ফ্যাশনের 'অ আ ক খ'! যেমন ছিল ভারতের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল রানিদের ওয়াড্রব

Most Fashionable Indian Princesses and Maharanis in History: একবার বিরাট পান্নাযুক্ত একটি সোনার আংটি উঁচু থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন রাজকুমারী। এমন মহামূল্যবান অলঙ্কার ছুড়ে ফেলে দিতে দেখে চমকে গিয়েছিলেন সকলেই! তারপর?

উত্তরবঙ্গের চা বাগান ভেদ করে ছুটে চলেছ টয়ট্রেন। ট্রেনের জানলায় বসে শর্মিলা ঠাকুর। জানলার বাইরে সুপারস্টার রাজেশ খান্না। ছবি হিট, তার সঙ্গে হিট শর্মিলার চোখের ওই টানা টানা কাজল, উঁচু করে বাঁধা চুল। সেই স্টাইলে মাতোয়ারা হয়েছিল প্রায় গোটা দেশ। তার এক দশক আগেই মধুবালার আনারকলি স্টাইলে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিল দেশ। সাতের দশকে 'ববি' সিনেমার মুক্তির পরে দেশ মজল পলকা ডটসে। নব্বই দশকের প্রায় প্রতিটি মেয়ের সঙ্গী হয়ে উঠল কাজলের সেই বিখ্যাত 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' ব্যান্ড। যুগে যুগে চলচ্চিত্র তারকাদের দেখে প্রভাবিত হয়েছে দেশের ফ্য়াশন। সাম্প্রতিক সব সিনেমার সাজগোজে বাজার ভরে উঠেছে। কিন্তু ভারতের ফ্যাশন আইকন কি বরাবর তারকারই? না, তা কিন্তু নয়। বরং তারকাদের অনেক আগেই বাংলার ফ্যাশনকে দিশা দেখিয়েছে রয়্যাল সাজ। আর শুধু তাই-ই নয়। যে সময়ে মেয়েদের সকলের সামনে বাইরে আসাটাই তেমন সহজ ছিল না, সেই পর্দানসীন যুগে প্রথা ভেঙে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা।

আজকের দিনে আমরা যেভাবে কুচি দিয়ে শাড়ি পরে থাকি, সেই বিশেষ শাড়ি পরার ধরনটিকে বিখ্যাত করার নেপথ্যে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির অবদান। তেমন ভাবেই ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবার, উচ্চবৃত্ত জমিদার পরিবারের হাত ধরে সাজগোজের অনেক রকমসকমই বদলেছে দেশে। পায়রার ডিমের আকারের পান্না থেকে সোনায় বোনা শাড়ি, বিলাসিতাকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের এই রানী, রাজকুমারীরা। হ্যাঁ, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই সাজগোজের মধ্যে প্রাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল কার্যতই স্পষ্ট। তবে তা সত্ত্বেও তার মধ্যে নিজের স্বাতন্ত্রকে খুঁজে নিতে পেরেছিলেন তাঁরা। বিলাসবহুল মানে উচ্চকিত হতেই হবে, তা যে নয়, তা ভালো মতোই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কোন কোন ভারতীয় রানির দৌলতে বদলে গিয়েছিল ভারতীয় ফ্যাশনের ভাষা? কাদের সাজগোজ, পোশাক-আশাক পরবর্তীকালে সাহস জুগিয়েছে ভারতীয় ফ্যাশনের দুনিয়াকে। আসুন দেখে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন:বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা

কাপুরথালার রাজকুমারী করম (১৯১৫-২০০২)

১৯৩০ সালের এই ভারতীয় রাজকুমারী কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন প্যারিসের ফ্যাশন আইকন। কাশীপুরের মহারাজার কন্যা রানি সীতা দেবী পরবর্তী কালে পরিচিত হল প্রিন্সের করম নামে। সীতাদেবির বিয়ে হয়েছিল কাপুরথালার বাড়িতে। যা ছিল পঞ্জাবের পাঁচটি রাজকীয় পরিবারের একটি। করমের শ্বশুরমশাই ছিলেন মহারাজা ছিলেন বিশ্ব পরিব্রাজক। ভার্সাইয়ের প্রাসাদের অনুকরণে নিজের প্রাসাদও তৈরি করেন তিনি। কাপুরথালার রাজকুমারী হিসেবে বারবার প্যারিসে যেতে হয়েছে সীতাদেবীকে। সেই সূত্রেই ফরাসি সভ্যতার সঙ্গে তাঁর আলাপপরিচয়। কাপুরথালার রাজকুমারী নাকি প্যারিস যাওয়ার সময়ে অন্তত এক হাজার শাড়ি নিয়ে ভ্রমণ করতেন বলে শোনা যায়। প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার মেইনবোচার ও মাদাম গ্রেসের মতো পোশাক পরতে দেখা যেত তাঁকে। সে সময় বেশিরভাগ ভারতীয় মহিলাদেরই, এমনকী রাজপরিবারেও মাথা ঢেকে ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল। তবে সেই পর্দানসীন সমাজের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে নিজস্বতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বপ্রতিভ। প্যারিসে তো বটেই, অল্প দিনেই এ দেশেও ফ্যাশন আইকন হয়ে উঠেছিলেন কাপুরথালার রাজকুমারী করম।

