ঘুমের মধ্যেই তাবুতে নিথর ৪০ প্রাণ! কেন গাজার ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ই বারবার হামলা ইজরায়েলের?
Israel-Palestine conflict: গাজার উপর সাম্প্রতিক এই হামলাকে জঘন্যতম গণহত্যাগুলির মধ্যে একটি বলে চিহ্নিত করেছেন গাজার সিভিল ডিফেন্সের এক মুখপাত্র।
মানবতার কথা মাথায় রেখে পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচীর জন্য গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল ইজরায়েল। তবে সেই ক্ষণিকের শান্তিও খুব একটা শান্তিদায়ক হল না যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাবাসীর জন্য। সেই পর্ব মিটতে না মিটতে ফের রণংদেহী মূর্তি ইজরায়েলি সেনার। আবার গাজার নিরাপদ অঞ্চলে হামলা চালাল ইজরায়েলি সেনা। মঙ্গলবার ভোরের ভয়াবহ হামলায় অন্তত ৪০ জন নিরাপরাধ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর খবর মিলেছে। আহত অন্তত ৬০।
গত বছরের অক্টোবর মাসে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছিল ইজরায়েল। একটা বছর ঘুরে আরও এক অক্টোবর আসতে যায়। যুদ্ধ শেষ হয়নি গাজায়। একের পর এক হামলা, ক্ষতয় কার্যত গাজা শহর এখন শ্মশান। শহর জুড়ে যেদিকে তাকানো যায়, শুধু অস্থায়ী শিবির। যেখানে কোনও মতে মাথাটুকু গুঁজেছেন অসংখ্য বাসিন্দারা।
ইতিমধ্যেই গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪১ হাজার ছুঁয়ে ফেলেছে। জখম প্রায় ১ লক্ষের কাছাকাছি। সেখানকার স্কুল, হাসপাতাল, ধর্মস্থান, কোনও কিছুই আস্ত রাখেনি নেতানিয়াহু সেনা। হামাস জঙ্গি বধের নাম করে করে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে তারা। এখন নিশানা করা হচ্ছে গাজায় সেইসব নিরাপদ জায়গাগুলিকে, যাকে একদিন নিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ইজরায়েলি সেনাই।
আরও পড়ুন: ভয়াবহ হামলায় নিহত অন্তত ১৬, গাজার পর কেন ইজরায়েলের নিশানায় এবার সিরিয়া?
সাম্প্রতিক হামলাটি ঘটেছে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের আল মাওয়াসি এলাকার একটি ছাউনিতে। যেখানে ছিল অন্তত পক্ষে ২০টি তাবু। যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল অজস্র বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি। গাজার সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, ইদানীং এমন জায়গাগুলিতেই আঘাত হানছে ইজরায়েলি সেনা, যেসব জায়গায় এর আগে সাধারণ নাগরিকেদের আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল তারা।
ইজরায়েলি বাহিনীর তরফে অবশ্য বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, হামাসের একটি কম্যান্ড সেন্টারকে নিশানা করেই এই সাম্প্রতিক হামলাটি চালানো হয়। যে দাবি কার্যত উড়িয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হামাস। খান ইউনিস এলাকা ও তার সংলগ্ন রাফাতে স্থলআক্রমণের সময় এই উপকূলীয় অঞ্চলটিতে 'নিরাপদ' হিসেহবে চিহ্নিত করেছিল ইজরায়েল। তার পর থেকেই এই আল মাওয়াসি এলাকায় বাড়তে থাকে তাবু। ফিলিস্তিনিরা ভিড় জমাতে থাকেন ওই জায়গাটিতেই। এবার সেখানেই নামল ভয়াবহ আঘাত।
মঙ্গলবার ইজরায়েলি হামলায় ওই এলাকায় প্রায় ৩০ ফুট গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন হামলায়, কিন্তু জখম হয়েছে মারাত্মক ভাবে, তাদের খুঁজতে নেমে উদ্ধারকারী দল সেই গর্ত খুঁজে পায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ইজরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলি যখন মাথার উপর দিয়ে ঘাই মারছিল, রীতিমতো আগুন জ্বলছিল সেগুলিতে তখন। ওই সব এলাকায় যে সব যেসব কবর ছিল, মঙ্গলবারের হামলায় সেইসব কবর থেকে হাড়গোড় বেরিয়ে এসেছে। এখনও পর্যন্ত বহু মানুষ নিখোঁজ। ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়ার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে।
