ভুলস্বীকার নাটকই! রাফাহ শহর ধ্বংস করেই থামবে ইজরায়েল?

Israel Hamas War: রবিবারের ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের পর নেতানিয়াহুর ভুলস্বীকার যে রঙ্গমঞ্চের নাটক মাত্র তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইজরায়েলি সেনার আগ্রাসন। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা।

মে মাসের গোড়া থেকেই গাজার রাফাহ শহরে লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। প্রায় প্রতিদিনই একজন-দু'জন করে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হচ্ছে ইজরায়েলি হামলায়। দুদিন আগে ইজরায়েলের বিমান হামলার ফলে আগুন ছড়ায় বাস্তুচ্যুত, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া গাজাবাসীর তাবুতে। সেই আগুন লেলিহান রূপ নিয়ে মুহূর্তে পোড়াতে থাকে একের পর এক তাবু। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয় ৪৫ জন নিরপরাধ মানুষের। জখম হয় বহু। তার পরেই পার্লামেন্টে ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানান, সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। সে জন্যই রাফাহ থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার সর্বৈব চেষ্টা করেছে ইজরায়েলি সেনা। এই দুর্ঘটনাকে তাই 'ট্র্যাজিক মিসটেক' বলেই ভুল স্বীকার করেছেন নেতানিয়াহু। আর এই অনুতাপের পর যে কিছুটা হলেও রাফাহতে আগ্রাসন কমাবে ইজরায়েল, তেমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আদতে তা হয়নি। বরং বুধবারও রাফাহর ঠিক কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে গিয়েছে ইজরায়েলি একগুচ্ছ ট্যাঙ্ক। সঙ্গে টহল ইজরায়েলি সেনার।

গোটা গাজাটাকেই শ্মশানে পরিণত করেছে অ্যাদ্দিনে ইজরায়েলি সেনা। সমগ্র গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত ঘরবাড়ি হারানো মানুষজনের শেষ আশ্রয় নিয়ে ছিল ওই রাফাহ শহর। কেবল ওই রাফাহটুকুই বেঁচে ছিল যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া গাজাবাসীর জন্য। সেটুকুকেও কেড়ে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এখন ইজরায়েল। ওই একরত্তি জায়গাতেই নাকি লুকিয়ে রয়েছে হামাস জঙ্গিরা। এমন একটা জায়গা থেকেই রাফাহ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটে নেতানিয়াহু সেনা। গাজার উপকূল ধরে হেঁটে গেলে এখন দেখা যাবে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সার সার তাবু শুধু। ওটাই বাসস্থান এখন গাজাবাসীর। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে অস্বাস্থ্যকর শৌচের ব্যবস্থা। ত্রাণের লাইনে লম্বা ভিড় বড়োদের। ছোটরা মন দিয়ে আবর্জনা ঘাঁটে। যদি দু-এক টুকরো খাবার হাতে চলে আসে কোনও মতে।

আরও পড়ুন: ‘ট্র্যাজিক মিসটেক’! রাফাহতে গণহত্যার পর ভুলস্বীকার আসলে কোন কৌশল নেতানিয়াহুর?

গাজাবাসীর বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকু তলানিতে এসে পৌঁছেছে এতদিনে। সেই গত বছরের অক্টোবর থেকে লেগেই রয়েছে লড়াই। এখনও পর্যন্ত ৩৬ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে অসমান এই লড়াইয়ে। তার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য শিশু ও মহিলা। জখমের সংখ্যাটা আজ আর গুনে শেষ করা যায় না। প্রায় প্রত্যেকেই স্বজন হারিয়েছেন গাজায়। তা সত্ত্বেও প্রাণপন বাঁচার চেষ্টা করছেন, চেষ্টা করছেন টিকে থাকার। ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের হামলায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাফাহ-র কুয়েতি হাসপাতাল। হামলায় নিহত বহু স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক। কদিন ধরে লাগাতার গুলি, বোমা ও আকাশহানা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। কখনও তার জবাব দিয়েছে হামাস। জাবালিয়া ক্যাম্পের পশ্চিমে আল-ফালুজা এলাকা হয়ে উঠেছে গত ক'দিনে ওই হামলার কেন্দ্র। যেখানে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বহু নিরপরাধ মানুষ। রাতভর আকাশহানায় অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ গিয়েছে ৪৬ জনের। জখম শতাধিক।

