‘ট্র্যাজিক মিসটেক’! রাফাহতে গণহত্যার পর ভুলস্বীকার আসলে কোন কৌশল নেতানিয়াহুর?
Israel Hamas war: গাজার রাফাহ শহরকে ধ্বংস করতে কোনও কসুর বাকি রাখেনি ইজরায়েল। আর সেই সিদ্ধান্তকেই এবার 'ট্র্যাজিক মিসটেক' বলে বর্ণনা করছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
গত বছর অক্টোবর মাসে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। নামেই ছিল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই ক'মাসে লাগাতার গাজায় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হামলার পর হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। স্কুল, ধর্মস্থান এমনকী শরণার্থী শিবিরগুলোও বাদ দেয়নি নেতানিয়াহু সেনা। অন্তত ৩৬ হাজার সাধারণ বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে এই ক'মাসে। তার মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শিশু ও মহিলা। আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একাধিক দেশ এনেছে গণহত্যার অভিযোগ। তার পরেও রাফাহ আক্রমণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি নেতানিয়াহু। আমেরিকার বারবার বারণ, অস্ত্র জোগান বন্ধ করার হুঁশিয়ারি কাজে আসেনি কোনও কিছুই। গাজার রাফাহ শহরকে ধ্বংস করতে কোনও কসুর বাকি রাখেনি ইজরায়েল। আর সেই সিদ্ধান্তকেই এবার 'ট্র্যাজিক মিসটেক' বলে বর্ণনা করছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সত্যিই ভুল স্বীকার নাকি অন্য কোনও কৌশল, আশঙ্কা আন্তর্জাতিক মহলে।
এতগুলো মাস ধরে ইজরায়েলের লাগাতার হামলায় কার্যত শ্মশানে পরিণত হয়েছে গোটা গাজা। প্রায় কোনও অংশই ছাড়েনি ইজরায়েলি সেনা। গাজাবাসীর পালিয়ে বাঁচার ন্যূনতম জায়গাটুকুও যেন বেঁচে নেই গাজায়। বাকি ছিল ওই রাফাহ শহরটুকু। যেখানেই সমস্ত বাসিন্দারা কোনওমতে মাথাটুকু গুঁজেছিলেন। হামাসের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে সেই রাফাহ শহর উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইজরায়েল। যার বিরোধিতা করেছিল বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধসম্পন্ন দেশ। এমনকী আমেরিকা পর্যন্ত। প্রথম থেকেই ইজরায়েলকে এই হামলা রোখার জন্য অনুরোধ-উপরোধ করে এসেছে বাইডেনের দেশ। আমেরিকার থেকে এগোনোর সবুজ সঙ্কেত না পেয়েই আটকে ছিল অ্যাদ্দিন ইজরায়েল, তেমনটাই শোনা যাচ্ছিল নানা সূত্রে। এদিকে এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইজরায়েল। ইরানে যাতে বড়সড় হামলা না চালায় ইজরায়েল, সেই রফা রাফাহ দিয়ে করার চেষ্টা করেছিল আমেরিকা। মধ্যিখানে অস্ত্র জোগান বন্ধ করার কথাও ঘোষণা করে আমেরিকা। কিন্তু তার অব্যবহিত পরেই আমেরিকা থেকে অস্ত্রের সরবরাহ ফের পৌঁছয় ইজরায়েলে। এর মধ্যেই রাফাহ আক্রমণ করে বসে ইজরায়েল। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের একাধিক অনুরোধেও ভেজেনি চিঁড়ে।
আরও পড়ুন: গাজাকে ৪০ হাজার তাঁবু ‘ইদের উপহার’! রাফাহ ধ্বংসের ভয়ঙ্কর ছক কষছে ইজরায়েল?
