হাসপাতাল জুড়ে। তরুণী ডাক্তারের মৃত্যুর প্রতিবাদে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে হাসপাতালের রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন। সদস্যেরা জানিয়েছেন, বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তদন্ত-সহ তাঁদের বাকি দাবি যত ক্ষণ পর্যন্ত মানা হবে না, তত ক্ষণ বন্ধ থাকবে কাজ। শুধু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ খোলা থাকবে। হাসপাতালের ভিতরে বিক্ষোভ দেখায় চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন। তারা ময়নাতদন্তের জন্য চিকিৎসকের দেহ নিয়ে যেতে বাধা দেয় বলে অভিযোগ। এই প্রতিবাদ শুধু আর আরজিকর হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অন্য হাসপাতালের চিকিৎসক পড়ুয়ারাও আরজি করে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন। ঘটনার তদন্তে এদিন হাসপাকালে যান খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। পৌঁছন রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমও। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালের বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে বিজেপি এবং বাম সংগঠন এআইডিএসও। অন্যদিকে, হাসপাতালের ভিতরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তার এবং চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যেরা। চার তলার যে সেমিনার হলে চিকিৎসকের দেহ রাখা রয়েছে, সেখানেও জড়ো হন ডাক্তারি পড়ুয়ারা। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষও সেখানে পৌঁছন। হাসপাতালের সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠ বলেন, ‘‘পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তদন্ত হবে। চিকিৎসকের দেহের ময়নাতদন্ত হবে। সেই ময়নাতদন্ত করার ভিডিয়োগ্রাফি করা হবে। আমরাও চাই, সত্য প্রকাশ্যে আসুক।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। পুলিশ রয়েছে, ফরেন্সিক দল রয়েছে। তদন্ত চলছে।’’
আরও পড়ুন: নাইট ডিউটিতে মহিলা চিকিৎসকের রহস্যমৃত্যু! নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে আরজিকর
এদিকে আরজি করের তরফে যে ১১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, প্রশ্ন উঠে গিয়েছে সেই কমিটি নিয়েও। ওই এগারো জনের মধ্যে প্রত্যেকেই আরজি কর হাসপাতালের ভিতরের লোক। কেন তদন্তে স্বচ্ছতার জন্য বাইরের কাউকে রাখা হল না কমিটিতে, উঠেছে প্রশ্ন। একই সঙ্গে সেই তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন একাধিক স্নাতকোত্তর পড়ুয়া ও ট্রেনি চিকিৎসক। কেন সিনিয়র লোকজনের বদলে এই ধরনের সদস্য রাখা হল প্রশ্ন উঠেছে সে নিয়েও। পাশাপাশি সেই তদন্ত কমিটিতে কোনও ফরেন্সিক দলও রাখা হয়নি বলে অভিযোগ।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার রাতে ডিউটিতে ছিলেন সোদপুরের বাসিন্দা ওই ট্রেনি চিকিৎসক। দুই চিকিৎসকের সঙ্গে খাওয়ার পরে রাত ২টো নাগাদ সেমিনার হলে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। মৃতার মা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাতে শেষ বার কথা হয়েছিল মেয়ের সঙ্গে। মহিলা বলেন, ‘‘রাত ১১টায় কথা হয়েছে। তখন ওরা খাবার অর্ডার করেছিল। আমায় বলল, তোমরাও খেয়ে নাও। তার পর কোনও কথা হয়নি। ওই শেষ।’’ এর পরেই চিকিৎসকের মা দাবি করেন, তাঁর মেয়েকে খুন করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মেয়েটাকে খুন করে ফেলেছে এরা। আমার এই একটা মাত্র মেয়ে। অনেক কষ্ট করে ডাক্তার করেছিলাম। লোকের সেবা করতে এসে নিজে খুন হয়ে গেল।’’ স্বাভাবিক ভাবেই মৃতার মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে আরজি কর হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে। মৃতার মা জানাচ্ছেন, হাসপাতালে নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর মেয়ে কখনও কিছু বলেননি। তাঁর অভিযোগ, চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। মৃতার মা বলেন, ‘‘আমার মেয়েকে খুন করেছে। ওর মতো ভাল মেয়ে হয় না। অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে ছিল দেহ। গায়ে কাপড় ছিল না। চশমাটা ভেঙে গিয়েছিল। মুখে আঘাতের চিহ্ন ছিল। রাতে ও একাই ছিল সেমিনার হলে। ভিতরে কোনও সিসি ক্যামেরা নেই।’’
