অটূট সম্পর্কের টানে গাছে পরানো হয় তালা, যে কারণে বিখ্যাত রাশিয়ার প্যাডলক ট্রি পার্ক

Padlock Trees Park, Russia: সম্পর্ক যাতে চিরকালীন হয়, তার জন্যে সম্পর্কে রীতিমতো তালাচাবি মেরে তাকে ফেলে আসেন এক আশ্চর্য গাছের কাছে।

চারদিকে কান পাতলেই সম্পর্ক ভাঙার গল্প। প্রেম ভাঙছে, ভাঙছে বিয়ে। ক্রমাগত কমছে মানুষের সহনশক্তি। সেটা অবশ্য একদিক থেকে ভালোও। তিক্ত বিষাক্ত সম্পর্কের ছড়াছড়ি আগেও ছিল ঢের। তবে সে সময়কার সমাজ, পরিবার, তথাকথিত রক্ষণশীলতা, লোকভয় ডিভোর্সকে সেইভাবে মান্যতা দিত না। ফলে মানুষ সারা জীবন বয়ে বেড়াতেন একটা মরে যাওয়া সম্পর্কের মৃতদেহ। তা থেকে পচে দুর্গন্ধ বেরোত। সেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও। তবে সেইসব ট্যাবু ভেঙে বেড়িয়ে এসেছে আজকের প্রজন্ম। 'লোকে কী বলবে?'- এই ভয়কে দূরে ঠেলে সুখের চাবিকাঠি খুঁজে নিতে জানে তাঁরা। তবু সম্পর্কের চিরকালীন আর্তি তো দীর্ঘকাল টিকে থাকা। ভালোবাসায়, প্রেমে।

আরও পড়ুন: ২৭ জনের দেশে নিজস্ব সেনা থেকে নিজস্ব মুদ্রা, যেভাবে গড়ে উঠল প্রিন্সিপ্যাল অব সিল্যান্ড…

সেই ভালো থাকার গোপন সূত্র খুঁজতে মানুষ কত কিছুই তো করে। কেউ পুজো দেন, কেউ দেবস্থানে হত্যে দেন। কেউ সুতো বাঁধেন, কেউ আবার নানাবিধ আচার পালন করেন সম্পর্কের দীর্ঘায়ু কামনা করেন। জার্মানির মানুষ বিয়ের আগের রাতে আছড়ে আছড়ে ভাঙেন কাঁচের থালা, বাসন থেকে ফুলদানি ভাঙেন। তা নাকি নববিবাহিত দম্পতির জীবনে নিয়ে আসবে সৌভাগ্য। এমনটাই তাঁদের বিশ্বাস। আর এমনই বিশ্বাসে ভর করে পার্কে ছোটেন রাশিয়ার মানুষ। সম্পর্ক যাতে চিরকালীন হয়, তার জন্যে সম্পর্কে রীতিমতো তালাচাবি মেরে তাকে ফেলে আসেন এক আশ্চর্য গাছের কাছে।

অবতার সিনেমায় আমরা দেখেছি, কীভাবে শতাব্দী প্রাচীন স্মৃতিবৃক্ষ, আত্মাবৃক্ষের কাছে রাখা থাকে নাভিদের অস্তিত্বের ভ্রমরটি। সেই এওয়া গাছ তাঁদের জীবনকে সুনিশ্চিত করে, স্মৃতিকে সুরক্ষিত করে। ঠিক তেমনভাবেই যেন রাশিয়ার এই পার্কেও রয়েছে ভালোবাসা, সম্পর্ককে সুরক্ষিত করার বৃক্ষ।

রাশিয়ার মস্কোর প্যাডলক ট্রি পার্ক। লাভার্স লেন বা প্রেমের অলিগলি তো অনেক শুনেছেন। কিন্তু এই দেশে বরাদ্দ রয়েছে আস্ত একটি পার্ক শুধুমাত্র প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য। পার্ক বলতে একটি সেতু। সেতুর তলা দিয়ে তিরতির করে বয়ে যায় মস্কো নদী। আর সেখানেই রয়েছে সম্পর্কের সত্তা বহনকারী বৃক্ষসকল। সেই সেতুকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে আস্ত একটা পার্ক। প্যাডলক ট্রি পার্ক। রাশিয়ার বিখ্যাত জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম।

কোনও কোনও সম্পর্ক যেমন চিরকালীন, কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবার বড়ই তাড়াতাড়ি এসে পড়ে এক্সপেয়ারি ডেট। সেই সব সম্পর্কের সুখমুহূর্তটিতে যদি তালা মেরে চাবি ফেলে দেওয়া যেত সুদূর কোনও নদীর জলে, তাহলে বোধহয় মন্দ হত না। ঠিক সেই ভাবনা থেকেই বোধহয় জন্ম এই প্যাডলক ট্রি পার্কের। মস্কোর লুজকভ সেতুর উপরে রয়েছে বেশ কয়েটি প্যাডলক গাছ। যেখানে ঝোলে অজস্র তালা। প্রেমের, দাম্পত্যের, সম্পর্কের। যেমন মানত করে মন্দিরের বটগাছের গায়ে ধাগা বাