কেলে ডাকাত থেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বংশ, জিরাট গ্রামে ডাকাতেকালীর রোমাঞ্চকর ইতিহাস

Kalipuja 2022: বাঁশবেড়িয়ার কাছে বেনেপুকুরে ছিল জমিদার কালীচাঁদ, মতান্তরে কালাচাঁদের বাস। তিনি দিনে জমিদারি সামলাতেন। রাতে আবার তিনিই হয়ে উঠতেন ডাকাতদলের সর্দার

বাংলার ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময় ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ব্রিটিশ আমলের নথিটথিতে ডাকাতের পরিসর অনেক বড়। কোথাও শোষিত মানুষ, কোথাও বা বিদ্রোহী জমিদার, ঠগী, আবার এককালে স্বদেশি ডাকাত— নানান সময়ে ডাকাত তকমা একই রয়ে গেছে। আর ডাকাতির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শক্তিসাধনা। এই একটি জায়গায় সাবর্ণ, দলিত, জাতীয়তাবাদ সব মিশে গিয়েছে। দুর্গাপুজো প্রারম্ভ মাত্র। এরপরের মাসখানেক ধরে যে 'সাজো সাজাও' রব, তার অনেকখানি দীপাবলি, ভাইফোঁটার প্রস্তুতিও। কোজাগরী পেরিয়ে ঘোর অমাবস্যা পর্যন্ত উৎসবের মেহফিল বজায় থাকে বাংলায়। শক্তির এক রূপে যে মেহফিলের শুরু, তা ভাঙেন শক্তির আরেক রূপ। চণ্ড ও মুণ্ড বধের দেবী কালিকা, এ বাংলায় এবং বাংলার উত্তরে পূজিত হয়ে আসছেন দীর্ঘদিন। তবে বাংলার দক্ষিণেও এ পুজোর ইতিহাস নেহাত কম দিনের না।

হুগলির জিরাট গ্রামের নামটি এসেছে ফারসি 'জিয়ারৎ' থেকে। আগে এই গ্রামের নাম ছিল মহম্মদপুর। জিরাট নামটি প্রচলিত হওয়ার পরে লোকমুখে এ ব্যাখ্যাও শোনা যায় যে, গোপীনাথ জিউ মন্দির প্রতিষ্ঠার পরদিনই ভোরে সেই চত্বরে দৈব পদচিহ্নের দেখা মেলে। তাই নাকি জিউ-এর 'জি', 'রা'-অর্থে দান এবং 'ট' অর্থে পদ। তবে এই শেষ হযবরল নামস্বার্থকতার কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। হাওড়া থেকে কাটোয়ার দিকে যে মেইন লাইনটি চলে গিয়েছে, তারই উপর জিরাট স্টেশন পড়ে। অনেকেই হয়তো জানেন না, ঔপনিবেশিক বাংলায় প্রথম জলপথে ভ্রমণের কাহিনি লিখেছিলেন এক জিরাটবাসীই। তাঁর নাম, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। এই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষের ঠাকুর্দা। কালনা থেকে রংপুর যাওয়ার তিরিশ দিন, জলপথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। পুরোটাই দিনলিপির আকারে লেখা। যে সময়ের কথা, তখনও বঙ্কিম গদ্যরচনায় হাত দেননি। এই মুখোপাধ্যায় বংশের ইতিহাস জিরাটের সঙ্গে পাকে পাকে জড়িয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন- চোদ্দ ফুটের প্রতিমা! ‘জাগ্রত বড়মা’-কে দেখতে আজও ভিড় জমে নৈহাটির কালীপুজোয়

মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে চক্রবর্তী ও গোস্বামী— এই তিন পরিবারকে কেন্দ্র করেই একরকম জিরাটের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই অঞ্চল 'কালিয়াগড়' হয়ে উঠল, তার একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা মুখোপাধ্যায়দের দিকেই আঙুল তোলে। কথিত, গঙ্গার স্রোতে ভেসে এসেছিলেন এই মুখটি বামুনদের পূর্বপুরুষ। আত্মহত্যার চেষ্টা তাঁর বিফলে যায়। পশ্চিমতীরের একটি বটগাছে প্রায় অচেতন দেহটি আটকে থাকে। সে সময় দেবী কালী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। সেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির। একদিকে বট, অপরদিকে বেলগাছ। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় কালীপুজো করে আসছেন মুখোপাধ্যায়রা। কালীপুজোয় কেবল মাত্র তাঁদেরই অধিকার— ব্যাপারটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য 'অধিকারী' পদবী নিয়েছিলেন পরবর্তীতে। সেই কালী উপাসনা থেকেই নাকি জিরাটের আরেক নাম কালিয়াগড় বা কেলেগড়।

