মন্ত্রীর পরকীয়া ঠেকাতে মাঠে নেমেছিলেন খোদ হিটলার! 'ফেক নিউজের' জনক গোয়েবলস...

Joseph Goebbels: বর্তমানে আমরা যে আইটি সেলের 'ফেক নিউজ' কিংবা বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডা দেখি, তা অনেকাংশেই গোয়েবলসের মস্তিষ্কপ্রসূত।

মিথ্যেকে বারংবার সত্য বলে আওড়াতে থাকলে তা সত্যি হয়ে যায়। মানুষ সেই মিথ্যেকেই সত্য বলে মেনে নেয়। এই নীতির উপর ভিত্তি করেই নিজের সাম্রাজ্য কায়েম করেছিলেন হিটলার। আর এই নীতির প্রবক্তা ছিলেন হিটলারেরই প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার জোসেফ পল গোয়েবলস। আজকের দিনে বেঁচে থাকলে গোয়েবলস নিঃসন্দেহে যেকোনও রাজনৈতিক দলের আইটি সেলের প্রধান হতে পারতেন। মিথ্যেকে সত্য বলে ছড়াতে গোয়েবলসের জুড়ি মেলা ভার ছিল। নিজের উস্কানিমূলক ভাষণ দিয়ে জার্মানদের তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিলেন যে ইহুদিরা তাদের পক্ষে ক্ষতিকারক। তিনি সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন, 'বিকলাঙ্গ' কিংবা শারীরিকভাবে অসমর্থ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার কোনও মানেই হয় না। গোয়েবলসের উস্কানিতে প্ররোচিত হয়ে, বহু জার্মান মানুষ নিজেদের 'বিকলাঙ্গ' আপনজনকে ‘মৃত্যুদান’ (পড়ুন খুন) করেন। নিজের এক পায়ে সমস্যা থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কিংবা দুর্বল মানুষদের প্রতি এতটুকুও সদয় ছিলেন না গোয়েবলস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক জার্মানির দিকে তাকালে অবাক হতে হয়, কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ হিটলারের মতো একজন স্বৈরাচারীকে সমর্থন করতে পারেন। এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে জোসেফ গোয়েবলসের নীতিতে।

গোয়েবলসের সাংগঠনিক দক্ষতা এবং মানুষকে বুঝিয়ে নিজের দলে নিয়ে আসার ক্ষমতা ছিল অসীম। এর প্রথম প্রমাণ মেলে ১৯৩৮ সালে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে তখনও কয়েক মাস বাকি। ১৯৩৮ সালের ৯ নভেম্বর গোটা বার্লিন সাক্ষী থাকল এক কুখ্যাত রাতের। এতদিন পর্যন্ত জার্মানিতে ইহুদিদের সামাজিক এবং আর্থিকভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছিল। কিন্তু ৯ নভেম্বর রাতে যা হয় তা অত্যন্ত ভয়াবহ, নৃশংস এবং অমানবিক। নাৎসি সেনাবাহিনী এবং নাৎসি সমর্থকরা নির্বিচারে হামলা চালায় ইহুদিদের উপর। সেই রাতে ইহুদিদের বাড়িতে ঢুকে তাদের রাস্তায় টেনে বের করে আনা হয় এবং হত্যা করা হয়। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ইহুদিদের দোকানপাট, বাজার, উপাসনাস্থল সব পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাতারাতি। নির্বিচারে খুন করা হয় নারী-শিশু-বৃদ্ধ সকলকে। সেদিন রাতে বার্লিনের রাস্তা কাঁচ, রক্ত আর মৃতদেহে ভরে গিয়েছিল। যে গুটিকয়েক ইহুদি এই হত্যালীলার পরেও বেঁচে ছিলেন তাদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই নারকীয় হত্যালীলায় নাৎসিদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খোদ গোয়েবলস। এই ঘটনাকে ইতিহাসে ‘দ্য নাইট অব দ্য ব্রোকেন গ্লাস’ বলে অভিহিত করা হয়। গোয়েবলসের বদান্যতায় ইহুদিরা রাতারাতি শত্রু হয়ে যায় জার্মানদের। আসলে কয়েকদিন আগে এক জার্মান আধিকারিক খুন হয়েছিলেন এক ১৭ বছরের ইহুদি বালকের হাতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ইহুদি-বিরোধী আবহাওয়া তৈরি করেন গোয়েবলস।

আরও পড়ুন- লক্ষ লক্ষ ইহুদির প্রাণ কাড়তে হিটলারের হাতিয়ার ছিল এই বিষাক্ত গ্যাস, আসলে কী এই মারণাস্ত্র?

