রিল তৈরিতেই ব্যস্ত! রেলের কবচের ব্যবস্থা কেন করতে পারলেন না রেলমন্ত্রী অশ্বিনী?
Kanchanjunga Express Accident Kavach: মানুষের প্রাণের মূল্য নেই অথচ স্টেশনগুলিকে প্রায় শপিংমল করে তোলার যুক্তি কোথায়?
যে মৃত, তাঁর উপর দোষ চাপানো সহজ। কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য, আসল ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য সশরীরে যাকে পাওয়া যায় না তাঁর উপর দায় চাপানোর কাজটিই করেছিল ভারতীয় রেল। উত্তরবঙ্গে মালগাড়ি আর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মালগাড়ির মৃত চালককে দোষী প্রমাণ করে আসলে কোন গাফিলতি ঢাকতে চাইছিল রেল? রেল প্রথমে জানায়নি যে রানিপত্র থেকে ছাতারহাট জংশন পর্যন্ত খারাপ ছিল সিগনাল। TA 912 নামে একটি ম্যানুয়াল মেমো নিয়েই এগোচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সকাল ৮ টা ২৭ মিনিটে রাঙাপানি স্টেশন পার করে কাঞ্চজনঙ্ঘা এক্সপ্রেস আর ৮ টা ৪২ মিনিটে পেরোয় ওই মালগাড়ি। একই লাইনে ঢোকার ছাড়পত্র মালগাড়িটি পেল কীভাবে?
সিগনাল খারাপ হলে এই ম্যানুয়াল মেমো অনুযায়ী, গাড়ির গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার থাকার কথা। একই ম্যানুয়াল মেমোতে দু'টি গাড়ি একই লাইনে আসতে পারে না। রেল প্রথমেই দায় চাপিয়ে দিয়েছিল মালগাড়ির চালকের উপর। তিনি সিগনাল দেখেননি। নিয়ম না মেনে এক লাইনে ঢুকে গেছেন। সিগনাল তিনি মানবেন কীভাবে? ভোর ৫ টা ৫০ থেকে সিগনাল খারাপ ছিল ওই লাইনে। ফলে পেপার সিগনালিং শুরু হয়। TA 912 নামের ম্যানুয়াল মেমো বা পেপার সিগনাল মোটরম্যানকে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট স্টেশনমাস্টারই এই কাগজ দেন। কী এই TA 912? এই ম্যানুয়াল মেমো দেওয়ার অর্থ, লাল সিগনাল থাকলেও ট্রেন এগোতে পারবে। তবে কিছু নিয়ম আছে তাতে। প্রতি রেড সিগনালে ১ মিনিট দাঁড়াবে ট্রেন, তারপর সিগনাল গ্রিন না হলেও পেরোতে পারবে। তাও গতি থাকতে হবে ১ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে। এদিন খারাপ আবহাওয়ার জন্য ট্রেনের গতিবেগ ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় চলার নির্দেশ নেওয়া হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এই নিয়ম মেনে ঠিকই এগোচ্ছিল। তাহলে মালগাড়ি কীভাবে এল পিছনে? মালগাড়ির কাছেও কি TA 912 ছিল?
আরও পড়ুন- অঘটনের শুরুয়াত, দেশ বিদেশের প্রথম রেল দুর্ঘটনার ইতিবৃত্ত
রেলমন্ত্রক ঘটা করে 'কবচ' ব্যবস্থার কথা বলেছে। রেল দাবি করেছে, আধুনিক প্রযুক্তিতে দুর্ঘটনা কমবে। ২০২৩ সালে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাতেও এই প্রশ্নই উঠেছিল। কোথায় গেল কবচ? কবচ প্রযুক্তি এই অংশে রেলপথে নেই। তাহলে আপনা থেকেই বাধা পেত মালগাড়ি। প্রাথমিকভাবে রেলবোর্ডের চেয়ারম্যান বলছিলেন, সিগনালিং ওভারশ্যুট করছেন মালগাড়ির চালক। সিগনাল না দেখা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ, চাকরি চলে যায়। রেলের সমস্ত চালকরা তা জানেন। জেনেবুঝেও সিগনাল ওভারশ্যুট করলেন মালগাড়ির চালক? তাহলে কি অন্যমনস্ক ছিলেন? কেবিনে লোকো পাইলট অর্থাৎ চালক ছাড়াও অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকো পাইলটও থাকেন। তাহলে দু'জনেই ক্লান্ত? কেউই খেয়াল করলেন না সিগনাল? সকাল থেকে বৃষ্টি হলেও, সেই সময় খুব খারাপ দৃশ্যমানতাও ছিল না যে এমন দুর্ঘটনা ঘটবে।
Enhanced ex-gratia compensation will be provided to the victims;
— Ashwini Vaishnaw (@AshwiniVaishnaw) June 17, 2024
₹10 Lakh in case of death,
₹2.5 Lakh towards grievous and ₹50,000 for minor injuries.
