অ্যাসিস্টেড সুইসাইড করেছেন গোদার! ঠিক কেমন এই স্বেচ্ছামৃত‍্যুর ধরন?

Jean Luc Goddard died by assisted suicide: অ্যাসিস্টেড সুইসাইড আসলে কী?

প্রয়াত ফ্রেঞ্চ-সুইস সিনেমা পরিচালক জঁ লুক গোদার। মৃত‍্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তাঁর পরিবারেরই এক প্রতিনিধির তরফে জানা যাচ্ছে, তিনি মৃত‍্যুবরণ করেছেন অ্যাসিস্টেড সুইসাইড বা স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সিনেমাকে আমূল বদলে দেওয়া গোদার স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করলেন সুইজা়রল্যান্ডে। এমন একটি দেশ, যেখানে স্বেচ্ছামৃত্যু বা অ্যাসিস্টেড সুইসাইড আইনসিদ্ধ। গোদারের আইনি সহায়ক একথাও জানিয়েছেন, বিবিধ 'প‍্যাথোলজিক‍্যাল সমস্যা'-য় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন প্রবীণ পরিচালক, এই কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গোদার।

অ্যাসিস্টেড সুইসাইড কী?
ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস-এর সূত্রে জানা যাচ্ছে, অ্যাসিস্টেড সুইসাইড বা স্বেচ্ছামৃত্যু হলো এমন একটি ঘটনা, যেখানে একজন ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির সহায়তায় আত্মহত্যা করে। ধরা যাক, কোনও ব্যক্তি কঠিন অসুখে ভুগছেন এবং তাঁর শারীরিক অবস্থা সংকটজনক। এমন অবস্থায় তিনি হয়তো তাঁর নিকট-আত্মীয়কে তাঁর মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত জানিয়েই, তাঁর থেকে কড়া ডোজে়র ঘুমের ওষুধ নিলেন। যে ওষুধের প্রভাবে তিনি মারা যাবেন।

ইউথেনেশিয়া কী?
ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস-সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইউথেনেশিয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি, (যেমন চিকিৎসক) শারীরিকভাবে সংকটজনক রোগীকে তাঁর (দ্বিতীয় ব্যক্তির) জ্ঞাতসারেই এমন কোনও ওষুধ দেন, যার প্রভাবে সেই রোগী মারা যাবে।

আরও পড়ুন: সিনেমা বানাতে লাগে কেবল মহিলা এবং বন্দুক, কেন একথা বলেছিলেন জঁ লুক গোদার

ইউথেনেশিয়ার আবার প্রকারভেদ রয়েছে। প্রথম প্রকারটি হলো, ভলেন্টেয়ারি ইউথেনেশিয়া; অর্থাৎ যেখানে রোগী নিজের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিজেই নেন এবং তার জন্য ডাক্তার বা দ্বিতীয় ব্যক্তির সাহায্য নেন।  আরেকটি প্রকার হলো, যেখানে রোগী নিজের চিকিৎসা এবং মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিজে নিতে অপারগ (ধরা যাক রোগী কোমাচ্ছন্ন), সেক্ষেত্রে রোগীর হয়ে তাঁর (রোগীর) আত্মীয় বা বন্ধুস্থানীয় কেউ রোগীর মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেন। এবং ডাক্তার বা দ্বিতীয় ব্যক্তি সেক্ষেত্রে রোগীর ইউথেনেশিয়ার জন্য যাবতীয় আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের সঙ্গে ইউথেনেশিয়ার পার্থক্য কোথায়?
তাহলে অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের সঙ্গে ইউথেনেশিয়া-র পার্থক্য কোথায়? ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল-এর চিকিৎসা-সংক্রান্ত নীতি ও আইনের অধ্যাপক রিচার্ড হাক্সটেবলের মতে, "অ্যাসিস্টেড সুইসাইড এবং ইউথেনেশিয়ার মূল তফাৎ নির্ভর করে, মৃত্যুর জন্য শেষ পদক্ষেপ কে গ্রহণ করে, তার ওপর।" অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের সিদ্ধান্ত যেমন রোগী নেন, তিনি সেক্ষেত্রে অন্যের সহায়তায় আত্মহত্যাও করেন। ইউথেনেশিয়ার ক্ষেত্রে রোগী বা তাঁর আত্মীয়, বন্ধুদের চূড়ান্ত অনুমতিতে ডাক্তার বা দ্বিতীয় ব্যক্তি রোগীর মৃত্যুতে সাহায্য করেন।

সুইজা়রল্যান্ড ছাড়া কোন কোন দেশে অ্যাসিস্টেড সুইসাইড আইনসিদ্ধ?
নেদারল্যান্ড এবং সুইজা়রল্যান্ড, এই দু'টি দেশ স্বেচ্ছামৃত্যু এবং ইউথেনেশিয়ার জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও রয়েছে বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, কানাডা এবং কলম্বিয়ার মতো দেশ, যেখানে এই দুই রীতি আইনসিদ্ধ।

