বন্ধ বিদ্যুৎ, জল, নির্বিচারে মরছে শিশুরা! প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের পাল্টা হামলার ফল কী?

Israel Palestine War : এর আগে যত হামলা হয়েছে, তাতে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী নিয়মিত একটি কৌশল ব্যবহার করত। একে ইজরায়েল বলে ‘রুফ নকিং’।

কোনওরকমে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে, ছোট করে লুকিয়ে আছেন মানুষ। লুকিয়ে আছেন বোমার থেকে, রকেটের থেকে। নাকে অন্য কোনও ঘ্রাণ নেই, কেবল রক্তের ভ্যাপসা উত্তাপ, আর বারুদের গন্ধ। সাধারণ মানুষের বাড়ি, যোগাযোগ পরিকাঠামো লক্ষ্য করে ক্রমাগত বোমা হামলা চলছে। গাজার সাধারণ মানুষরা কোনদিকে যাবেন! ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা লক্ষ্য করে ক্রমাগত চলছে বোমা বর্ষণ। যে কোনও মুহূর্তে গুঁড়িয়ে যেতে পারে নিজের বসতি, শেষ হয়ে যেতে পারেন নিজেরাই। নিজের জানালা দিয়ে বোমার ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছেন বছর একুশের রামা আবু আমরা। গাজা শহরের দক্ষিণ অংশ থেকে টেলিফোনে কথা বলছেন তিনি, হঠাৎ কাছাকাছি বিস্ফোরণের তুমুল শব্দ। রামা আবু কেঁপে উঠছেন, কেঁপে উঠছেন তাঁর মতো অজস্র তরুণী, অজস্র শিশু, বৃদ্ধ। মৃত্যুর অপেক্ষা যেন।

অনবরত চারপাশে বোমা পড়ছে, কোথায় যে পড়ছে ঠাহরও করা যাচ্ছে না। কেবল ধোঁয়া দেখে আর বারুদের গন্ধ পেয়ে বুঝে নিতে হচ্ছে, প্রাণ গেল আরও খানিক মানুষের। টানা তিন দিন ধরে এই জীবনই কাটাচ্ছেন গাজার মানুষ। অনেকেই বুঝতে পারছেন না, আদৌ বাস্তবে এমন ঘটছে?

সীমান্তবর্তী দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরগুলিতে হামাসের সদস্যদের সঙ্গে লড়াই করার সময় ইজরায়েলি বাহিনী গাজা উপত্যকায় হামলা করে। শনিবার হামাস জঙ্গিদের নজিরবিহীন আগ্রাসনের পর বিমান হামলা চালানো হয়। হামাসের আক্রমণে প্রাণ যায় ৮০০-রও বেশি সাধারণ ইজরায়েলি নাগরিকের। অন্তত ১০০ জন মানুষকে বন্দি করে রেখেছে হামাস। প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় পাল্টা ইজরায়েলি বিমান হামলায় শিশুসহ ৫৬০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত অন্তত ২,৯০০ জন। বিদ্যুত বন্ধ, খাবার আর জ্বালানিও ঢুকবে না গাজাতে। মানুষ জানে মরবে, ভাতেও মরবে, সেই পথেই এগোচ্ছে ইজরাউএল আর প্যালেস্টাইনের এই যুদ্ধ।

আরও পড়ুন- নকল বাসিন্দা সাজিয়ে সীমান্তে হত্যার মহড়া! যে ভাবে তিলে তিলে ইজরায়েলে হামলার ছক কষে হামাস

