গুনতে হবে সমস্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ, কেন ভোটের আগেই এমন দাবি বিরোধীদের?

Lok Sabha Election 2024: আবেদনকারী অরুণ কুমার আগরওয়াল তাঁর আবেদনে জানিয়েছেন, সরকার ৫ কোটি টাকা খরচ করে প্রায় ২৪ লক্ষ ভিভিপ্যাট কিনেছে। আর সেখানে মাত্র ২০ হাজারের মতো ভিভিপ্যাট স্লিপ যাচাই হয় ভোটগণনার সময়ে।

ভোটের মুখে সুপ্রিম কোর্টের একের পর এক সিদ্ধান্তে বেশ বিপাকের মুখে পড়েছে বিজেপি সরকার। লোকসভা ভোটের আর দেরি নেই। আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে রাজ্যে রাজ্যে ভোটগ্রহণ শুরু। এমন এক সময়ে ভিভিপ্যাটের স্লিপ গণনার আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, সমস্ত ইভিএমের ভোটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে ভিভিপ্যাট স্লিপ। অবশ্য মামলাটি আজকের নয়। ২০১৯ ভোটের পরেই এই সংক্রান্ত দুটি মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। তার একটি মামলা সম্প্রতি উঠেছে শীর্ষ আদালতে।

আইনজীবী অরুণকুমার আগরওয়াল এই সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। যেখানে সমস্ত ইভিএম ভোটের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখার আর্জি জানানো হয়েছে। এরই সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ যাতে ভোটাররা নিজেরাই একটি ব্যালট বক্সে ফেলতে পারেন, সেই নিয়েও আর্জি জানানো হয়। এই একই আবেদন করেছিল অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস বা এডিআর। আইনজীবী অরুণ কুমার আগরওয়ালের আবেদনের সঙ্গে ট্যাগ করা হয়েছে এডিআরের ওই আবেদনটিকেও।

ওই মামলায় ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনকে নোটিস পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিআর গাভাই, সন্দীপ মেহেতার আওতায় বিচারাধীন মামলাটি। ভোটের আগেই এই মামলার রায় সামনে আসা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ। ইভিএমের ডিজাইন ও এর কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন তুলে আসছে দেশের বিরোধী জোট ইন্ডিয়া। গত বছরই তাদের বৈঠকে ইতিমধ্যেই এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। এমনকী নির্বাচন কমিশনকে এ নিয়ে একটি স্মারকলিপিও জমা দিয়েছিল তারা। ভোটে ইভিএম কারচুপির অভিযোগ তুলে একশো শতাংশ স্বচ্ছতার দাবি জানিয়েছিল জোট ইন্ডিয়া। ভোট সামনে আসতেই ফের উস্কে উঠেছে সেই মামলা।

আরও পড়ুন: ভোটে হারার ভয়েই কর সন্ত্রাস? ভয়াবহ অভিযোগ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে

আবেদনকারী অরুণ কুমার আগরওয়াল তাঁর আবেদনে জানিয়েছেন, সরকার ৫ কোটি টাকা খরচ করে প্রায় ২৪ লক্ষ ভিভিপ্যাট কিনেছে। আর সেখানে মাত্র ২০ হাজারের মতো ভিভিপ্যাট স্লিপ যাচাই হয় ভোটগণনার সময়ে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এলোপাথাড়ি ভাবে পাঁচটি ইভিএম ও ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেল বা ভিভিপ্যাট বেছে নিয়ে তাদের স্লিপ মিলিয়ে দেখা হয় সাধারণত। এতদিন ধরে এটাই দস্তুর। এবার সেই নিয়মেই বদল চাইছে বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, একশো শতাংশ ভিভিপ্যাট স্লিপই মেলানো হোক ইভিএমের ভোট। আবেদনকারীর প্রশ্ন ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যায় করে যেখানে ২৪ লক্ষ ভিভিপ্যাট যন্ত্র কেনা হয়ে থাকে, তাহলে মাত্র ২০ হাজার ভিভিপ্যাটের স্লিপ কেন সংশ্লীষ্ট ইভিএম ভোটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে? আবেদনকারীর বক্তব্য, ভিভিপ্যাটের তথ্য ও ইভিএমে পড়া ভোটের মধ্যে পার্থক্যের অনেক অভিযোগ জানা গিয়েছে। তাই সব ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনা করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ একটি ব্যালট বাক্সে ফেলার অধিকার দেওয়া উচিত ভোটারদের।

