পর্দার ফাটাকেষ্ট না কি তৃণমূলের শমন! এক ছোবলেই ছবি করতে পারবেন মিঠুন?

Mithun Chakrabarty: মিঠুনের দাদাসুলভ, জৌলুসহীন প্রভাব বাড়ছে মমতাময় বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।

ফাটাকেষ্ট! এমএলএ অথবা মিনিস্টার না হলেও ফের যে বঙ্গ-রাজনীতির মঞ্চে 'ডিস্কো ড্যান্সার' হিসেবে উঠে আসছেন, একথা বলছেন অনেকেই। বাংলার শীত আবহের জল্পনা-কল্পনায় আবারও জায়গা দখল করছেন মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty) । তাঁর দাদাসুলভ, জৌলুসহীন প্রভাব বাড়ছে মমতাময় বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।

পঞ্চায়েত নির্বাচন এগিয়ে আসতেই উটি থেকে এ রাজ্যের রাঢ়ভূমে পা পড়েছে মিঠুন চক্রবর্তীর। গেরুয়া-ঘরে আবারও সুর চড়িয়েছেন তিনি। আর তাঁকে দিয়েই গ্রামবাংলার মন জিততে চাইছেন সুকান্ত-শুভেন্দু-দিলীপরা! দলীয় অভ্যন্তরে মিঠুন বিড়ম্বনার কানাঘুষো থাকলেও প্রকাশ্যে যে মিঠুন-অস্ত্রই তৃণমূল-বধের অন্যতম উপজীব্য, একথা নিশ্চিত করছেন বঙ্গ বিজেপি-র নেতারা। যদিও অনেকেই বলছেন, ''তাঁরা কে! যা করার করছেন তো দিল্লির মসীহারা।''

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার ফের রাজ্যে এসেছেন মিঠুন। কয়েক মাস আগের সফরের পর রাজ্যে এসেই, একাধিক বিধায়ক, যাঁরা শাসকদল তৃণমূলের। তাঁরা মিঠুনের সঙ্গে যে যোগাযোগ রাখছেন, একথা বলেছেন আবার। এমনকি মঙ্গলবার বঙ্গ বিজেপির উল্টো-পথে হেঁটে মিঠুন বলেছেন, ''তৃণমূলের সকলেই চোর নন, খারাপ সবাই নয়। যাঁরা চুপ করে আছেন তাঁদের দিকে খেয়াল রাখুন!'' অর্থাৎ চুপ করে থাকা বিধায়ক বা তৃণমূল নেতারাই যে মিঠুনের গোপন আঁতাত তথ্যের ধারক, একথা পরোক্ষে বলে দিয়েছেন মহাগুরু।

আরও পড়ুন: ফাটাকেষ্টই নাটের গুরু? বঙ্গ বিজেপি-তে হঠাৎ কেন জরুরি হয়ে উঠছেন মিঠুন চক্রবর্তী

আর তাঁকে নিয়ে একাধিক জল্পনার মধ্যেই বঙ্গের শুষ্কভূমির রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি। সুকান্ত মজুমদারদের সঙ্গে নিয়ে মিঠুন-প্রবেশ ঘটেছে পুরুলিয়ায়। বুধবার সেখানে কর্মীসভা করেছেন তিনি। এমনকি দলীয় কর্মীর বাড়িতে অমিত শাহ স্টাইলে খেয়েছেন! কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মঞ্চ থেকে সদর্পে ঘোষণা করেছেন, ''আমি এখানে ডায়ালগ দিতে আসিনি!'' অথবা আদিবাসীদের গড়ে দাঁড়িয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে, 'রাষ্ট্রপতিকে অপমান' না ভোলার কথা! কর্মীদের কবিতা শুনেছেন, কথা বলেছেন। জনসংযোগে মাটির মানুষ হয়েছেন মিঠুন। আর তার সঙ্গেই তারকা-প্রথা ভেঙে একেবারে তৃণমূল স্তরের সঙ্গে যোগসাজশ শক্ত করেছেন তিনি।

এদিকে এদিনই বাঁকুড়া সফর শুরু করছেন মিঠুন চক্রবর্তী। সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডলের গড় বলে পরিচিত, কেষ্টর বীরভূমেও যাওয়ার কথা তাঁর। অর্থাৎ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম। মূলত, আদিবাসী অধ্যুষিত জেলার প্রান্তিক কয়েকটি অঞ্চল ছুঁয়ে নিতে চাইছেন তিনি। যেখানে পৌরসভার তুলনায় পঞ্চায়েতের আধিক্য অনেক বেশি। অর্থাৎ একদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচন অন্যদিকে ভোটমুখী জনসংযোগের চেষ্টা, এক ঢিলে দুই পাখি খাঁচায় বন্দি করতে এগিয়েছেন সিনেমা জগতে 'তুলকালাম' ঘটানো এই অভিনেতা।

কিন্তু কেন? ঠিক কী কারণে ফের মিঠুনের বাড়বাড়ন্ত? কোন কৌশল অবলম্বন করছে গেরুয়া-শিবির!

