বোদাগঞ্জ থেকে মেটেলি, ডুয়ার্স ভ্রমণে যে ঐতিহাসিক মন্দিরগুলি দেখতেই হবে

Historical Temples of Dooars: বিগ্রহের নাম পেটকাটি মাতা। বিগ্রহটি একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর। কালো পাথরে তৈরি মূর্তিটি আসলে বজ্রযানী বৌদ্ধ দেবী 'চচিকা'।

জলপাইগুড়ি-ডুয়ার্সের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। কিছু পরিচিত, কিছু অতি স্বল্প পরিচিত। আসুন, এক ঝলক চোখ বোলানো যাক ডুয়ার্সের কিছু ঐতিহাসিক মন্দিরে─

ভ্রামরী দেবীর মন্দির

বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলের মধ্যে তৈরি ভ্রামরী দেবীর মন্দির উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের কাছে পবিত্র স্থান। প্রতিদিনই এ'খানে ভক্তরা ভিড় করেন। কালী পুজো কিংবা অন্যান্য পার্বনের দিনে ভিড় উপচে পড়ে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি বাজারও তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই সতীপীঠ খুব জাগ্রত। মূল মন্দিরে প্রবেশ পথে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি আছে। মূলমন্দিরে দেবীমূর্তি রয়েছে । দেবী অলঙ্কারে ভূষিত ও অষ্টভূজা । দেবীর সামনে বড় বড় কলস আছে। কলসের উপরে পুষ্পপত্র আছে । এর পাশে আছে পিতলের দেবী চরণযুগল। দেবীর ডানদিকে মহাদেবের মূর্তি আছে । এই কক্ষের নীচে কয়েক সিঁড়ি পরে মন্দিরের গর্ভগৃহ। দেবী সিংহবাহনী ও কৃষ্ণবর্না। সামনের বেদীতে রয়েছে দেবীর প্রস্তরীভূত বামপদ। শরত্‍কালে নবরাত্রির পূজা হয় মন্দিরে । দেবীর আরাধনা করতে প্রচুর ভক্ত আসে। এ'ছাড়াও এ'খানে বিভিন্ন পুজো হয়। মন্দিরে দূর্গা পূজা ও মাঘি পূর্নিমায় বিশেষ পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

জল্পেশ মন্দির

পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে দেবী সতীর বাম চরণ ত্রিস্রোতায় পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম ভ্রামরী, ভৈরবের নাম ঈশ্বর বা জল্পেশ। ভ্রামরীর মন্দিরের কথা আপনাদের জানিয়েছি। এইবারে জল্পেশ মন্দির। তিস্তা ব্রিজ পার করে ময়নাগুড়ি এলাকার দুর্গাবাড়ি মোড় থেকে ডানদিকে এগোলে জল্পেশ মন্দির। জরদা নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা অসমরাজ জল্প। পরে, কোচবিহারের মহারাজা প্রাণ নারায়ণ ও মোদনারায়ণ মন্দিরটি দিল্লি থেকে শিল্পী এনে মন্দিরটির পুনঃনির্মাণ করেন। জুলাই-অগাস্ট মাসে ভগবান শিবের কাছে বিশেষ পূজা করার জন্য, ফেব্রুয়ারি-আগস্ট মাসে শ্রাবণী মেলায় তীর্থযাত্রীরা আসে। সপ্তদশ শতকে মন্দির পুনঃনির্মাণের পর থেকেই এখানে ফাল্গুন শিব রাত্রিতে বিখ্যাত মেলার সূচনা। সেই দিক থেকে মেলাটি গোটা রাজ্যেরই প্রাচীন মেলাগুলির অন্যতম। মেলাতে কয়েক লক্ষ লোকের সমাগম হয়।

আরও পড়ুন: কুখ্যাত মিহির সর্দারের ডেরা থেকে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মন্দির, কেন এত জাগ্রত হুগলির সিদ্ধেশ্বরী কালী?

