হলিউড-বলিউড নয়, কোন জাদুতে তরুণ প্রজন্ম মজছে কোরিয়ান সংস্কৃতিতে?
রক, নাচ, গান, ঝলমলে পোশাক আর লক্ষ লক্ষ অনুরাগী কে-সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। বিটিএস, ব্ল্যাকপিঙ্ক, এক্সও হল কে-পপের সবচেয়ে বর উদাহরণ।
অল্প হলেও বিটিএস ব্ল্যাক পিঙ্ক-এর নাম অথবা স্কুইড গেম কে-ড্রামার নাম শোনেননি, এমন মানুষ কিন্তু এখন খুবই কম পাওয়া যায়। কিন্তু কে-ড্রামা, কে-কালচার বা হ্যালউ ওয়েভ আসলে কী? দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদনের জনপ্রিয় ধারা কে-পপ কালচার মন জয় করছে পুরো বিশ্বের। তরুণ ও বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে হ্যালউ ওয়েভ নিয়ে উন্মাদনা দিন দিন বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। কিছুদিন আগে প্রকাশ পাওয়া স্কুইড গেম কে-ড্রামাটি যেন সেই আগুনে আর ঘি ঢেলেছে। অতিমারীতে এই কোরিয়ান সংস্কৃতির প্রভাব ছড়িয়েছে প্রায় কয়েকগুণ বেশি।
রক, নাচ, গান, ঝলমলে পোশাক আর লক্ষ লক্ষ অনুরাগী কে-সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। বিটিএস, ব্ল্যাকপিঙ্ক, এক্সও হল কে-পপের সবচেয়ে বর উদাহরণ। তবে আধুনিক কে-পপের উৎপত্তি ঘটেছিল ১৯৮৭ সালে। আটের দশকের শেষ ও নয়ের দশকের শুরুতে পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রভাবে, যথা রক, জ্যাজ, হিপহপের সংমিশ্রণে দক্ষিণ কোরিয়াতেও কে-পপের বিস্তার শুরু হয়। নয়ের দশকে Seo Taiji & Boys তাদের গান ‘I Know’ প্রকাশ করলে তা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৭ সপ্তাহ ধরে এই গানটি কোরিয়ান মিউজিক চার্টের শীর্ষে থাকে। জন্ম নেয় আইডল সংস্কৃতির, তবে বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত এই কে-পপ শুধুমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৩ থেকে তা বিশ্বের দরবারে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ শুরু করলেও তা বেগ পায় ২০১৫ সাল থেকে বিখ্যাত বয় ব্যান্ড বিটিএসের হাত ধরে। তাদের ‘Love Yourself’ অ্যালবাম ও ওয়ার্ল্ড ট্যুর কয়েক বিলিয়ন আয় করে। তাই কে-পপকে এই বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা দেওয়ার নেপথ্যে অন্যতমভাবে দায়ী হল বিটিএস ও ব্ল্যাকপিঙ্ক। তবে শুধুই কিন্তু কে-পপ নয়, কে-ড্রামাও তাল মেলাচ্ছে কোরিয়ান বিনোদনকে জনপ্রিয় করতে।
কিন্তু কেন হলিউড, বলিউড ছেড়ে সকলের নজর কাড়ছে এই হ্যালউ? তার নেপথ্যেও অবশ্য অনেক কারণ আছে। যেমন সুদৃশ্য আইডল, ঝলমলে পোশাক, গান, নাচ আকৃষ্ট করেছে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীকে, আদর্শ পুরুষত্ব, ফ্যানদের প্রতি ভালবাসা, ফ্যানদের এত প্রশ্রয় দেওয়া, তাঁদের কমনীয় ব্যবহার, সাধারণ মানুষকে আপন করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ‘স্কুইড গেম’, ‘অল অফ আস আর ডেড’-এর মতো কে-ড্রামাগুলি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এছাড়াও আছে ‘ট্রেন টু বুসান’, ‘প্যারাসাইট’, ‘মিনেরি’-র মতো পুরস্কারজয়ী সিনেমা। গল্পের চিত্রনাট্য, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাজসজ্জার নিখুঁত উপস্থাপনা যে কোনও মানুষকে কে-ড্রামার প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করছে।
আরও পড়ুন: গানের জন্য টাইপরাইটার বিক্রি করেছিলেন, চোখে জল আনবে কেকে-র লড়াইয়ের ওঠার গল্প
সিনেমার হিরোদের মতো জীবনসঙ্গী চাই, বহু মেয়েরই এমন বাসনা থাকে, কোন নারী না চায় যে তার প্রেমিক বা স্বামী হবে ঠিক শাহরুখ খান বা লিওনার্দো ডি-ক্যাপরিওর মতো! তাই কে-কালচারে তরুণ প্রজন্ম মজলেও, তাতে সংখ্যা বেশি তরুণীদের, কিন্তু কেন? এর পিছনে কারণগুলির মধ্যে প্রধান হল- পুরুষ আইডল, বা অভিনেতা। পশ্চিমি হিরোদের প্রতি বিশ্বের নারীদের টান বরাবরই বেশি। এমনকী, ভারতেও তাই। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই আকর্ষণ কাড়ছে কে-ড্রামার হিরোরা। ‘রোম্যান্টিক’, ‘ভদ্র’, ‘সুদর্শন’, ‘চকচকে বর্মে নাইটস’ এমন কিছু শব্দ দিয়েই তরুণীরা তাদের আদর্শ কোরিয়ান পুরুষকে বর্ণনা করে। অনেক মহিলাই দক্ষিণ কোরিয়া পাড়ি জমাচ্ছে প্রেমিকের টানে, যদি সত্যিই সেখানে গিয়ে ঠিক কে-ড্রামার হিরোদের মতো জীবনসঙ্গী মেলে!