গেরুয়ায় মিঠুন-প্রভাব
নির্বাচন এবং জনপ্রিয়তা। সার্বিক রাজনৈতিক বিকাশ এবং বাংলার বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মিঠুনকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। একাধিক সমস্যার নিরসন এবং বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিঠুনের গুরুত্ব বেড়েছে বঙ্গের বিজেপি শিবিরে। ক্রমশ একাধিক ক্ষেত্রে মিঠুনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। শুধু তাই-ই নয়, উপরন্তু দলের কর্মীদের মধ্যেও মিঠুন'দার প্রভাব বিস্তার হয়েছে। যা নির্বাচনী রাজনীতিতেও কাজে লাগতে পারে, ভালো প্রভাব ফেলতে পারে সংগঠন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও। একথা বলছেন কেউ কেউ। বঙ্গ বিজেপি-র এক অন্যতম মুখপাত্র, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। ইন্সক্রিপ্ট-কে বলছেন, ''রাজ্যের মানুষের মধ্যে বিজেপি প্রভাব বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও বহু অংশে আমাদের দলের তেমন কিছু নেই। এদিকে একটা সমস্যা রয়েছে, একথা মানতেই হবে সেটি হল দলেই নেতা কে, এই বিষয়টি নিয়ে কর্মীদের বোঝার সমস্যা! ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে মিঠুন চক্রবর্তীর বঙ্গ বিজেপি-র একটি নতুন মুখ হিসেবে বারবার উঠে আসা, দলের কর্মীদের মধ্যে বেশ প্রভাব বাড়িয়েছে।''

লক্ষ্যভেদে মিঠুন-তির
মমতার বিদায়! তৃণমূলের রাজনৈতিক বিদায়ের সূচনায়, রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বিজেপি-র অন্যতম উপকরণ হয়ে উঠেছেন মিঠুন। যেখানে দলের একাধিক সমস্যা, বাংলার সর্বত্র বিজেপি-র প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে কর্মীদের উজ্জীবিত করা। সামগ্রিকভাবে আসন্ন নির্বাচনে গেরুয়া-শিবিরের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মিঠুন দিয়েই কেল্লাফতে ঘটাতে চাইছে বিজেপি। শাহ-মোদী ভাবনায় নাড্ডা, মালব্যদের চিন্তাভাবনার পথে ঢাল হিসেবে উঠে আসছেন মিঠুন। যাঁকে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক শক্তির আরাধনায় সরব হচ্ছে বঙ্গের বিজেপি। বাংলার বিজেপি নেতারা চেষ্টা করছেন নতুন করে, নতুনভাবে মিঠুন দিয়েই তির নিক্ষেপের, যে অস্ত্রে আসলে বধ করা যাবে তৃণমূলকে! যাদের রাজনৈতিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মিঠুন-তিরেই রচিত হবে ক্ষমতা লাভের নয়া ইতিহাসও, এমনও বলছেন একাধিক বিজেপি নেতা। যদিও এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের দাবি, ''এসব জিনিস আসলে গিমিক! মোদীর চমকের মতো। মিঠুন চক্রবর্তী সিনেমায় ভালো, মাটিতে নন!"

পঞ্চায়েতে মিঠুন-অস্ত্র
'মারব এখানে লাশ পড়বে স্মশানে!' মিঠুনময় সংলাপের জনপ্রিয়তায় এখনও এগিয়ে গ্রামবাংলা। আর ঠিক এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই মিঠুন পথে এগিয়ে যেতে চাইছে বঙ্গের বিজেপি। কেন্দ্রীয় নির্দেশের আবহেই মিঠুনকে কেন্দ্র করেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভালো ফলের ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হতে হচ্ছে সুকান্ত, শুভেন্দুদের। যেখানে সংগঠনে, কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছেন মিঠুন চক্রবর্তী। তাঁর গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয়তাকে অস্ত্র করে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও সচেষ্ট হচ্ছেন বিজেপি নেতারা। যেখানে মিঠুন হয়ে উঠছেন ঘুঁটি আর তাঁর রাজনৈতিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে তাঁর জনপ্রিয়তা। মিঠুন ক্রেজ। আর এই সম্পূর্ণ বিষয়টিকেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে ব্যবহার করতে চাইছে বিজেপি। সেই লক্ষ্যেই মিঠুন চক্রবর্তীর বাংলা সফরে জায়গা করে নিয়েছে একাধিক আদিবাসী অধ্যুষিত প্রান্তিক জেলা। যেখানে পঞ্চায়েত আধিক্য সর্বাধিক। বলছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

