বিশ্বভারতীর আপত্তি, রবীন্দ্রনাথ সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন নজরুলের পাশে

তিনি এবং কয়েকজন মিলে তৈরি করেছিলেন ফিল্ম প্রোডাকশন হাউস। যার নাম ছিল বেঙ্গল টাইগার পিকচার্স।

‘বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’। একথা তাঁকেই মানায়। তিনি বিদ্রোহী। তিনি হোমশিখা, সাগ্নিক-যমদগ্নি। তিনি কবিতায় সমাজের মুখে সপাটে চড় মারতে পারেন। এসব চেনা বৃত্তের মধ্যে নজরুল। এসবের বাইরে নজরুলকে পাওয়া যায়, সেখানে তিনি আদ্যন্ত চলচ্চিত্রজগতের মানুষ। নিজের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নারদের পৌরাণিক ইমেজ ভেঙেছেন তিনি। মুসলমান হয়ে নারদ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছেন, তোয়াক্কা করেননি। এই নজরুল অনেকের কাছে অচেনা।

 

তাঁর জন্মদিনের মাহেন্দ্রক্ষণে এই নজরুলকে আবিষ্কারের দায় থেকে যায়। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক, সংগীততকার, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, গায়ক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, পৃষ্ঠপোষক, প্রযোজক ও সংগঠক হিসেবে সাফল্য পেয়েছেন।

 

বাংলায় বিভিন্ন সাহিত্যিকের রচনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং এখনও হয়। কিন্তু নজরুলের বেশ কিছু উপন্যাস ও গল্প নিয়ে যেমন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তেমনই তিনি নিজেও সরাসরি যুক্ত ছিলেন অনেক চলচ্চিত্রের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের নাম ‘ধূপছায়া’। এই ‘ধূপছায়া’-তে বিষ্ণুর চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। 'ধ্রুব’ ছবিতে নারদের চেনা পৌরাণিক ইমেজ সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে দেখা গেল এক সুদর্শন যুবককে। চুড়ো করে বাঁধা ঝাকড়া চুল, তাতে ফুলের মালা, ক্লিন শেভড, পরনে সিল্কের লম্বা কুর্তা, গলায় মালা, হাসি হাসি মুখ। চলচ্চিত্রের পর্দায় এভাবেই নারদরূপে আবির্ভূত হলেন নজরুল। সেখানে অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি। একজন পোড় খাওয়া অভিনেতার থেকে কোনও অংশে কম যান না।

 

আরও পড়ুন: বাসর রাতেই ফেরার বিদ্রোহী কবি! এ এক অন্য নজরুলের গপ্পো

 

‘ধ্রুব’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি। একজন মুসলমান যুবক নারদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে সেসময় বেশ বিতর্কও হয়েছিল। তার ওপর বৃদ্ধ নারদের চিরাচরিত বেশভূষা পরিবর্তন করে দেওয়া। অনেকটা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। তবে নজরুল এইসব সমালোচনাকে পাত্তা দেননি। নজরুল জবাবে বলেন, “আমার নতুন সাজে অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছেন কিন্তু নারদের বয়সের উল্লেখ কোথাও কি আছে? তাঁকে বৃদ্ধ বৈরাগী বেশে দেখানো হয় কোনও প্রমাণের ওপর নির্ভর করে?’’

 

এখানেও ছক ভাঙা নজরুল।


ম্যাডান থিয়েটার্স প্রযোজনা সংস্থা বিভিন্নভাবে নজরুলের সঙ্গে প্রাপ্য পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতারণা করে। ফলে নজরুল ১৯৩৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। এরপর নজরুল আর নির্দিষ্ট প্রযোজনা সংস্থায় আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন সিনেমায় সংগীত পরিচালনা ও গান লেখার কাজে জড়িত হয়ে পড়েন। ম্যাডান থিয়েটার্স ছাড়াও নজরুল জড়িত হন নিউ থিয়েটার, পাইওনিয়ার ফিল্মস, কালী ফিল্মস, দেবদত্ত ফিল্মস, ফজলী ব্রাদার্স প্রযোজিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে তিনি অবতীর্ণ হন বিভিন্ন ভূমিকায়।

 