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় প্রাথমিক ভাবে চালু করা হয়েছিল, ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা VVPAT। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (EVM)-এর সঙ্গে জোড়া থাকে মেশিনটি। ইভিএমে ইলেকট্রনিকস পদ্ধতিতে ভোট জমা পড়ে যেমন, তেমন ভাবেই পুরনো ব্যালট ভোটের পদ্ধতিটির বিকল্প হয়ে উঠেছিল এই ভিভিপ্যাট মেশিন। যা ভোটদানের পর ভোটারদের সামনে একটি স্লিপ তুলে ধরে, এবং যা থেকে বোঝা সম্ভব ইভিএম মেশিনে ভোটদাতার ভোটটি সঠিকভাবে রেকর্ড হয়েছে কিনা। সেই স্লিপে নির্বাচিত দলের নাম ও প্রতীক লেখা থাকে। এই ভিভিপ্যাট মেশিনে একটি স্বচ্ছ উইনডো থাকে, যেথানে ভোটাররা ওই স্লিপটি সচক্ষে দেখতে পান। তবে সেটিকে ছুঁতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, একটির পরে একটি ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখা হয়। সেই বিধিকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন আবেদনকারী। তাঁর বক্তব্য, আরও বেশি সংখ্যক নির্বাচনী আধিকারিক নিয়োগ করে বিধানসভা কেন্দ্রের সব ভিভিপ্যাট স্লিপ ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে মিলিয়ে দেখা যায়।

ভিভিপ্যাট স্লিপের সঙ্গে ইভিএমে পড়া ভোট মিলিয়ে দেখা নিয়ে বিতর্ক অবশ্য আজকের নয়।। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে একটি বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তত ৫০ শতাংশ ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখার আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল ২১টি বিরোধী রাজনৈতিক দল। তার আগে প্রতি বিধানসভা কেন্দ্রে যে কোনও একটি বেছে নেওয়া ইভিএমের ভিভিপ্যাট স্লিপ সেই ইভিএমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই ইভিএমের সংখ্যা বেড়ে হয় পাঁচ।

এবার সেই সংখ্যাকে বাড়িয়ে একশো শতাংশ করার দাবি তুলেছেন আইনজীবী অরুণকুমার আগরওয়াল। ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস’-এরও আদালতের কাছে একই দাবি। গত বছরের জুলাই মাসে সেই মামলার শুনানিতে শীর্ষ আদালত মন্তব্য করে, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে জনস্বার্থ মামলা অনেক সময়ে নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি সন্দেহ তৈরি করে। এবার এই ভিভিপ্যাট বিতর্ক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে জবাব তলব করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বেলা এম ত্রিবেদী এডিআরএর আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে জানিয়েছেন, আপনারা একটু বেশি সন্দেহপ্রবণ। আমরা নিশ্চিত তারা এই সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। আগের একটি মামলায় কমিশন জানিয়েছিল তারা এনিয়ে কাজ করছে। তার উত্তরে প্রশান্ত ভূষণ আদালতকে জানান, বর্তমানে ২ শতাংশেরও কম ভোট ইভিএমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। তবে আদালত জানিয়েছে, কমিশনকে নানা বিষয় দেখতে হয়। তাছাড়া তাদের লোকজন কতটা রয়েছে সেটাও দেখতে হয় তাদের। সেই সঙ্গেই বিচারপতিদের বেঞ্চের তরফে বলা হয়েছে, ভোটের হিসেবে গরমিলের অনেকগুলি কারণ হতে পারে। অনেকে সই করে বুথে ঢোকেন কিন্তু ইভিএম প্রেস করলেন না। ইভিএম, ভিভিপ্যাট, ও বুথে যে রেজিস্টারে যে নাম নথিভুক্ত হয়, তাতে তার জন্য গরমিল দেখা দিতে পারে অনেক সময়। তার সঙ্গে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে।

আরও পড়ুন:ভোট-বাজারে ইলেক্টোরাল বন্ডকেই পাল্টা অস্ত্র করছে বিজেপি! যে ভয়াবহ ইঙ্গিত দিলেন মোদি

এর জবাবে আইনজীবী বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে ইভিএম হ্যাকড বা কারচুপি করা যায় না। কিন্তু আমরা চাই ভিভিপ্যাটের সঙ্গে ইভিএমের ভোট মিলিয়ে দেখা হোক। এর পরে আদালত জানায়, ইলেকশন কমিশনকে এই আবেদনের একটি কপি দেওয়া হবে। কংগ্রেস-সহ বহু বিরোধী দলই এই মামলার সত্ত্বর রায় দাবি করেছে। আগামী ২ সপ্তাহ পরে ওই মামলাটির পরবর্তী শুনানি বলে জানানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের তরফে। সেদিনই কি এই সংক্রান্ত ফয়সলা করতে চলেছে শীর্ষ আদালত? আর সেটা যদি হয়, লোকসভা ভোটের আগেই বড়সড় পার্থক্য আসতে চলেছে ভোটগণনা প্রক্রিয়ায়। আর নতুন সেই নিয়মে ভোটগণনা সম্পূর্ণ করতে ইলেকশন কমিশনের হাতে প্রয়োজন আরও লোকবল। তা কি সত্যিই এত কম সময়ে জোগাড় করে উঠতে পারবে নির্বাচন কমিশন। স্বাভাবির ভাবেই আরও একগুচ্ছ প্রশ্ন উঠে গিয়েছে ভিভিপ্যাট স্বচ্ছতা সংক্রান্ত নতুন এই মামলার জেরে।

More Articles