কোন্দল রক্ষায় মিঠুন-টনিক
বঙ্গ বিজেপি-র এগিয়ে যাওয়া এবং মমতা বিরোধের অন্যতম অন্তরায় গোষ্ঠী কোন্দল। শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, না দিলীপ ঘোষ। আবার রাহুল সিনহা, তথাগত রায় না সায়ন্তন, দিলীপ। বঙ্গের বিজেপি-র অভ্যন্তরে বারবার উঠে আসে কোন্দলের কথা। দলের অন্দরেই উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। অনেকেই বলেন, এখানেই প্রশ্ন ওঠে একাধিক আর বিপদে পড়ে বঙ্গের বিজেপি। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বারবার তৃতীয় বিকল্প হিসেবে উঠে আসেন মিঠুন চক্রবর্তী। অর্থাৎ এমন এক মুখ, যাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এই কোন্দল শেষের আবহ। যেখানে তাঁকে কেন্দ্র করেই বঙ্গের রাজনৈতিক বিজেপি এবং কোন্দলে আবিষ্ট নেতারা প্রকাশ্যে এগিয়ে যান নতুনভাবে। যেখানে কোন্দল কমে, আবার অমিত মালব্য, অমিত শাহরা মমতা বিরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন মিঠুনকে। এখানেই অতি সহজেই বিজেপি-র বাংলায় এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম বাহন হিসেবে জায়গা করে নেন মিঠুন, বলছেন কেউ কেউ।

শাহ-কথায় মিঠুন-শরণ
রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, মিঠুন চক্রবর্তী এ রাজ্যের হয়ে রাজনৈতিক কাজকর্ম করলেও আদতে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্র। অর্থাৎ বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অঙ্গুলিহেলনে মিঠুনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার হয় এই রাজ্যে। ঠিক এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে অমিত শাহ, জগৎ প্রকাশদের নির্দেশেই বঙ্গের বিজেপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ সাধিত হয় মিঠুনের। আর সেখানেই একাধিক রাজনৈতিক অস্বস্তি থাকলেও মিঠুনকে প্রাধান্য দিয়েই এগিয়ে যায় বিজেপি। যেখানে ৭২ বছরের এক নেতাকে ঘিরেই তৈরি করতে হয় পরবর্তী রণকৌশল, যা দাদা মিঠুনের নেতা মিঠুন রসদ ঠিক কতটা আছে এই প্রশ্ন বাংলার বিজেপি-র অভ্যন্তরে উঠলেও সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত বড় বালাই, এই প্রশ্নেই মিঠুনের হ্যাটট্রিক ঘটে বঙ্গের গেরুয়া রাজনীতির অঙ্গনে।

২০২১। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের উত্তাপের মধ্যেই গেরুয়া শিবিরে আশ্রয় নেন মিঠুন চক্রবর্তী। যিনি বেশকিছুদিন আগেই তৃনমূলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেন। রাজ্য সভায় তৃনমূলের সাংসদ থাকলেও বিজেপি-তে যোগ দিলেও সেইভাবে কোনও পদ পাননি মিঠুন। যদিও মিঠুনের ফের দলবদল নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়েছিল। ছেলেকে বাঁচাতে, কোটি কোটি টাকা নিতে দলবদল করেছেন তিনি, এই প্রশ্নের আবহেও উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। এমনকি মিঠুনের 'কোবরা' মন্তব্য নিয়েও সমালোচনার ঝড় ওঠে। তৃণমূল বা বামেরা, মিঠুনের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে খুব একটা পাত্তা না দিলেও রাজনৈতিক মহলের ওই অংশই বলছে অন্য কথা। তাঁদের দাবি, অভিনেতা আর রাজনীতিক মিঠুন চক্রবর্তীর মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এই দুই সত্তার খুব একটা বিভাজন নেই। তাই গ্রামেগঞ্জে মিঠুন কিছু বললে সেটির যে রাজনৈতিক প্রভাব খুব কম হবে, এমনও বলছেন না অনেকেই। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একাধিক ইস্যুকে সামনে রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বঙ্গের বিজেপি-র মিঠুনকে ব্যবহার, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদিও অনেকেই বলছেন, ভূমিকা পালন তো করবে কিন্তু ভোটপাখি মিঠুনের ভোটহীন সময়েও দেখা পাওয়া যাবে তো!

More Articles