রোহিণীকান্ত মুখোপাধ্যায়ের 'কুলসার সংগ্রহ'তে বলা হয়েছে সেন বংশের রাজা আদিশূরের রাজত্বকালে এই সিদ্ধেশ্বরী উপাসনার শুরু। অর্থাৎ ৯৫৪ শকাব্দ বা ১০৩২ খ্রিস্টাব্দে। যদিও তথ্যটি বিতর্কিত। অধিকারী পরিবারের গ্রামের অভিজাত পরিবারগুলির মধ্যে অন্যতম। এই বংশেরই এক সন্তান কাশীনাথ তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে দেন গোস্বামী ও চক্রবর্তী পরিবারে। মোটামুটি সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকেই প্রথমে ডাচ, পরে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে দহরম মহরম ছিল এই বংশের। পারিবারিক ব্যবসা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। লোকমুখে প্রচলিত এই ডাকাতে কালীর মন্দিরের সঙ্গে এখন আর কোনও সম্বন্ধই স্বীকার করতে চান না অধিকারী পরিবার। তবে ১২২৭ সন পর্যন্তও মন্দিরের পুজোর ভার ছিল চন্দ্রনাথ অধিকারীর। তিনি মারা গেলে তাঁর ভাগনে কালীপ্রসন্ন চাটুজ্যে পুজোর ভার নেন।

আরও পড়ুন- দিনে রাজা, রাতে লুটেরা! পশ্চিমবঙ্গের ডাকাত-কালীর সঙ্গে জড়িয়ে গা ছমছমে ইতিহাস

মন্দিরের ফলক থেকে জানা যায় এই পীঠ নাকি সতীর বলয়োপপীঠ গুলির মধ্যে একটি। সতীর দেহ নিয়ে মহাদেব যখন তাণ্ডব নৃত্য করছেন, তখন বিষ্ণু তাঁর চক্রের সাহায্যে সেই দেহ খণ্ড খণ্ড করে দেন। দেহের অংশগুলি শক্তিপীঠ। আর অলংকার যে সব স্থানে পড়েছিল, তা বলয়োপপীঠ। কথিত, এই অঞ্চলে সতীর বালা পড়েছিল। তবে এই বলয়োপীঠের নাম কালিয়াগড় হওয়া নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। কেলে ডাকাত। বাঁশবেড়িয়ার কাছে বেনেপুকুরে ছিল জমিদার কালীচাঁদ, মতান্তরে কালাচাঁদের বাস। তিনি দিনে জমিদারি সামলাতেন। রাতে আবার তিনিই হয়ে উঠতেন ডাকাতদলের সর্দার, খোদ বিভীষিকা কেলে ডাকাত। জলেস্থলে সর্বত্র তাঁর অবাধ গতি। তেমনই নিষ্ঠুর। জমিদার বাড়িতেই কালী মন্দির ছিল। সেই মন্দিরে সদলবলে পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোতেন কালীচাঁদ। সেই পুজোতে পোড়া লাউ থেকে মানুষ, দেবীর ভোগে বলি হত সমস্ত কিছু। এর পাশেই কালভৈরবের থান। সেও ডাকাতদের হাতেই তৈরি। জমিদার দিনে দানধ্যান করতেন। রাতে তার বহুগুণ ধনসম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে ফিরতেন। বন্দি আনা হত প্রায়দিন। সেই বন্দিদের প্রথমে চোরাকুঠুরিতে আটকে রাখা হত। পরে রাতের অন্ধকারে কালীর সামনে বলি হয়ে যেত সাধারণ মানুষ। সে নরবলি বন্ধ হয়েছে বহুদিন।

সে সময় মন্দিরের ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে যেত গঙ্গা। এখনও সিঁড়ি বাধানো ঘাট রয়েছে মন্দিরে। কিন্তু কালের ফেরে গঙ্গা সেখান থেকে সরে গিয়েছে কয়েক কিলোমিটার। সম্পর্কের চিহ্ন নিয়ে রয়ে গিয়েছে একা ব্যবহারহীন ধাপগুলিই। মহম্মদপুরে তখন ঘন জঙ্গল। কাজেই ডাকাতির গল্পে সত্যি খানিক থাকতেও পারে। আবার মুখোপাধ্যায়দের দাবিও যথেষ্ট কেলেগড়ের জনশ্রুতিদের উপর। মন্দিরটির ফলকে যদিও রয়েছে ৬০০ বছর অতীতের সাক্ষ্য। ১৩৩৬-৩৭ বঙ্গাবে, অর্থাৎ ১৯২৯-৩০ সাল নাগাদ সংস্কার হয়েছিল। এখনও কিছু বছর অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ করানো হয়। বিগ্রহের মূল কাঠামোটি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর দেবী অধিষ্ঠিতা। তন্ত্রমতে শক্তি আরাধনা হয়ে আসছে আজও। নরবলি বন্ধ হলেও এখনও অল্প মাত্রায় বলির চল রয়েছে উৎসব বিশেষে। অমাবস্যার রাতে এখনও সেই আদিম ইতিহাসের গন্ধ মন্দির চত্বরের গায়ে লেগে থাকে। জ্ঞানী সেই গন্ধ পান, প্রজন্ম পেরিয়ে যে দৃষ্টি মিশে গিয়েছে আদির মহাশূন্যে।

 

তথ্যঋণ—

বঙ্গ নদী রঙ্গ কথা, অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়

হুগলিহেরিটেজ

জিওবাংলা

More Articles