বিজেপিকে হারানো যায়, যেভাবে প্রমাণ করে দিল জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীরা
JNU Student Election Result: চার বছর পরে জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে চারটি কেন্দ্রীয় পদে নির্বাচিত হয়েছেন বাম এবং দলিত প্রতিনিধিরা।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের উচ্চশিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। গত প্রায় দশ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শাসকদলের চক্ষুশূল। কারণ? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশই আনুগত্য প্রকাশ করে না দেশের শাসকের কাছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করে। শিক্ষা হোক, শিক্ষার বাইরের সমাজনীতি বা রাজনীতি যে কোনও বিষয়ে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের প্রশ্নের কোনও উত্তর আজকের কেন্দ্রের শাসকদলের
কাছে নেই বলেই, তারা এই ছাত্রছাত্রীদের ভয় পায়। শাসক জানে ‘ওরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে’।
১৯৬৬ সালে সংসদে আইন পাশ করে, দেশের প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৬৯ সালে। শিক্ষা এবং গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি সারা বিশ্ব জুড়ে। জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। ন্যাকের তালিকা অনুযায়ী, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় হয়েছিল ২০১৬ সালে এবং দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল ২০১৭ সালে। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিরোপা অবধি পেয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে জ্ঞান চর্চা হয়, যে অবাধ মেলামেশা, প্রশ্ন করার মন তৈরিরর পরিবেশ আছে, তা দেশের নানা প্রান্তের ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণ করে। যেখানে সরকারি নীতির ফলে উচ্চশিক্ষা ক্রমশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে বসেছে, সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় এখনও সাধারণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য দরজা খুলে, আর সেইখানেই আসল সমস্যার সূত্রপাত।
আরও পড়ুন- বারুইপুর, যাদবপুর হয়ে দমদম! ‘সুদিন’ ফেরাতে পারবেন সুজন চক্রবর্তী?
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেহেতু প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিশ্বাস করে না, তাই সেখানকার পরিবেশ আজকের কেন্দ্রীয় শাসকদলের গাত্রদাহের অন্যতম কারণ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন পড়ুয়াদের তালিকাও কিন্তু যথেষ্ট আকর্ষণীয়। আজকের বিদেশমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী, অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। শুধু তাই নয়, বাম আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান বলে খ্যাতি আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। দেখা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা অনেকেই পরবর্তীতে বিভিন্ন ধারার বাম আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সামনের সারির নেতাদের অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদেরও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একদিকে যেমন সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাতদের নাম করা যায়, অন্যদিকে তেমনই কবিতা কৃষ্ণণ, সুচেতা দে এবং কানহাইয়া কুমারদের নামও করতে হয়। শ্রমিক আন্দোলন থেকে কৃষক আন্দোলন- এই পড়ুয়াদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সভাপতি, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, চন্দ্রশেখরের কথা। তিনি ছাত্র সংসদের সভাপতি হওয়ার পরে, বিহারে বাম আন্দোলন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের গুন্ডা শাহাবুদ্দিনের হাতে শহিদ হন।
আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের শাখা সংগঠন, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ গত কয়েকবছর ধরে চেষ্টা করে গেছে, কী করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কখনও ভর্তির প্রক্রিয়াকে জটিল করে, কখনও বেতন বৃদ্ধি করে, সরকার চেষ্টা করে গেছে যাতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। বিজেপি নিজের পোষা গণমাধ্যম দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক চর্চা হয়। কখনও প্রাক্তন সভাপতি কানহাইয়া কুমারের স্লোগান দেওয়ার ভিডিওর সঙ্গে ভারত বিরোধী স্লোগানকে মিশিয়ে এমন প্রচার করেছে, যাতে মনে হয় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় 'দেশদ্রোহীদের আখড়া'। যাঁরা এখানে পড়েন এবং বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই 'দেশদ্রোহী'। এখানকার প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদকে বিনা দোষে কারাগারে বন্দি করে রেখেছে সরকার। তাঁর অপরাধ কেন তিনি সরকারের বিরুদ্ধে, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, কেন দিল্লির দাঙ্গা থামাতে গিয়েছিলেন! শুধু তাই নয়, এবিভিপির ছাত্ররা প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে
এখানকার ছাত্রদের মারতেও দ্বিধা করেনি। প্রাক্তন সভাপতি ঐশী ঘোষকে মেরে ফেলার চেষ্টা অবধি করা হয়েছে।
এই পুরো ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সরব থাকার কথা ছিল যাদের, সেই গোদি মিডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের 'খলনায়ক; দেখিয়ে, বলা হয়েছে তাঁরা সবাই ‘আর্বান নকশাল’, তাঁরা দেশকে টুকরো করে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত এবং সকলেই দেশদ্রোহী। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির বহু সাংসদই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের 'টুকরে টুকরে গ্যাং'-এর সদস্য বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে গেছে। আগামীতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকে বিকৃত করে আরও একটি চলচ্চিত্র আসছে, ‘জাহাঙ্গির ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি’। বিষয়, নাম থেকেই অনুমেয়।
আরও পড়ুন- নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করেও রেহাই! ১০০০ কোটির বন্ড কিনেছে কোন কোন ওষুধ কোম্পানি?
চার বছর পরে জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন কিন্তু এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তাঁদের রায় দিয়েছে। চারটি কেন্দ্রীয় পদে নির্বাচিত হয়েছেন বাম এবং দলিত প্রতিনিধিরা। এতদিন ধরে যে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল, গোদি মিডিয়ায় যেভাবে পড়ুয়াদের কালিমালিপ্ত করা হয়েছিল, অনেকেই ভেবেছিলেন এবার হয়তো গেরুয়া বাহিনীই দখল করবে ছাত্রসংসদ। সেইরকম আভাসও পাওয়া যাচ্ছিল। ভোট গোনা শুরু হওয়ার পরে প্রাথমিকভাবে এগোতেও থাকে এবিভিপির ছাত্ররা। গোদি মিডিয়া প্রচার শুরু করে দেয়, বাম দুর্গ এবার গেরুয়াদের দখলে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। প্রায় রাত দশটা নাগাদ খবর পাওয়া যায়, বামেরা চারটি কেন্দ্রীয় আসনেই বিজেপির ছাত্র সংগঠনকে পরাজিত করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্বাচন শুরু হওয়ার মাত্র কিছু ঘণ্টা আগে, বামেদের যুগ্ম সম্পাদকের প্রার্থীপদ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন, কোনওরকম সুযোগ না দিয়েই। তারপরে ছাত্ররা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন,
তাঁর বদলে বাপসা, অর্থাৎ দলিত ছাত্র সংগঠনের এক প্রতিনিধির স্বপক্ষে তাঁরা ভোট দেবেন।
টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে ফল ঘোষণা হওয়ার পরেই আইসার সদস্য, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ধনঞ্জয় বলেন, এই জয় ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের জয়। আগামী লোকসভা নির্বাচনে যে বিজেপিকে পরাজিত করা সম্ভব, তা এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেখিয়ে দিল। ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ এবং ধারাবাহিক লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে, ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে এই লড়াই যে আগামী লোকসভা নির্বাচনে আলোর দিশা দেখাবে তা বলাই বাহুল্য। গোদি মিডিয়ার উপর বিশ্বাস না রেখে যদি নিজেদের শক্তির উপর ভরসা রাখা যায়, যদি বিশ্বাস করা যায় ‘দু’বেলা মরার আগে মরবো না ভাই, মরবো না/ আমি ভয় করবো না ভয়, করবো না’ তাহলে সেই লড়াই জেতা সম্ভব, বিজেপিকে পরাস্ত করা সম্ভব।