হিটলার এবং গোয়েবলস

আসলে গোয়েবলস চেয়েছিলেন ফের হিটলারের নেক নজরে আসতে। ‘ফের’ কেন? তা জানার আগে, আমাদের জানতে হবে গোয়েবলস কীভাবে আসেন হিটলারের সান্নিধ্যে। ১৮৯৭ সালে জার্মানির এক মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম জোসেফ গোয়েবলসের। জন্মগতভাবেই শারীরিকভাবে বিশেষ সক্ষম ছিলেন তিনি। এক পা ছিল প্রতিবন্ধকতাযুক্ত। ফলত ইচ্ছে থাকলেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি গোয়েবলস। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না পারলেও পড়াশোনায় খুবই মেধাবী ছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করে বই লেখা শুরু করেন গোয়েবলস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় হিটলারের নেতৃত্বে গোটা জার্মানি জুড়ে উত্থান হচ্ছিল নাৎসি ভাবধারার। হিটলারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯২৪ সালে নাৎসি দলে যোগ দেন গোয়েবলস। ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হন হিটলার। একই সঙ্গে দলে বড় পদ পান গোয়েবলস, হিটলারের ক্যাবিনেটে প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার হন তিনি। হিটলারের প্রতি নিজের অকুণ্ঠ আনুগত্য প্রমাণ করতে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ করেন গোয়েবলস। সর্বপ্রথম সব সংবাদ সংস্থাগুলিকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয় হিটলারের বিরুদ্ধে না লিখতে। উপরন্ত সকল প্রকার নাৎসি বিরোধী বই, ক্যাসেট, পোস্টার প্রভৃতি জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন গোয়েবলস। এছাড়াও জনমানসে নাৎসি প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এক দুরন্ত উপায় বার করেন গোয়েবলস। সরকারি রেডিও কোম্পানিগুলিকে অত্যন্ত সস্তায় রেডিও তৈরির নির্দেশ দেন তিনি। সস্তা হওয়ায় দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরেই প্রবেশ করে সেই ‘সরকারি’ রেডিও। এরপর জার্মানির সব রেডিও চ্যানেলগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয় শুধুমাত্র হিটলারের ভাষণ চালানোর জন্য। ফলত সারা দেশ একযোগে শুনতে থাকে হিটলারের উস্কানিমূলক ভাষণ।

জোসেফ গোয়েবলস

সংবাদমাধ্যমের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পর গোয়েবলসের নজর গিয়ে পড়ে সিনেমার উপর। তার নির্দেশে আমেরিকান সিনেমা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় জার্মানিতে। পরিবর্তে নাৎসি প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা দেখানো শুরু হয় গোটা দেশে। সেই সিনেমার গল্প থেকে শুরু করে পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী সবকিছুই ঠিক করতেন গোয়েবলস স্বয়ং। এই সিনেমাগুলিতে মূলত দেখানো হতো ইহুদিরা জার্মানদের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক এবং নোংরা মানসিকতার। সিনেমা, রেডিও প্রভৃতি গণমাধ্যমের দ্বারা ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই হিটলারের নেক নজরে চলে আসেন গোয়েবলস। হিটলার এবং গোয়েবলসের বন্ধুত্বই হয়েছিল ইহুদিদের প্রতি তাদের সমবেত বিদ্বেষের কারণে। কিন্তু এই বন্ধুত্বই প্রায় ভাঙনের দোরগোড়ায় চলে যায় যখন গোয়েবলসের জীবনে প্রেম আসে! আগেই বলেছি, জার্মান সিনেমাগুলিতে কারা অভিনয় করবেন তা নির্ধারণ করতেন গোয়েবলস। এই সময়ই তার প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে লিডা বারোভা নামক এক অভিনেত্রীর সঙ্গে। যদিও গোয়েবলস তখন বিবাহিত ছিলেন এবং তার ছয়টি সন্তান ছিল। প্রেমে মাতোয়ারা গোয়েবলস নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের দায়িত্ব ছেড়ে লিডার সঙ্গে নতুন করে সংসার গোছাতে উদ্যোগী হন। সেই সময় জার্মানিতে বিবাহবিচ্ছেদ করতে হলে চ্যান্সেলরের অনুমোদন লাগত। সামাজিকভাবেও খুব নীচু চোখে দেখা হত বিবাহবিচ্ছেদকে।