কাপুরথালার রাজকুমারী বৃন্দা (১৮৯০-১৯৬২)

কাপুরথালার মহারাজার জ্যেষ্ঠপুত্র পরমজিৎ সিং টেকা রেকার স্ত্রী ছিলেন বৃন্দা দেবী। বরাবরই তিনি ছিলেন একটু বেশিই দৃঢ়চেতা। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য মুগ্ধ করার মতোউ। তাঁর আবার বিশেষ সখ্য ছিল স্পেনের রাজা আলফানসো ও রোমানিয়ার রানি মেরির সঙ্গে। বৃন্দাদেবীর গয়নাগাটির সংগ্রহ ছিল হিংসা করার মতোই। কানে ঝুলতো আখরোটের আকারের রান্না, গলায় হিরের নেকলেস। একবার প্যারিসে গিয়ে উজ্জ্বল সাদা সাটিনের একটি টিউনিক পরতে দেখা গিয়েছিল বৃন্দাদেবীকে। তার সঙ্গে ছিল প্যান্ট ও গলায় একটি মুক্তোর মালা। তবে দৃঢ়চেতা বৃন্দাদেবীকেও কম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। তিনটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার পরও অফুরন্ত লড়াই লড়তে হয়েছে তাকে পুত্রজন্ম দেওয়ার জন্য। শেষপর্যন্ত আরও একটি বিয়ে করেন তাঁর স্বামী। একবার নাকি বিরাট পান্নাযুক্ত সোনার আংটিটি উঁচু থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন রাজকুমারী। এমন মহামূল্যবান অলঙ্কার ছুড়ে ফেলে দিতে দেখে চমকে গিয়েছিলেন সকলেই! পরে অবশ্য জানা যায় সেটি প্যারিস থেকে আনা নকল পাথর।

কুচবিহারের মহারানি ইন্দিরা দেবী (১৮৯২- ১৯৬৮)

রাজকুমারী বৃন্দার মেয়ে ছিলেন ইন্দিরা দেবী। সাজগোজের ব্যাপারে মায়ের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলেন ইন্দিরাও। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা যিনি ফরাসি শিফন ফ্যাব্রিক ব্য়বহার করতেন শাড়িতে। 'চাঁদনি' ছবিতে শ্রীদেবীর সেই বিখ্যাত শিফন শাড়ি নিশ্চয়ই আমরা ভুলিনি। তবে সেই সব আইকনিক দৃশ্য বোধহয় তৈরিই হত না কুচবিহারের মহারানী ইন্দিরা দেবী না থাকলে। নিজের সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি বিপ্লবী ছিলেন তিনি। কারণ ১৮৯২-তে দাঁড়িয়ে শিফনে নিজেকে সাজানো বোধহয় সহজ ছিস না। ফুল ফুল ছোপ শিফন শাড়ি, আর তার পাড়ে সোনা বা রূপার কাজ। কার্যত আজও মানুষের চোখে গেঁথে রয়েছে। ইন্দিরা দেবীর কিন্তু ছিল প্রবল জুতোর নেশা। বহুমূল্যের ইতালীয় মেসন অন্তত তার কাছে একশোটা তো ছিলই। তাঁর সংগ্রহে ছিল একটি সবুজ মখমলের জুতো, যার হিলগুলো ঘেরা ছিল মুক্তের সাজে। অন্য আর একটি জুতো ছিল কালো মখমলে তৈরি, সেটি আবার ঘেরা থাকত একটি হিরের ফিতে দিয়ে। প্রায়সই ফরাসী শাড়ি প্রস্তুতকারক মন্সিউর এরিগুয়ারের থেকে বিভিন্ন শাড়ি আনাতেন রানি। আর সেগুলিকে ভারতীয় ঢঙে ডিজাইন করার চেষ্টা করতেন বলে শোনা যায়।

ইনদওরের মহারানি সংযোগিতা দেবী (১৯১৪-১৯৩৭)