ফ্যানসাইন, অনুরাগীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথন, লাইভ, আইডলদের জীবনের ছোটখাটো তথ্য প্রদান ইত্যাদি সবই আইডল বা অভিনেতারা করে থাকেন দর্শককে আকর্ষণ করার জন্য ও অনুরাগীদের ধরে রাখার জন্য। এমনিতেই তারকাদের জীবন নিয়ে সকলেরই কৌতূহল থাকে। কোন তারকা কখন কী খায়, কোথায় যায়- সবেতেই কিন্তু সাধারণ মানুষের, বিশেষত নতুন প্রজন্মের এক অমোঘ টান থাকে। এইসব প্রশ্নের উত্তরে যখন বাকি দেশের হিরোরা পাত্তা না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার আইডল ও হিরোরা কী খাচ্ছেন, তাও তাঁরা অনুরাগীদের লাইভ করে দেখান। অনুরাগীদের এমন প্রাধান্য আর কোনও দেশের তারকারা দেন কি না, তা সত্যি সন্দেহের! আইডলদের ওপর ব্যক্তিগত দাবি কায়েম করতে পেরে খুশিও হয় দর্শকরা। এহেন উপায়ে জনপ্রিয়তা বাড়ে আইডলদের, বাড়ে অনুরাগীর সংখ্যা। শুধুই লাইভ নয়, ফ্যানসাইনের মাধ্যমে তাঁরা প্রতিটা ফ্যানের থেকে উপহার গ্রহণ করে ও অটোগ্রাফ দিয়ে থাকে। ব্যক্তিগত কথোপকথনও চালায়। যেখানে আমাদের দেশে অনেক অনুরাগীকেই তারকাদের বডিগার্ডদের হাতে হেনস্থা হতে হয়, সেখানে একবার বয় ব্যান্ড এক্সও-র এক মেম্বার এক অনুরাগীর হাতে চড় খেয়েও চুপ থেকেছে, এবং নিজের ভুলের জন্য উল্টে ক্ষমা চেয়েছে সে। আইডল এবং অনুরাগীদের মধ্যে এমন সম্পর্কই কে-সংস্কৃতির বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কে-পপের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য কোনও পপ সংস্কৃতিতে দেখা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রত্যেকটি পপ গ্রুপে কিছু সদস্য থাকেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু দায়িত্ব থাকে। কেউ হন লিড সিঙ্গার, কেউ ভিস্যুয়ালসের দায়িত্বে, আবার কেউ লিড ড্যান্সার। প্রত্যেকটি গ্রুপের নিজস্ব লাইট স্টিক থাকে। যেমন, বিটিএস-এর আর্মি বম্ব, ব্ল্যাক পিঙ্কের বিএল-পিং-বং, ট্যুয়াইসের জেড ইত্যাদি। এই লাইট স্টিকগুলির সাহায্যে কোন অনুরাগী কোন দলের ফ্যান, তা বোঝা যায়। এছাড়াও আছে অ্যালবামের সঙ্গে ফোটো কার্ড। আমাদের অনেকেরই শখ থাকে তারকাদের ছবি পেপার থেকে কেটে দেওয়ালে টাঙানো অথবা ডায়েরির পাতায় আটকে রাখার। আর ঠিক চাহিদা বুঝেই কে-পপ দলগুলি প্রচলন করে ফোটো কার্ড, যা অ্যালবাম কেনার হিড়িক আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যেকটি কে-পপ গ্রুপের নিজস্ব অনুরাগীদের দলকে একটি করে নাম দেওয়া হয়, যেমন এক্সও-র এক্সও-এল, টিএক্সটি-র মুয়া, রেড ভেলভেটের রেভেলাভ ইত্যাদি ছাড়াও অসংখ্য গ্রুপের অসংখ্য ফ্যানডমের নাম আছে। শুনতে অবাক লাগলেও কে-পপের এহেন বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রতি বছর প্রায় কয়েকগুণ করে অনুরাগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
কে-সংস্কৃতির এত বিপুল পরিমাণ বিস্তারের ফলে, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির প্রায় ১৬ বিলিয়ন অর্থ উঠে আসে তাদের বিনোদনের খাত থেকে। কে-পপ বা কে-ড্রামার কল্যাণে দক্ষিণ কোরিয়ার সাজ-সজ্জা, খাবার ও পর্যটনের জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী হচ্ছে দিনকে দিন। বিনোদনকে কাজে লাগিয়ে যে একটি দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এত জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে, তা দক্ষিণ কোরিয়াকে না দেখলে জানা যেত না কখনই।