রেলের আরেকটি গাফিলতির দিকেও প্রশ্ন উঠছে, কামরার ব্যবহার। এখন রেলে মূলত দুই ধরনের কোচ থাকে এলএইচবি আর আইসিএফ। এলএইচবি অত্যাধুনিক কোচ। ধাক্কা মারলেও কামরার ছিটকে যাওয়া বা উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা এখানে কম। এই কামরার ভারসাম্য ভালো। আইসিএফ কামরাতে লাইনচ্যুত হওয়ার ভয় থাকে। এখনও সব ট্রেনে এলএইচবি কোচ নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, যে যে কামরা উল্টে গেছে সবই আইসিএফ কোচ। এলএইচবির খরচ বেশি, সব রাতারাতি পালটানো সম্ভবও না। তাহলে রেলের ব্যয় কোথায় হচ্ছে? ঝাঁ চকচকে হচ্ছে স্টেশন। বন্দে ভারতের মতো বিলাসবহুল ট্রেন হচ্ছে, তীর্থযাত্রা করানোর বন্দোবস্ত হচ্ছে। আর যাত্রী সুরক্ষা?
রেলের খরচ সঠিক খাতে হচ্ছে তো? সাধারণ মানুষের প্রাণের মূল্য নেই অথচ স্টেশনগুলিকে প্রায় শপিংমল করে তোলার যুক্তি কোথায়? মোদি ৩.০ সরকার ক্ষমতায় আসার দিন কয়েকের মধ্যে ঘটা এই দুর্ঘটনা ফের কেন্দ্র সরকারকে কাঠগড়াতেই দাঁড় করাল। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে বলছেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার পরিকল্পিতভাবেই রেল মন্ত্রককে ‘ক্যামেরা চালিত’ আত্মপ্রচারের মঞ্চে পরিণত করেছে। গত ১০ বছরে মোদি সরকার রেল মন্ত্রকের চরম অব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
আরও পড়ুন- কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ‘সুরক্ষা কবচ’ কোথায়? এত বড় দুর্ঘটনার দায় কার?
রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। গতবছর করমণ্ডলের পর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। তিনি একটি ভিডিওতে দু'টি খেলনা গাড়ি নিয়ে বুঝিয়েওছিলেন কীভাবে কবচ কাজ করলে দুর্ঘটনা কমবে। বাস্তবে, কবচের কথা বলা হলেও সব কবচের টেন্ডারই ডাকা হয়নি। ভারতীয় রেল ১০ হাজার কিমি রেললাইনের জন্য টেন্ডার ডেকেছিল। এর মধ্যে ৬ হাজার কিমি পথের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ-মধ্য রেলের ১৪৬৫ কিমি পথের ১৩৯টি ইঞ্জিনে কবচ লাগানো হয়েছে। কবচের বরাত পেয়েছে দিল্লি-মুম্বই (আমেদাবাদ-বদোদরা সেকশন) এবং দিল্লি-হাওড়া (লখনউ-কানপুর সেকশন) করিডর। পূর্ব রেল, পূর্ব-মধ্য রেল, উত্তর-মধ্য, উত্তর রেল, পশ্চিম-মধ্য রেল এবং পশ্চিম রেলের প্রায় ৩ হাজার রুটে কবচ দেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ রেল পথে যে কবচ ব্যবস্থা দেওয়া হলো না কেন? আদৌ টেন্ডার ডাকা হয়েছে তো?
ভুল ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপের কারণেই রেলের নিরাপত্তা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে বলে মত বিরোধীদের। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও বলছেন, রেলমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুধু প্রচার আর সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে মেতে ছিলেন অশ্বিনী বৈষ্ণব। রেলমন্ত্রী রিল বানান ঠিকই কিন্তু আমজনতার জীবন নিয়ে ভাবেন না।