নজরুল সিনেমাজগতে আসেন নির্বাক যুগের গোধূলিবেলায়। তিনি ছুঁয়ে যান চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখাকে। তিনের দশকের শেষের দিকে চলচ্চিত্র নির্দেশক পদে যোগদান করলেন বিখ্যাত পাইওনিয়ার কোম্পানিতে। ‘ধ্রুব’ ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক ছাড়াও ছিলেন যৌথ নির্দেশক। এরপর দ্বিভাষিক ছবি ‘‌বিদ্যাপতি’‌। ১৯৩৭। দেবকী বসুর নির্দেশনা। বড় ব্যানারের কাজ। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনা। দুর্গাদাস, পাহাড়ী সান্যাল, ছায়াদেবী, কাননদেবীর অভিনয়-সমৃদ্ধ এই ছবি। ১৯৩৯-এ নজরুলের কাহিনি অবলম্বনে দ্বিভাষিক ছবি ‘সাপুড়ে’ তৈরি হয়। নিউ থিয়েটার্স, দেবকী বসু, কানন দেবীর সমন্বয়ে। নজরুলের গান ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ জনপ্রিয় হয়েছিল। সংগীত পরিচালনায় খ্যাতি ছিল তাঁর। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোতে গ্রামোফোনের বিকাশলগ্নে তিনি প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও সংগীত-ব্যক্তিত্ব। প্রথমেই বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় 'গোরা’ ছবির কথা। কারণ এখানে রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে নজরুলের সংগীত পরিচালনা ছাড়পত্র পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘গোরা’। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। বিশ্বভারতী আপত্তি করে যে, ছবিটিতে সঠিকভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হচ্ছে না। নজরুল তখন সোজা চলে যান কবিগুরুর কাছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে সমর্থন করেন, এবং বিশ্বভারতীর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, “আমার গান কীভাবে গাইতে হবে, সেটা কি তোমার চেয়ে ওরা ভালো বুঝবে?”

 

১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। তিনি এবং পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই ছবির গীতিকার। ‘পাতালপুরী’ সিনেমাটি কয়লাখনির শ্রমিক ও সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এই ছবির জন্য ‘ঝুমুর’ সুরে গান রচনা করেন নজরুল।

 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ও ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গৃহদাহ’ সিনেমার সুরকার ছিলেন নজরুল। সংগীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। ১৯৩৭ সালের সুপারহিট সিনেমা ছিল ‘বিদ্যাপতি’। কবি বিদ্যাপতির জীবনীভিত্তিক এই সিনেমার গল্প লেখেন নজরুল। চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় ছিলেন দেবকী বসু। ছবিটির সুরকার ছিলেন নজরুল ও রাইচাঁদ বড়াল। ১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’। এর কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। পরিচালক দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এই সিনেমাটি ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছিল।

 


সে সময় বুদ্ধিজীবীদের অনুশাসন ছিল চলচ্চিত্রের মাথায়। তা সত্ত্বেও 'কপালকুণ্ডলা’‌-য় (১৯৩৩) গীতিকার, ‘‌পাতালপুরী’‌–তে (১৯৩৫) সংগীত পরিচালনা, ‘‌নন্দিনী’-তে (১৯৪১) সুরকার, দ্বিভাষিক ‘‌চৌরঙ্গি’‌-তে (১৯৪২) গীতরচনা ও সংগীত পরিচালনা, ‘‌দিলখুশ’‌ (১৯৪৩), ‘‌শহর থেকে দূরে’‌ ও ‘‌অভিনয় নয়’‌ (১৯৪৫) প্রভৃতি ছবিতে তিনি গীতিকার। সিনেমায় ধ্বনিসংযোগ আর গ্রামোফোনের রেকর্ডের গানের বিকাশলগ্নে নজরুলের স‌ংগীতব্যক্তিত্ব তখন প্রখর। তাই তখন তিনি গীতিকার, সুরকার ও স‌ংগীত-নির্দেশক হিসেবে সাফল্য পেয়েছেন। প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেছেন। তাঁর চৈতন্যে তখন ‘জাগিয়ে দে রে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন’। তিনি এবং কয়েকজন মিলে তৈরি করেছিলেন ফিল্ম প্রোডাকশন হাউস। যার নাম ছিল বেঙ্গল টাইগার পিকচার্স।

 


নজরুলের জাদুস্পর্শে বাংলা সাহিত্য যেমন ঋদ্ধ, তেমনই পরিণতি পেয়েছে চলচ্চিত্র দুনিয়া। এখানেই তিনি- অজর, অমর, অক্ষয়।

 

 

 

More Articles