ইনদওরের রানি সংযোগিতা দেবী কিন্তু বরাবরই বেশি স্বাচ্ছন্দ ছিলেন পাশ্চাত্য পোশাকে। ১৯৩০ সালে কানে ইনদওরের রাজার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় রানি সংযোগিতার। সে সময় তাঁর পরনে ছিল স্যাকস্যুট। ভারী সুন্দর লাগছিল রানিকে। সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি হয়। এরপর তাঁদের মধুচন্দ্রিমা উপলক্ষে মহারাজা ও তাঁর স্ত্রীকে দক্ষিণ ফ্রান্সে দেখা যায়। ফরাসি পোশাকের সঙ্গে হাতে পান্নার মস্ত একটি আংটি। ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় ধরা পড়েন দু'জনে। অবশ্য ততদিনে বহু ভারতীয় রানি ও রাজকুমারীই ইউরোপীয় পোশাকআশাকে অভ্যস্ত হয়েছেন। পরবর্তীকালে ফরাসি শিল্পী বার্নাড বুটেট ডি-র আঁকা ছবিতে ধরা দিয়েছিলেন ভারতীয় এই রানি। তার মধ্যে বেশ কিছু ছবি কিন্তু বেশ সাহসীও। তাঁর স্বামী যশবন্ত হোলকারের সঙ্গেও বেশ কিছু ছবি বিখ্যাত হয় তাঁর।

 

বরোদার মহারানি দ্বিতীয় চিমনাবাই (১৮৭২-১৯৫৮)

ইউরোপীয় ঘরানার গহনাকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিশিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন এই মহিলা। বরোদার রানি চিমনাবাইয়ের বরাবরই গহনার প্রতি বিশেষ ঝোঁক। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল কার্যত লোভনীয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় সেসব সংগ্রহ করেছিলেন রানি। ইউরোপীয় গহনা ও সেটিংসের বিষয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি। ক্রমশ ভারতে গহনা শিল্পের পরিচিত মুখ হয়ে যান রানি চিমনাবাই। ১৯১১ সালে বরোদায় তিনি আমন্ত্রণ জানান প্রখ্যাত রত্ন অভিযানকারী জ্যাক কার্টিয়ারকে। একঢাল চুল, সোনার কাজ করা সাদা শাড়ি, পায়ে মুক্তোর নূপুর, গলায় পায়রার ডিমের আকারের একটি পান্নাযুক্ত হার, তার পাশ দিয়ে কয়েক ছড়া মুক্তোর মালা, সব মিলিয়ে তার রূপ যেন ছিল সকলের চেয়ে আলাদা।

বরোদার মহারানি সীতা দেবী (১৯১৭-১৯৮৯)

সেসময়ের বিখ্যাত মার্কিন গহনাপ্রস্তুতকারক সংস্থা থিল হ্যারি উইনসন। তাদের তৈরি পান্না ও হিরে খচিত নূপুরজোড়া পায়ে দেওয়ার ক্ষমতা সে সময়ে কম রাজাবাদশারই ছিল। আর তাঁদের মধ্যে পড়তেন বরোদার মহারানি সীতা দেবী। অলঙ্কারের প্রতি তাঁর দুর্বলতার কথা সকলেই জানতেন। ফরাসি গহনা, ঘড়ি ও সুগন্ধি প্রস্তুতকারক সংস্থা ভ্যান ক্লিফ অ্যান্ড আর্পেলসের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন তিনি। প্যারিসে থাকাকালীন প্রায়শই তাঁর বুটিকে গিয়ে নিজের জন্য় গহনা প্রস্তুত করিয়ে আনতেন রানি। মহামূল্যবান সব পাথর যেত রাজপরিবারের আলমারি থেকে। ১৯৫০ সালে জ্যাক আর্পেলসকে একটি নেকলেস তৈরির করার বরাত দেন তিনি, যার মধ্যে ছিল রাজপরিবারের সংগ্রহের দামী পাথর। আর সেই গয়নায় ছিল ১৫০ ক্যারাটেরও বেশি দামী পাথর, ১৩টি টিয়ারড্রপ পান্না। সেই দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এক তাক লাগানো পদ্মফুলের নকশা।

আরও পড়ুন: দেশের প্রথম মহিলা সিনেমাওয়ালা, স্পর্ধার নাম ফতমা বেগম

রাজরক্তকে এক আলাদা মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই সমস্ত রানিরাই। অর্থের অভাব ছিল না তাঁদের কোনওকালেই। ছিল বহির্বিশ্বের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগও। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে এক অন্য পথে অন্য সাজে চালিত করেছিলেন এই সব রানি, মহারানি, রাজকুমারীরা। যাদের সাজগোজ, পোশাকের আঙ্গিক যুগের তুলনায় এগিয়েছিল অনেকটাই। কার্যত ফ্যাশনের পালে প্রথম হাওয়াটা লাগিয়েছিলেন এই সব মোহময়ীরাই।

 

More Articles