রবিবারের ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের পর নেতানিয়াহুর ভুলস্বীকার যে রঙ্গমঞ্চের নাটক মাত্র তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইজরায়েলি সেনার আগ্রাসন। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা। আন্তর্জাতিক আদালতে গাজায় গণহত্যা চালানোয় অভিযুক্ত নেতানিয়াহু ও তার আমাত্যবর্গ। তাতে যে তাঁর কিছু যায় আসে না, তা ফের একবার বুঝিয়ে দিয়েছে রাফাহতে ইজরায়েলের গতিবিধি। সম্প্রতি এক ব্রিটিশ সংবাদপত্রের তদন্ত-রিপোর্টে জানা গিয়েছে, মোসাদের প্রাক্তন অধিকর্তা ইয়োলি কোহেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের আইনজীবী ফাতু বেনসুদাকে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে মামলা ও তদন্ত করার কারণে একাধিক হুমকি দিয়েছিলেন। সেই হুমকি চলেছিল দীর্ঘ গোপন বৈঠকে। সম্প্রতি বেনসুদার উত্তরসূরি করিম খান নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করেছেন।

এদিকে নেতানিয়াহুর ও তার আমাত্যবর্গের বিরুদ্ধে যে কোনও মুহূর্তে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারে আন্তর্জাতিক আদালত। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালতের প্রসিকিউটার করিম খান ঘোষণা করেন, হামাস ও ইজরায়েল- দু-পক্ষের বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছে। আর তাতেই ক্রুদ্ধ ইজরায়েলের মিত্রদেশ আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দাবি, ইজরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার জন্য আইসিসি প্রসিকিউটরের এই আবেদন অশোভন। তাঁর মতে, হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের তুলনা করা যায় না। একই সঙ্গে ইজরায়েলের পাশে যে যে কোনও পরিস্থিতিতেই আমেরিকা রয়েছে, তা-ও পরিষ্কার করে দেন বাইডেন। এখানেই শেষ নয়। আরও এক ধাপ এগিয়ে বাইডেন এ-ও বলেছেন, গাজায় যা ঘটছে, তা কোনও মতেই গণহত্যা নয়। এর জন্য আইসিসি-র প্রসিকিউটারের ঘোষণা লজ্জাজনক বলেও জানান মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক।

এদিকে রাফাহ-তে ইজরায়েলের হামলার মধ্যে আবার মিশরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে নেতানিয়াহু সেনা। সোমবার রাতে ইজরায়েলি হামলায় দক্ষিণ গাজার রাফাহ সীমান্তে এক মিশরের সেনা নিহত হয়। ইজরায়েলের আগ্রাসনের ইতিমধ্যেই জবাব দিয়েছে কায়রো। প্রাণ বাঁচাতে রাফা সীমান্তে জড়ো হওয়া প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের সোমবার উপরে নির্বিচারে গুলি ও বোমাবর্ষণ করে ইজ়রায়েলি সেনা এবং বিমানবাহিনী। সে সময় নারী ও শিশু-সহ প্রায় ৫০ জন প্যালেস্টাইনির পাশাপাশি এক মিশরীয় সেনাও নিহত হন। পাল্টা গুলি চালায় মিশরের সেনাও। ঘটনার কথা স্বীকার করে নিয়ে মঙ্গলবার ইজ়রায়েলি সামরিক বাহিনী। ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।

এরই মধ্যে মঙ্গলবার প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে সরকারি ভাবে মর্যাদা দিয়েছে নরওয়ে, স্পেন ও আয়ারল্যান্ড। গত সপ্তাহে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল তারা। ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৪৫টি দেশ প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা মেনে নিল। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির মধ্যেই টানাপড়েন শুরু হয়েছে। তালিকায় লিকায় অবশ্য নেই আমেরিকা, কানাডা, পশ্চিম ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। যদিও গাজাবাসীর জন্য পাঁচ লক্ষ ভিসা দেওয়ার কথা বলেছে কানাডা। এই সব দেশের তরফে স্বাধীন স্বীকৃতি পেলে কি হাল ফিরবে প্যালেস্টাইনের? সত্যিই ইজরায়েলের আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচতে পারবে দেশ? আয়ারল্যান্ডের বিদেশমন্ত্রী মিখায়েল মার্টিন জানাচ্ছেন, মানবাধিকার আইন মেনে না চললে ইজ়রায়েলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে আয়ারল্যান্ড ও তার মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি। এই দেশগুলি হল সুইডেন, সাইপ্রাস, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, পোলান্ড, স্লোভাকিয়া ও বুলগেরিয়া। স্লোভেনিয়া ও মল্টা জানিয়েছে, তারাও একই পথে হাঁটছে। আন্তর্জাতিক আদালতের কড়াকড়ি, এত এত দেশকে পাশে পেয়ে আদৌ সুদিন ফিরবে কি প্যালেস্টাইনের? সে কথা অবশ্য এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কারণ অতীতেও এই সব বিধিনিষেধের পরোয়া করেনি ইজরায়েল। এদিকে ইউরোপের একাধিক দেশ ইজরায়েলের পক্ষে কথা বলে চললেও, সে দেশের নাগরিকরা কি সরকারের সেই সিদ্ধান্তে পাশে রয়েছে আদৌ। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে প্যালেস্টাইনের হয়ে প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরোঁ ইজরায়েলকে সমর্থন করা সত্ত্বেও রাফাহ-তে এই হামলার কড়া নিন্দা করেছেন নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে।

