চুম্বন, চড় কিংবা প্রত্যাখ্যান, আজও শিহরণ জাগায় অস্কারের মঞ্চে ঘটা এইসব বিতর্কিত ঘটনা

Biggest Oscar Controversies : কখনও চড় মারা কখনও আবার নগ্ন পোশাক, যে যে বিতর্ক ঘিরে থেকেছে অস্কারের মঞ্চকে

‘অস্কার’, নামটাই কাফি। এই একটা পুরস্কার নিয়ে সারাবছরই চলে তরজা। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটিই সবথেকে সেরা সম্মান। জমকালো এই আসর ঘিরে ইতিমধ্যেই উত্তেজনা তুঙ্গে। আজ সকাল থেকেই খবরের শিরোনাম দখল করেছেন এবছরের সেরারা। গত কালই ছিল অস্কারের মঞ্চে ফল ঘোষণা। সেখানেই জোড়া সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের দেশ। এবার ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানের ৯৫তম সংস্করণ। ৬৪ বছরের দীর্ঘ ঐতিহ্যের বদল ঘটে এবার, রেড কার্পেটে রং বদলে ফেলে আয়োজক সংস্থা। আর এই এত বড় একটা অনুষ্ঠানকে ঘিরে প্রায় প্রতি বছরই কোনও না কোনও বিতর্কের সূচনা হয়। এমনকী এ বছরেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি অস্কারের মঞ্চকে। তেলেগু RRR ছবিকে বলিউডি তকমা দেওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে জোর তরজা। তবে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গত বছরগুলিতে ঘটে যাওয়া বিতর্কিত ঘটনাগুলির দিকে ফিরে তাকালে অবশ্য আজকের ঘটনাকে দেখে বিশেষ অবাক হতে হয় না। এই আসর নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনাও যেমন কম হয় না তেমনই নানা ধরনের বিতর্কও জুড়ে থাকে অস্কার অনুষ্ঠানকে ঘিরে। আসুন ফিরে দেখা যাক সেই সব।

১৯২৭ সালে সূচনা হয় একাডেমি অব মোশন পিকচার্স আর্ট অ্যান্ড সায়েন্সের। সিনেমাশিল্পে শ্রম অসন্তোষ ঠেকাতেই মূলত এর প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন এক বিখ্যাত সিনেমা কোম্পানি মেট্রো গোল্ডেন-মায়ারের অন্যতম প্রতিষ্ঠা লুইস বি মায়ার এর অন্যতম উদ্যোক্তা। মূলত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের বাইরে এসে শ্রমিক সমস্যা সমাধান করতে অভিনেতা, পরিচালক, লেখক, কলাকুশলী ও প্রযোজকদের জোট এটি। তার পর সেই জোট থেকেই ঠিক হয় সিনেমা বানানোর পিছনে হাজার মানুষের বিশ্ব জুড়ে যে শ্রম রয়েছে তার সম্মান ফিরিয়ে দিতে, স্বীকৃতি দিতে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হবে প্রতি বছর। আর এই উপলক্ষ্যে ১৯২৯ সাল থেকে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী অস্কার।

আরও পড়ুন - অস্কারের দৌড়ে বাঙালির নাম, ত্রিশ বছরের পুরনো সত্যজিতের স্মৃতি কি ফিরিয়ে দেবে ২০২৩?

নানা বিতর্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে গত বছরের ঘটনা। ২০২২ সালের অস্কারের মঞ্চ। হঠাৎই কমেডিয়ান ক্রিস রককে দুম করে চড় মেরে বসলেন উইল স্মিথ। ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমতো হতবাক সকলেই। রক তখন মঞ্চে সেরা ডকুমেন্টারি ফিচার ক্যাটাগরির পুরস্কার উপস্থাপন করছিলেন, ঠিক এরকম সময়ে আচমকা তাঁকে চড় মারেন স্মিথ৷ এর কারণটা অবশ্য বেশ জটিল। এবং বিস্তারিত। আসলে স্ত্রীর অপমান মেনে নিতে পারেননি উইল স্মিথ। স্ত্রী জাদা পিঙ্কেট স্মিথের টাক মাথা নিয়ে বিতর্কিত রসিকতা করেন কমেডিয়ান ক্রিস রক। ব্যাস এটাই বুমেরাং হয়ে যায়। কৌতুক থেকেই ভয়ংকর বিতর্ক। আসলে অ্যালোপেসিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই মাথায় চুল নেই জাদার ৷ তাই স্ত্রীর এই দুর্বল বিষয়টিকে মজার উপজীব্য হিসেবে মেনে নিতে পারেননি উইল স্মিথ। যদিও চড় মারে পর জল গড়ায় অনেকদূর। টানা দশ বছরের জন্য উইল স্মিথকে নিষিদ্ধ করে অ্যাকাডেমি। যদিও গত বছরে ম্মিথকে মঞ্চে উঠতে হয়েছিল বড় এক উপলক্ষের কারণেই। আর সেটি হলো সেরা অভিনেতার অস্কার নেওয়া। ‘কিং রিচার্ড’ ছবিতে রিচার্ড উইলিয়ামস চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ৯৪তম অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন উইল স্মিথ। তবে সবকিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল এই চড়কাণ্ড।