গাজার উপর সাম্প্রতিক এই হামলাকে জঘন্যতম গণহত্যাগুলির মধ্যে একটি বলে চিহ্নিত করেছেন গাজার সিভিল ডিফেন্সের এক মুখপাত্র। পরিস্থিতি এমনই যে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়েও গাজার সিভিল ডিফেন্স দলগুলি মৃতদেহগুলি উদ্ধার করতে পারছে না। এই হামলার কড়া নিন্দা করেছে আমেরিকার ইসলামিক রিলেশন কাউন্সিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগে কাঠগড়ায় ইজরায়েল। তার পরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের এখনও পশু হিসেবে বিবেচনা করে আসছে নেতানিয়াহু সেনা। যেন তারা প্রতি মুহূর্তে জবাইয়ের জন্য প্রস্তুত। জীবন-স্বাধীনতা এসব যেন বড় দূরতর দ্বীপ তাঁদের জন্য।
এদিকে ইজরায়েলের দাবি, সাম্প্রতিক এই হামলায় বেশ কয়েকজন হামাস জঙ্গি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা খান ইউনিসের এই হিউম্যানিটেরিয়ান এলাকায় গোপনে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র পরিচালনা করছিল। যদিও সেই দাবি অমূলক বলে জানানো হয়েছে হামাসের তরফে। ইজরায়েলের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, তারা নাকি হামলার আগে অসামরিক বাসিন্দাদের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা, আকাশপথে নজরদারি কিংবা সুনির্দিষ্ট অস্ত্রের ব্যবহার সুনিশ্চিত করেছিল। তবে তাতে যে খুব একটা কাজের কাজ হয়েছে, তা দক্ষিণ গাজার এই অঞ্চলকে দেখে কেউ বলবে না।
আরও পড়ুন:ইজরায়েলি বোমা কেড়েছে সদ্যোজাত দুই সন্তান, স্ত্রী! শূন্যতা আগলে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ‘একা’ যুবক
এক বছর হতে যায়, গাজায় শান্তি ফেরা তো দূরের, যুদ্ধ থেকে সরে আসার কোনও সিদ্ধান্তও নেয়নি ইজরায়েল। একই সঙ্গে সিরিয়াতেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। এদিকে গাজায় শান্তি ফেরানোর ব্যাপারে সম্প্রতি সৌদি আরবের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে ভারত। সোমবারই ভারত গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের বৈঠকে যোগ দেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সেই বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, বাহারাইন, সৌদি আরব, ওমান, কাতার এবং কুয়েত। সেখানে এই সব উপসাগরীয় সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি উঠে আসে ইজরায়েলে গাজার আগ্রাসনের কথাও। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্তকে উদ্বেগ প্রকাশ করে জয়শঙ্কর বলেন, গাজায় মানবিক আইনের নীতিগুলি বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। যদিও ইজরায়েলে হামাসের ভয়ঙ্কর হামলার পর ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। তবে তার পরে ইজরায়েলি আগ্রাসন দেখে ক্রমশ নিজেদের অবস্থান বদলায় নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে ভারতের বর্তমান অবস্থান নীতিগত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই মন্তব্য করেন বিদেশমন্ত্রী। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ ও অপহরণ করে বন্দি বানানোর ঘটনার নিন্দা করে জয়শঙ্কর এ-ও জানান, গাজায় অসংখ্য সাধারণ মানুষের ক্রমাগত মৃত্যুতে ভারত গভীর ভাবে ব্যথিত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভারত, জানান বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
এদিকে সিরিয়ায় একদিন আগে রক্তক্ষয়ী হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল। সেই হামলায় অন্তত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর মেলে। তার পরে পাল্টা হামলার হুমকি দিয়ে রেখেছে ইরানও। ইজরায়েলে টানা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। সব মিলিয়ে ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ, হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের এই যুদ্ধে উলুখাগড়ার মতো মরছে গাজা, সিরিয়ার মানুষ। কমে থামবে এই মৃত্যুমিছিল? সেই উত্তর অধরা আজও।