ইজরায়েলের দাবি, তারা রাফাহতে হামলা চালাতে চাইলেও নাগরিকদের ক্ষতি এড়াতে চেয়েছিল তারা। সে জন্যই আগে থেকে গাজাবাসীকে রাফাহ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সেই ইদের সময় থেকেই শুরু করে দিয়েছিল নেতানিয়াহুর দলবল। কিন্তু কোথায় যাবে গাজাবাসী? গাজায় নিরাপদ অখণ্ড কোনও জায়গা আর বেঁচে নেই কোথাও। সমস্তটাই ইজরায়েলি সেনার সৌজন্যে পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যতই নাগরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর কথা বলে থাকুক ইজরায়েল, শেষপর্যন্ত তেমনটা হয়নি। ফের ইজরায়েলি হামলা নেমে এসেছে সাধারণ নিরাপরাধ গাজাবাসীর মাথায়। সাম্প্রতিকতম হামলায় আগুন ছড়িয়ে যায় উদ্বাস্তু, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া গাজাবাসীদের তাবুতে। সেই আগুন লেলিহান রূপ নিতে সময় নেয়নি। অন্তত ৪৫ জন নিরাপরাধ সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ওই ঘটনায়। গণহত্যার অভিযোগ ইতিমধ্যেই ঝুলছে নেতানিয়াহুর মাথায়। ফের আরও একবার নিরপরাধ মানুষের রক্ত লাগল নেতানিয়াহুর হাতে। তার জন্য বিশ্ব রাজনীতিতে ফের নিন্দার মুখে নেতানিয়াহু ও তার প্রশাসন।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার নেপথ্যে যে তাঁর দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে, সে কথা ইজরায়েলের পার্লামেন্টে মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। পার্লামেন্টে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, রাফাহ থেকে দশ লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষকে সরিয়ে ফেলেছে ইজরায়েল। তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও রাফাহতে ঘটে গিয়েছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এই ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান নেতানিয়াহু। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা স্ট্রিপের মন্ত্রক জানিয়েছে, অন্তত আড়াইশো জন জখম হয়েছে ইজরায়েলের সাম্প্রতিক এই হামলায়। একে 'ট্র্যাজিক মিসটেক' বলেও ব্যাখ্য়া করেছেন নেতানিয়াহু।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য গোড়া থেকেই গোটা বিশ্বের নিন্দার মুখে পড়েছে ইজরায়েল। গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের কড়াকড়ির মুখেও পড়তে হতে পারে নেতানিয়াহু ও তাঁর আমাত্যবর্গকে। এরই মধ্যে আবার ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ইজরায়েল। লেবাননের হিজবুল্লা গোষ্ঠী লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলের উপর। তার উপর ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির মৃত্যুর নেপথ্যে ইজরায়েলের হাত থাকতে পারে বলেও অভিযোগ উঠছে বারবার। এর জন্য নতুন করে হামলার ছক কষছে হিজবুল্লা, এমনকী হামাসও। হামাসের বাড়বাড়ন্তের পিছনে রইসির সমর্থন রয়েছে বলেই মনে করে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।
এই পরিস্থিতিতে কোনও উপায়ন্তর না দেখেই কি রাফাহ হামলার জন্য ভুলস্বীকারের পথ বাছছেন নেতানিয়াহু? না, গাজাকে শ্মশান বানিয়ে দেওয়া, এত হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য কিন্তু একবারের জন্যও অনুতপ্ত নন নেতানিয়াহু। শুধুমাত্র রাফাহর ওই অগ্নিকাণ্ডের জন্যই ভুল স্বীকার করতে বসেছেন নেতানিয়াহু? কতটা খাঁটি এই ভুলস্বীকার। আসলে আন্তর্জাতিক মহলে কোণঠাসা হওয়া বাঁচাতেই কি দায়সারা ভাবে অনুতাপ দেখাচ্ছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী? এর আগেও কি রাফাহতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেনি ইজরায়েলি হামলায়। প্রায় প্রতিদিনই একজন দু'জন করে মানুষের মৃত্যু হয়েছে হামলায়? তাঁদের মৃত্যুর জন্যেও কি ক্ষমা চাইবেন নেতানিয়াহু? উঠছে প্রশ্ন।
এরই মধ্যে গাজার মানুষদের আরও বেশি করে ভিসা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কানাডা। অন্তত ৫ হাজার গাজার নাগরিককে ভিসা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো। আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ভয়াবহ মানবাধিকার হরণ হয়েই চলছে গাজায়। অনাহার, মাথার উপর ছাদ নেই, নেই ওষুধ বাব ন্য়ূনতম চিকিৎসার সুযোগ। সেই সব কিছু মাথায় নিয়েই মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছেন বাসিন্দারা, কিংবা আর কয়েক দিনের আয়ুভিক্ষা করছেন ইজরায়েলি সেনার কাছ থেকে। কবে ঠিক হবে পরিস্থিতি, তার উত্তর নেই। নেতানিয়াহু যতই মুখে ভুল স্বীকার করুন না কেন, যুদ্ধ থামানোর কথা বা সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ পর্যন্ত একবারের জন্যেও শোনা যায়নি নেতানিয়াহুর মুখে। যা দেখে শুনে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ বলছে, এ সবই আসলে কৌশল মাত্র, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। আদৌ আগ্রাসন কমানোর পথে হাঁটার কথা মাথাতেও আনছে না ইজরায়েল।