ইজরায়েল প্রসঙ্গে সব সময় নিরাপদ একটা দূরত্ব রেখে গিয়েছে নয়াদিল্লি। না পক্ষে, না বিপক্ষে, এমন একটা অবস্থানে থেকেছে ভারত সবসময়ে। এর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিপ্রস্তাবেও সই করতে দেখা যায়নি ভারতকে। তবে দেশে লোকসভা ভোট চলাকালীনই এবার গাজা প্রসঙ্গে সরব হলেন দেশের বলিউড তারকারা। কার্যত এই প্রথম বলিউডকে মাথা ঘামাতে দেখা গেল ইজরায়েল-গাজা দ্বন্দ্ব নিয়ে। রাফাহ-তে যে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চালাতে উদ্যত হয়েছে ইজরায়েল সরকার, 'অল আইজ অন রাফাহ' হ্যাশট্যাগে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, এক্স-সহ সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড হতে দেখা গেল প্রতিবাদ। 'অল আইজ অন রাফাহ' লেখা একটি এআই ছবি ইতিমধ্যেই ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখনও পর্যন্ত কয়েক কোটি বার শেয়ার হয়ে গিয়েছে সেই পোস্ট। আলিয়া ভট্ট থেকে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া জোনাস, তৃপ্তি দিমরি, করিনা কাপুর, সামান্থা প্রভু, ফতিমা সানা শেখ, স্বরা ভাস্কর, দিয়া মির্জার মতো বলি তারকারা শেয়ার করেছেন ছবিটি। রবিবার রাফাহ শহরে শরণার্থী শিবিরের তাবুতে যে ভয়ঙ্কর হত্যালীলা চালিয়েছে ইজরায়েলি সেনা, তার প্রতিবাদেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে ওই পোস্টটি।

আরও পড়ুন:রাফাহতে ইজরায়েলের ভয়াবহ হামলার মধ্যেই নেতানিয়াহুর গ্রেফতারির আশঙ্কা! কোন পথে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত?

এরই মধ্যে আবার সেই পোস্ট শেয়ার করে বিতর্কে জড়িয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক রোহিত শর্মার স্ত্রী ঋতিকা সাজদেহ। নিজের ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে ওই ছবিটি শেয়ার করেছিলেন ঋতিকা। কিন্তু তাতে বেজায় খারাপ মন্তব্য আসতে শুরু করলে পোস্টটি সরিয়ে ফেলেন তিনি। শুধু ভারতীয় তারকাদের মধ্যেই, রাফাহ নিয়ে প্রতিবাদের স্বর শোনা গিয়েছে দেশি-বিদেশি বহু তারকার মধ্যেই। সেই তালিকায় রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ট্র্যাভিস হেড, ব্রিটিশ গায়ক লেই-অ্যান পিনক, মডেল বেলা হাদিদ এবং অভিনেত্রী সাওরসে-মনিকা জ্যাকসন এবং সুসান সারানডন-সহ অনেকেই। কবে ইজরায়েলের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হবে গাজা, সমগ্র প্যালেস্টাইন তা বলা কঠিন। আদৌ নেতানিয়াহুর কবল থেকে বাঁচবে কিনা রাফাহ শহর, তার মানুষজন, তা-ও বলা শক্ত। তবু পৃথিবীর প্রতিটা কোণা যেন চাইছে ম্যাজিক ঘটুক। যুদ্ধ থেমে যাক যে কোনও ভাবে। শুভবুদ্ধি ফিরে পাক ইজরায়েল।

More Articles