ফিরে যাওয়া যাক শুরু সময়কালে। সময়টা ১৯৩৬ সাল। ততদিনে যথেষ্ট নাম করে গিয়েছে অস্কার পুরস্কার। এই পুরস্কারের সম্মান ঠিক কতটা, তাও টের পেয়েছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু এই সবের তোয়াক্কা না করেই এমন একটা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখানো হল। এ ঘটনাও কম বিতর্কিত নয়। ‘দ্য ইনফরমার’ সিনেমার জন্য সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে অস্কার পেয়েছিলেন ডাডল নিকোলাস। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এই পুরস্কার ফিরিয়ে দেন তিনি। অসকদ সেই সময় লেখকদের সংস্থা রাইটার্স গিল্ড ধর্মঘট ডেকেছিল। একজন লেখক হিসেবে ডাডলি নিকোলাস সেই ধর্মঘটের প্রতি সংহতি জানিয়ে অস্কার গ্রহণ করেননি। আর এটাই ছিল অস্কার অস্বীকৃতির প্রথম ঘটনা।

আরও পড়ুন - দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স : ভারতকে প্রথম অস্কার এনে দিল যে ৪১ মিনিটের কাহিনি!

এরপর অবশ্য এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। ১৯৩৬ সালের পর ১৯৭১ সাল এবং ১৯৭৩ সালের অস্কারের মঞ্চ ফের সাক্ষী থাকে এই পুরস্কার অস্বীকারের ঘটনার। প্রথম ঘটনাটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন জেনারেল জর্জ এস প্যাটনের জীবনী নিয়ে সিনেমা ‘প্যাটন’ সেরা ছবির অস্কার পেয়েছিল। ‘প্যাটন’-এর ভূমিকায় অভিনয় করা জর্জ সি স্কট পেয়েছিলেন সেরা অভিনেতার অস্কার। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। তাঁর প্রতিবাদ এই গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধেই, কোনও একজনকে সেরা হিসেবে বেছে নেওয়ার তাঁর ঘোর আপত্তি। দ্বিতীয় ঘটনাটি ‘দ্য গডফাদার’-এর জন্য সেরা অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডোকে ঘিরে। তিনিও ফিরিয়ে দেন সেরার শিরোপা। চলচ্চিত্রে আদিবাসী আমেরিকানদের যথাযথ মর্যাদা না দেওয়ার প্রতিবাদেl স্বরূপ এই পথ বেছে নিয়েছিলেন মার্লোন।

এছাড়াও সেরা হিসেবে বিবেচনা নিয়ে বিতর্ক তো রয়েছেই। ১৯৪২ সালে সেরা ছবি হিসেবে অস্কার পাওয়া ‘হাউ গ্রিন ওয়াজ মাই ভ্যালি’ অথবা ১৯৯৫ সালের ‘ফরেস্ট গ্যাম্প’ ছবি থেকে শুরু করে ২০০৬ সালে সেরা সিনেমার পুরস্কার পাওয়া ‘ক্র্যাশ’ অথবা ২০১৯ সালের ‘গ্রিন বুক’- এর নাম সবই রয়েছে তালিকায়। রয়েছে আরো অজস্র নাম। শুধু তাই নয় পোশাক নিয়েও নানা বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছে কলাকুশলীদের। অভিনেত্রী তথা গায়িকা শের এর পরা পাখির পালকের পোশাক থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সালের অনুষ্ঠানে পুরুষ ফটোগ্রাফার তথা শিল্পী রবার্ট ওপেলের সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অস্কার মঞ্চে উঠে যাওয়ার ঘটনা, সবই পরপর সজ্জিত রয়েছে বিতর্কের হিসাব হিসেবে।

আরও পড়ুন - বিশ্বজয়ী নাটু নাটু! লেডি গাগা, রিহানাদের ফেলে ভারতের দ্বিতীয় অস্কার জিতল যে গান

আরও একটি বড় বিতর্ক হল ২০১৭ সালের অস্কারের মঞ্চে খাম বিতর্ক। উপস্থাপক ওয়ারেন বিটি এবং ফায়ে ডুনাওয়ে সম্প্রচারের শেষে খাম খুলে ঘোষণা করেন যে লা লা ল্যান্ড হল সে বছরের সেরা ছবির বিজয়ী। খানিক পরই বোঝা গেল, এটা ভুল। নতুন করে ঘোষণা এল, সেরা ছবি আসলে ‘মুনলাইট’। লাইভ অনুষ্ঠানে এমন একটু বড় ভুলের ঘটনা অস্কার বিতর্ককে আরও রসদ জুগিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

চড় বিতর্ক যেমন অস্কারকে ঘুরে থেকেছে ঠিক তেমনি চুম্বন বিতর্কও রয়েছে এই মঞ্চকে ঘিরে। ২০০৩ সালের ঘটনা। অস্কারের মঞ্চে দ্য পিয়ানিস্ট-এ তাঁর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে অস্কার গ্রহণ করার সময় অ্যাড্রিয়েন ব্রডি উপস্থাপক হ্যালি বেরিকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাঁকে আবেগের সঙ্গে চুম্বন করে বসেন। এমন আকস্মিক এই চুম্বনের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই চমকে দিয়েছিল সকলকে। এমনকী খোদ উপস্থাপক হ্যালি বেরি নিজেও পরবর্তী সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে নিজের অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

এবং সবশেষে ২০১৫ সালের ট্যুইটার বিতর্কের ঝড়। সেবারের অস্কার মনোনয়নের তালিকায় সবকটি নামই কেবল শ্বেতাঙ্গদের। এর ফলে #OscarsSoWhite হ্যাশট্যাগ-সহ এপ্রিল রেইনের সূত্রপাত হয়, তার জেরে বিতর্কের জল গড়ায় অনেক দূর। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এই অস্কারের খ্যাতির তুলনায় কুখ্যাতিই যেন বেশি।

More Articles