কেন সেমিনার রুমের ভিতরে সিসিটিভি নেই, প্রশ্ন উঠেছে সে নিয়ে। একটি সূত্র বলছে, সিসিটিভি থাকলেও তা ভাঙা ছিল সেমিনার রুমে। সে ব্যাপারে কেন টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের, প্রশ্ন থাকছে সে নিয়েও। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই মহিলা চিকিৎসকদের জন্য কোনও বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা নেই। বাঘা বাঘা বেসরকারি হাসপাতালেই থাকে না, তো সরকারি হাসপাতাল কোন ছাড়। বহু ক্ষেত্রেই সারা রাত ধরে ডিউটিতে থাকা চিকিৎসক, নার্সরা বিশ্রামের জন্য হাসপাতালেরই বিভিন্ন অংশ বেছে নেন। একটি সূত্রের খবর, আরজি কর কলেজের সেমিনার রুমটিও সে কাজে ব্যবহার করতেন মহিলা জুনিয়র চিকিৎসকেরা বহু সময়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যেখানে চিকিৎসকেরা বহু সময়েই বাধ্য হন টানা ২৪ ঘণ্টা বা ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে, সেখানে কেন তাঁদের জন্য সেই ন্যূনতম বিশ্রামের সুবিধাটুকু থাকবে না? কেন থাকবে না হাসপাতালে কাজ করার ক্ষেত্রে ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা।
আরও পড়ুন: শিমলা, কুলু, মান্ডিতে মেঘ ভেঙে মৃত ১৪! প্রকৃতির রোষে যেভাবে ছারখার দক্ষিণ থেকে উত্তর
তরুণীর বাবা এদিন জানিয়েছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন তাঁদের সঙ্গে। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত ফোন করে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, যতটা পারেন, চেষ্টা করবেন।’’ মৃতার মায়ের কথায়, ‘‘আমার মেয়েটাকে কেউ ফেরত দিতে পারবেন না। তবু আগে বিচার হোক।’’ এদিকে, তরুণীর মৃত্য়ুতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত-সহ একাধিক দাবি জানিয়েছেন। এ-ও বলেছেন, যত ক্ষণ কমিটি তৈরি এবং অন্য দাবি না মিটছে, তত ক্ষণ কর্মবিরতি চলবে রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের। সংগঠনের সদস্য আরিফ আহমেদ লস্কর জানিয়েছেন, চিকিৎসকের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তদন্ত করাতে হবে। ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত থাকবেন পাঁচ জন জুনিয়র মহিলা চিকিৎসক, পরিবারের সদস্য, বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট। ময়নাতদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি করাতে হবে। আরজি করেই ময়নাতদন্ত করাতে হবে। এখনই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তদন্ত কমিটি তৈরি করতে হবে। এই দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। তবে ছাত্রীর মৃত্যু ঘিরে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে মন্তব্য করেননি আরিফ। তাঁর কথায়, ‘‘ঘটনাটি সেমিনার রুমে হয়েছে যা সন্দেহজনক। তবে মন্তব্য করব না। তদন্ত চলছে।’’
সব মিলিয়ে আরজি করের মতো সরকারি হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যু হাসপাতালের পরিকাঠামো এবং নিরাপত্তা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এর পরেও কি টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের? সরকারই বা কী ব্যবস্থা নেবে এর পরে? এদিকে জুনিয়র ডাক্তারের কর্মবিরতির জেরে বিপাকে পড়েছেন আর জি করে চিকিৎসা করতে আসা অজস্র রোগী। সব মিলিয়ে নয়া সঙ্কটের মুখে ফেলে দিয়েছে এই ট্রেনি চিকিৎসকের রহস্যমৃত্যু।