ইজরায়েলের পরিকাঠামো মন্ত্রী ইজরায়েল কাটজ বলেছেন ইতিমধ্যেই তিনি গাজায় জল সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। গাজা স্ট্রিপ একফালি ভূখণ্ড যেখানে আনুমানিক ২.৩ মিলিয়ন মানুষ বাস করেন। এই এত মানুষের প্রায় অর্ধেকই শিশু। জল বন্ধ, খাবার বন্ধ, প্রাণ শেষ করার এর চেয়ে মর্মান্তিক উপায় আর কীই বা। গাজার আল মেজান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠন মনে করছে ২ মিলিয়ন প্যালেস্টাইনবাসীকে যে 'শাস্তি' দেওয়া হচ্ছে তা নজিরবিহীন যুদ্ধাপরাধ। গত ১৬ বছর ধরে গাজার এই অঞ্চলটিতে জীবন বলে কিছুই নেই। নিরন্তর যুদ্ধ, নিরন্তর ইজরায়েলি বোমা হামলা। ইতিমধ্যেই সেখানে জীবনযাপনের প্রাথমিক কাঠামোই ভেঙে পড়েছে। তার উপর জ্বালানি, নির্মাণসামগ্রী, ওষুধ ও খাদ্যের সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমানোর ফলে বাঁচার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

গাজার বাসিন্দাদের আশঙ্কা, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার ফলে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে, তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতাও কমে যাবে যার ফলে গাজার মানুষ ঠিক কেমন আছেন, জানতেও পারবে না বাকি বিশ্ব, সাহায্যও করবে না বাকি বিশ্ব। এমনিতেই সেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা স্বাভাবিক নয়। কয়েক ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট কার্ড ব্যবহার করার সুযোগ মেলে, তাও আবার নেটওয়ার্কের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়রা কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কিনা খবর মিলছে না। কোনও বিদ্যুৎ নেই, ফলে ফোনে চার্জও নেই।

তুরস্কের এক সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে, গাজা উপত্যকার বিশাল অঞ্চলে টেলিফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কারণ ইজরায়েলি জেটগুলি প্যালেস্টাইন টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির একটি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে।

আরও পড়ুন- পবিত্র দিনেই কেন খুন ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ? কারা এই হামাস, কী-ই বা তাদের লক্ষ্য?

ইজরায়েল গাজার নাগরিকদের উত্তরের আশেপাশের এলাকাগুলি খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। ইজরায়েলের দাবি, তাদের বাহিনী হামাসের কেন্দ্র এবং সদস্যদের নিশানায় রেখেছে। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠী ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইনের আয়েদ আবু ইকতাইশ জানাচ্ছেন, গাজার আবাসিক ভবনগুলিকে লক্ষ্য করেই বোমা হামলা চালানো হচ্ছে। ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী আবাসিক ভবনগুলিকেই লক্ষ্যবস্তু করছে। সাধারণ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।

এর আগে যত হামলা হয়েছে, তাতে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী নিয়মিত একটি কৌশল ব্যবহার করত। একে ইজরায়েল বলে ‘রুফ নকিং’। এই রুফ নকিং পদ্ধতিতে একটি বাড়ি ধ্বংস হওয়ার আগে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সতর্কতা হিসাবে ছোট বোমা ফাটানো হতো। কিন্তু এবার গাজা উপত্যকা জুড়ে কোনও সতর্কতা বা বার্তা ছাড়াই বোমা ফেলা হয়েছে বাড়িগুলিতে। জাতিসংঘ এর আগে জানিয়েছিল গাজায় কমপক্ষে ১২৩,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বলা বাহুল্য, আগামী দিনে এই সংখ্যাটি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।

প্যালেস্টাইন আর ইজরায়েলের এই লড়াই নতুন কিছু নয়। নতুন নয় ওই এলাকার মানুষদের জীবন ভেস্তে যাওয়াও। হামাস ১৯৭৩ সালের বদলা নিয়েছে, ইজরায়েল পাল্টা আক্রমণ করেছে। দুই এলাকার মানুষ কি মরে যেতে চেয়েছিলেন আসলে? চেয়েছিলেন ধর্ষিত হতে, ধর্ষণের ভিডিও হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে চেয়েছিলেন? শিশুরা বোমার গন্ধ শুঁকে বড় হতে চেয়েছিল? জমি দখলের লড়াইয়ে জমির বাসিন্দারা মরেছেন, আর মাথারা? প্রশ্ন সহজ। উত্তর খোঁজার কাজ প্রকৃত সংবেদনশীল মনের।

 

More Articles