গাজায় সাদা ফসফরাস ছড়াচ্ছে ইজরায়েল! কতটা মারাত্মক এই 'নিষিদ্ধ অস্ত্র'?
Israel White Phosphorus Attack : সাদা ফসফরাস মানুষকে সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিতে পারে, এমনকী হাড় পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলতে পারে কারণ এটি অত্যন্ত দ্রবণীয়।
যুদ্ধের কোনও আইন নেই, কোনও সংবিধানও না। যুদ্ধে সবকিছুই ফেয়ার, যুদ্ধে অস্ত্রসজ্জিত যে সারিতে, সেই একই সারিতেই থাকে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। যুদ্ধে কেউ মারে আর কেউ মরে, এটুকু সত্য। তরোয়ালে গলা কাটাও যা, বোমা ফাটানোও তাই, বিষাক্ত গ্যাসও তাই। গাজা এবং লেবাননে সামরিক অভিযানে ইজরায়েল প্রথমে জানিয়েছিল কোনও সাদা ফসফরাস ব্যবহার করা হয়নি। অথচ সত্য একেবারেই অন্য। নিরস্ত্র নাগরিকদের জীবন একেবারে গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে ফেলতে সাদা ফসফরাসের ঢালাও ব্যবহার করেছে ইজরায়েল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হামাসের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের লড়াইয়ে সাদা ফসফরাস ব্যবহার নিয়ে চমকে দেওয়া সত্য প্রকাশ করেছে। গত ৯ এবং ১০ অক্টোবর লেবানন এবং গাজায় তোলা কিছু ভিডিওতে গাজা শহরের বন্দর এবং ইজরায়েল-লেবানন সীমান্ত বরাবর দু'টি গ্রামের আকাশে কামান-চালিত সাদা ফসফরাসের একাধিক বায়ু বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছে। এই ভিডিওগুলির সত্যতা যাচাই করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং দু'জন এমন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারও নিয়েছে যারা গাজায় ওই সাদা ফসফরাস হামলার বর্ণনা দিয়েছেন।
সাদা ফসফরাস অনেক সময় কোনও কিছু চিহ্নিত করতে, কোনও সংকেত দিতে বা কিছু ঢেকে দিতে ব্যবহার করা হয়। এই নিরীহ ব্যবহারগুলির পাশাপাশিই আগুন জ্বালানোর অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সাদা ফসফরাস। জড় ও জীব সবকিছুই পুড়িয়ে দিতে পারে এই সাদা ফসফরাস। মানুষকে মারাত্মকভাবে পুড়িয়ে ফেলতে তো পারেই, পাশাপাশি পরিকাঠামো এবং অন্যান্য নাগরিক বস্তুতেও আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। গাজা পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। এখানে সাদা ফসফরাসের ব্যবহার সাধারণ নাগরিকদের কতটা মৃত্যুর মুখে ফেলেছে বুঝে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। অথচ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে রয়েছে, কোনও শক্তিই নিরস্ত্র নাগরিকদের এমন সঙ্কটে ফেলতে সাদা ফসফরাসের মতো দ্রব্য ব্যবহার করতে পারে না! আইনকে থোড়াই ডরায় যুদ্ধ?
আরও পড়ুন- গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলি রকেট! রোগীদের ছিন্নভিন্ন দেহ গুনছে প্যালেস্তাইন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার পরিচালক লামা ফাকিহ বলছেন, জনাকীর্ণ কোনও আবাসিক এলাকায় সাদা ফসফরাস ব্যবহার করা হলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায় এবং আজীবন কষ্টের একটা বড় ঝুঁকি থেকেই যায়। বেআইনিভাবে, নির্বিচারে যখন জনবহুল শহুরে এলাকায় বায়ু বিস্ফোরণের মাধ্যমে সাদা ফসফরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয় তখন ঘরবাড়ি সহজেই পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে এবং সাধারণ মানুষদেরও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
১১ অক্টোবর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গাজা শহরের আল-মিনা এলাকার দু'জনের সাক্ষাৎকার নেয় ফোনে। সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে হামলার বর্ণনা দিয়েছিলেন ওই প্রত্যক্ষদর্শীরা। একজন তখন রাস্তাতেই ছিলেন, অন্যজন ছিলেন পাশের অফিসে। দু'জনেই আকাশে বিস্ফোরণ দেখেন। আকাশ থেকে মাটির দিকে ধেয়ে আসা সাদা রেখা দেখতে পান তারা। ঘন সাদা ধোঁয়া এবং রসুনের গন্ধ হচ্ছে সাদা ফসফরাসের মূল বৈশিষ্ট্য। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে কোনও এক সময় এই সাদা ফসফরাস হামলাটি ঘটে বলে জানাচ্ছেন তারা। দু'জনেই জানিয়েছেন, সাদা ফসফরাসের গন্ধ দম বন্ধ করা। যে ব্যক্তি অফিসে ছিলেন, তিনি জানান গন্ধ এতটাই তীব্র ছিল যে কী ঘটছে তা দেখতে তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকান এবং দেখেন একাধিক সাদা রেখা নেমে আসছে আকাশ থেকে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গাজার ভিডিওগুলি খতিয়ে দেখে জানায় এগুলি গাজা শহরের বন্দরে তোলা হয়েছিল। এয়ার স্ট্রাইকে ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্রগুলি ছিল এয়ারবার্স্ট ১৫৫ মিমি হোয়াইট ফসফরাস আর্টিলারি প্রজেক্টাইল। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যাচাই করা অন্যান্য ভিডিওগুলিতেও একই জায়গা দেখা গিয়েছে৷ ইজরায়েল-লেবানন সীমান্তের কাছেও দু'টি জায়গা থেকে মেলা ভিডিওতে ১৫৫ মিমি হোয়াইট ফসফরাস আর্টিলারি প্রজেক্টাইল ব্যবহার করার প্রমাণ মেলে।
বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে সাদা ফসফরাস জ্বলে ওঠে এবং অক্সিজেন নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তীব্র তাপ (প্রায় ৮১৫°সেলসিয়াস), আলো এবং ধোঁয়া তৈরি হতে পারে। সাদা ফসফরাস মানুষকে সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিতে পারে, এমনকী হাড় পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলতে পারে কারণ এটি অত্যন্ত দ্রবণীয়। তাই চর্বি এবং মানুষের মাংসে মিশে শেষ করে দিতে পারে। সাদা ফসফরাসের টুকরো চিকিৎসার পরেও ক্ষতের মধ্যে থেকে গিয়ে তা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সারা ফসফরাস রক্তের প্রবাহে প্রবেশ করে এবং একাধিক অঙ্গ বিকল করতে পারে। ড্রেসিং করে হয়তো ক্ষত সারানো হলো। কিন্তু সেই ক্ষত ফের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই আবার আগুন জ্বলতে পারে। ছোটখাটো পোড়াও মারাত্মক হতে পারে। যারা প্রাণে বাঁচলেন, ব্যাপক ক্ষত তাঁদের পেশির টিস্যুকে শক্ত করে ফেলে এবং শারীরিকভাবে অক্ষম করে দেয়। পাশাপাশি ট্রমা, চেহারা পালটে দেওয়া ক্ষতের দাগ মানুষকে মানসিক ও সামাজিকভাবেও শেষ করে দেয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সাদা ফসফরাস ব্যবহার আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে নাগরিকদের আঘাত ও প্রাণহানি এড়ানোর সম্ভাব্য সকল সতর্কতাকেই লঙ্ঘন করেছে। বায়ু বিস্ফোরণের মাধ্যমে ১২৫ থেকে ২৫০ মিটার ব্যাসের এলাকাতে নানা পদার্থের মধ্যে ১১৬ টি জ্বলন্ত ধারালো বড় পেরেকের মতো অংশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে স্থানীয় বিস্ফোরণের চেয়ে ঢের বেশি নাগরিকের মৃত্যু এবং পরিকাঠামো ধ্বংস হতে পারে।
আরও পড়ুন- ইজরায়েলের ডানপন্থী সরকার প্যালেস্তাইনের হামাস, দুইয়ের পতন চাই
ইজরায়েল কর্তৃপক্ষ অবশ্য সাদা ফসফরাস ব্যবহার করেছে কি না সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। ৭ অক্টোবর হামাস জঙ্গিগোষ্ঠী মারাত্মক আক্রমণ চালায় ইজরায়েলে। ভয়াবহ রকেট হামলায় সেই দেশের ১৩০০-র বেশি মানুষ মারা যান। বহু ইজরায়েলিকে অপহরণও করা হয়েছে। ইজরায়েল এই হামলার প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হানলা চালায়। গাজায় ইজরায়েলের ব্যাপক বোমাবর্ষণে ১,৫০০ জনেরও বেশি প্যালেস্তানিয় মানুষ মারা গেছেন এবং ৩৩৮,০০০- এরও বেশি মানুষ ঘরহারা হয়েছেন। ইজরায়েলি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেই গাজায় বিদ্যুৎ, জল, জ্বালানি এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানাচ্ছে, ২০০৯ সালের সংঘাত সহ, গাজায় এর আগে বহুবারই ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী সাদা ফসফরাস ব্যবহার করেছে। সাদা ফসফরাসের ধোঁয়ার শেলগুলির মতোই সহজলভ্য এবং কম মারাত্মক অন্য বিকল্প কিন্তু রয়েছে। এর মধ্যে কিছু আবার ইজরায়েলি নানা কোম্পানিই তৈরি করে। এই বিকল্পগুলির প্রভাব একই কিন্তু তা সাধারণ মানুষের ক্ষতি কম করে। ২০১৩ সালে, গাজায় সাদা ফসফরাস ব্যবহার সংক্রান্ত ইজরায়েলের হাইকোর্ট অফ জাস্টিসের একটি আবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, জনবহুল এলাকায় আর সাদা ফসফরাস ব্যবহার করবে তারা। শুধুমাত্র দু'টি পরিস্থিতিতে তাদের ছাড় দিতে হবে। কোন পরিস্থিতি? তা কেবল বিচারপতিদের কাছেই প্রকাশ করে বাহিনী। আদালতের রায়ে, বিচারপতি এডনা আরবেল বলেছিলেন, 'অত্যন্ত বিশেষ পরিস্থিতিতে, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে সাদা ফসফরাসের ব্যবহার করবে বাহিনী"। কতটা বিশেষ পরিস্থিতি হলে এমন ভয়াবহ 'অস্ত্র' ব্যবহার করা যায়, কতটা বিশেষ পরিস্থিতিতে সাদা ফসফরাস ব্যবহার করব না বলেও করা যায়? যুদ্ধে অবশ্য কেই বা কাকে কথা দিয়ে কথা রেখেছে?