'দ্য গার্ডিয়ান'-সূত্রে জানা যাচ্ছে, নেদারল্যান্ডস-এ স্বেচ্ছামৃত্যু এবং ইউথেনেশিয়া তখনই আইনসিদ্ধ, যখন রোগী অবর্ণনীয় কষ্টর শিকার হচ্ছেন এবং যে-ক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতির আর কোনও সম্ভাবনা নেই। নেদারল্যান্ডে বারো এবং তার উর্দ্ধে যে কেউ স্বেচ্ছামৃত্যু এবং ইউথেনেশিয়ার আবেদন করতে পারেন, তবে ষোলো বছরের নিচে কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে তাঁদের অভিভাবকদের অনুমতি থাকা আবশ্যক।

শুধু এখানেই শেষ নয়, মৃত্যুর এই দুই রীতির ক্ষেত্রেই অনুমতি পেতে গেলে বেশ কিছু শর্তাবলি প্রযোজ্য। পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যক। এদিকে কলম্বিয়াতে কেবল শারীরিকভাবে সংকটজনক রোগীই স্বেচ্ছামৃত্যু এবং ইউথেনেশিয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। আর বেলজিয়ামে যে-কোনও বয়সের রোগীই এই আবেদন করতে পারেন। বয়সের কোনও বাঁধন এখানে না থাকলেও, সংকটজনক রোগী ছাড়া আর কেউ এই অনুমতি পেতে পারেন না, জানা যাচ্ছে 'দ্য গার্ডিয়ান'-সূত্রে। লুক্সেমবার্গ এবং কানাডার ক্ষেত্রে আঠারো বছরের আগে ইউথেনেশিয়ার অনুমতি পাওয়া সম্ভব নয়; এবং একমাত্র শারিরীকভাবে সংকটজনক রোগীরাই পেতে পারেন এই অনুমতি।

ইউথেনেশিয়ার তুলনায় তবে স্বেচ্ছামৃত্যুর চল অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, হাওয়াই, নিউ জার্সি, ওরেগন, ওয়াশিংটন স্টেট, ভার্মন্ট এবং কলম্বিয়া ডিসট্রিক্টেও স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসিদ্ধ। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় অস্ট্রেলিয়ান স্টেট অফ ভিক্টোরিয়াতেও আইনসিদ্ধ করা হয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুকে।

সুইজা়রল্যান্ডে ক্রমেই বাড়ছে স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা, পিছিয়ে নেই নেদারল্যান্ডসও
সুইজা়রল্যান্ডে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে বাড়ছে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা। ২০০৩ সালে যেখানে স্বেচ্ছামৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৮৭, ২০১৫ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯৬৫-তে। ২০২০ সালে প্রায় ১৩,০০০ ব্যক্তি স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন সুইজা়রল্যান্ডে।

২০১৭ সালের রিজিওনাল ইউথেনেশিয়া রিভিউ কমিটি-র মতে, নেদারল্যান্ডসে সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ইউথেনেশিয়া ও স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করেছেন। যার মধ্যে ছিয়ানব্বই শতাংশই ইউথেনেশিয়া এবং চার শতাংশেরও কম স্বেচ্ছামৃত্যুর হার। যারা ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্যে একটিকে বেছে নিয়েছিলেন সেই বছর, তাঁদের বেশিরভাগই ক্যান্সারের সাথে লড়ছিলেন।

তবে রটারডামের এরাসমাস ইউনিভার্সিটি মেডিক‍্যাল সেন্টার-এর অধ্যাপক অ্যাগনেস ভ্যান ডার হাইডের (প্রফেসর অফ ডিসিশন-মেকিং অ্যান্ড কেয়ার অ্যাট দি এন্ড অফ লাইফ) মতে নেদারল্যান্ডসে স্বেচ্ছামৃত্যু এবং ইউথেনেশিয়া, উভয়ই বাড়ার পিছনে একাধিক কারণ আছে। এর কারণ কেবল ক্যানসার নয়; জানা যাচ্ছে 'দ্য গার্ডিয়ান'-এর ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে।

নেদারল্যান্ডসে স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য একপ্রকার মারণ-তরল দেওয়া হয়, যা শেষ পর্যন্ত পান করতে পারলেই মৃত্যু। তবে শেষ করাটাই একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ, জানাচ্ছেন অধ্যাপক অ্যাগনেস।

যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর যন্ত্র প্রথম আইনসিদ্ধ হয়েছিল সুইজা়রল্যান্ডেই
গত বছর ডিসেম্বরের ঘটনা। সুইজা়রল্যান্ডে আইনসিদ্ধ হওয়া, কফিনের মতো দেখতে একটি ক্যাপসুল হইচই ফেলে দিয়েছিল সারা বিশ্বে। কারণ তা ছিল যন্ত্রণাহীন স্বেচ্ছামৃত্যুর রাস্তা, তাও এক মিনিটেই চিরমুক্তি। সেই যন্ত্রের ভেতরে অক্সিজেনের পরিমাণ অত্যন্ত কমিয়ে, হাইপোক্সিয়া এবং হাইপোক্যাপনিয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করতে পারেন রোগী।

More Articles