জটিলেশ্বর মন্দির

জল্পেশের থেকে ৬ কিমি দূরত্বে চূড়াভাণ্ডার গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই জটিলেশ্বর মন্দির। সপ্তরথ নক্সার এই মন্দিরটির স্থাপত্যকলাও অনিন্দ্য। মন্দির মন্দির দেওয়ালের বাইরে অসংখ্য যক্ষিনী মূর্তি, গনেশ, বুদ্ধ, কুবেরের মূর্তি। এ'খানে শিবলিঙ্গ হল জল লিঙ্গ। অর্থাৎ শিবলিঙ্গ এখানে গর্তের মধ্যে থাকে। যাকে অনাদিও বলা হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এখানকার বিষ্ণুপটটিকে 'অমূল্য সম্পদ' বলেছেন। সেটি রাজ্য সরকারের প্রত্নবিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। মন্দিরের প্রবেশপথে দ্বারপাল মূর্তি দুটিও দর্শনীয়। মন্দিরের পুবদিকে ১৫ বিঘার এক বিরাট পুকুর রয়েছে। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসবেও জল্পের নাম উঠে আসে।

পেটকাটি মন্দির

ময়নাগুড়ি হাসপাতালের কাছেই মরাখাওয়া নদীর তীরে একটি প্রাচীন কালীমূর্তি উদ্ধার করেছিলেন বেঙ্‌কান্দি গ্রামের লোকেরা। সেখানে এখন টিনে ছাওয়া পাকা দেওয়ালের মন্দির। মন্দিরটির চারপাশে প্রাচীর রয়েছে। বিগ্রহের নাম পেটকাটি মাতা। বিগ্রহটি একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর। কালো পাথরে তৈরি মূর্তিটি আসলে বজ্রযানী বৌদ্ধ দেবী 'চচিকা'। দশভূজা বিগ্রহের ডান দিকের ও বাম দিকের দুটি করে হাত ভাঙা। ডান দিকের হাতে হাতি, কঙ্কাল, বাদ্যযন্ত্র, বাম দিকের হাতে ঘণ্টা, ছিন্নমুণ্ড ও শবদেহ। দেবীর গলায় সাপ, কর্ণাভরণ এবং মুকুটেও জড়িয়ে রয়েছে সাপের অবয়ব। পদপ্রান্তে বসে আছেন যক্ষিনী। একদিকে শেয়াল, অন্যদিকে ময়ূর। পদ্মাসনা দেবীর নাকটি ভাঙা। বক্ষদেশের নিচে পাঁজরে বৃশ্চিকমূর্তি। দেবীর উদর কঙ্কালসার। সম্ভত তার থেকেই নাম হয়েছে পেটকাটি।

মন্দির প্রাঙ্গণে প্রচুর পাথর ইতস্তত ছড়ানো। জটিলেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে এগুলির সাযুজ্য রয়েছে। মন্দিরটিকে চালু বিভিন্ন ধরনের কাহিনিও।

মেটেলি কালীবাড়ি

চালসা থেকে পাহাড়ি চড়াই পথে সামসিং। মেটেলিকে বলা হয় ডুয়ার্সের রানি। চারিদিকে শুধুই সবুজ আর সবুজ। দিগ্নত পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চা-বাগানের মাঝখান দিয়ে একফালি রাস্তা। মেটেলি চৌপথিতে থানার পাশেই রয়েছে ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি কালীবাড়ি। একশ বছর পরে ১৯৭২ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কালিকানন্দ অবধূতের 'বশীকরণ' বইটিতে এই কালীবাড়ির মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। মেটেলি কালীবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছিল চা-বাগানের ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবে। সংলগ্ন ১২টি চা-বাগানের কর্মীরা বিভিন্ন পূজা-পার্বণে, বিশেষত দুর্গাপুজোর সময়ে মন্দির প্রাঙ্গণে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই দিক থেকে মন্দিরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম।

More Articles