আরও পড়ুন- ব্যর্থ প্রেমই কি নির্মম করে তুলেছিল? হিটলারের প্রেমের এই আখ্যান এখনও রহস্যে মোড়া

লিডা বারোভা এবং গোয়েবলস

দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নিজের স্ত্রী-সন্তানদের দায়িত্ব ছেড়ে পরকীয়া করছেন জানতে পেরে এবার ময়দানে নামেন খোদ হিটলার। তিনি এক প্রকার শেষ হুমকি দেন গোয়েবলসকে; হয় লিডাকে ছাড়ো, নয় রাজনীতি ছাড়ো। হিটলারকে চমকে দিয়ে দ্বিতীয় পথটি বেছে নেন গোয়েবলস। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বুঝতে পেরে হিটলার সারা জীবনের জন্য লিডা বারোভাকে জার্মানি থেকে নির্বাসিত করেন। এই ঘটনার পর হিটলার এবং গোয়েবলসের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ফলত গোয়েবলস বিরোধী শিবির অর্থাৎ হিমলার লবি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক মাস এভাবে চলার পর বিচক্ষণ গোয়েবলস বুঝতে পারেন হিমলার তাকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে চাইছে। তাই যেভাবে হোক হিটলারের নেক নজরে আসতে সচেষ্ট হন গোয়েবলস। যার পরিণাম ‘দ্য নাইট অব দ্য ব্রোকেন গ্লাস’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে হতে নিজেকে নাৎসি পার্টির একপ্রকার ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ রূপে পরিণত করেছিলেন গোয়েবলস। দলে গোয়েবলসের কথা মানেই হিটলারের কথা। এমনকী, ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণাও করেছিলেন গোয়েবলস নিজেই। মনে করা হয় হিটলার নিজেও চেয়েছিলেন তাঁর পরে নাৎসি দলের দায়িত্ব নিক গোয়েবলস। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পর জার্মানির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরেও গোয়েবলস হিটলারের উপর থেকে আস্থা হারাননি। যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভবী জেনেও দেশের কিশোর-কিশোরী এবং বৃদ্ধদের অস্ত্র তুলে নিতে আহ্বান জানান গোয়েবলস। গোয়েবলস মানুষের মধ্যে এত মিথ্যে ছড়িয়ে ছিলেন, যে শেষ পর্যন্ত নিজেই সেই মিথ্যেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন।

সপরিবারে গোয়েবলস

কিন্তু গোয়েবলসের হিটলারের প্রতি এই ‘অগাধ আস্থা’ হিটলারের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন হিটলার। এরপর দিন অর্থাৎ ১ মে ১৯৪৫ সালে সপরিবার বিষপান করে আত্মহত্যা করেন গোয়েবলস। গোয়েবলস মারা গেলেও তার সেই প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর পদ্ধতি এখনও বেঁচে আছে, বরং আরও উন্নত হয়েছে। গোয়েবলসের আগেও বিভিন্ন দল প্রোপাগান্ডা ছড়াত, কিন্তু তা নিজেদের গুণকীর্তন করার জন্য। গোয়েবলসই প্রথম যিনি বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডা ছড়ান দেশজুড়ে। বর্তমানে আমরা যে আইটি সেলের 'ফেক নিউজ' কিংবা বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডা দেখি, তা অনেকাংশেই যে গোয়েবলসের মস্তিষ্কপ্রসূত তা অস্বীকার করার জো নেই।

More Articles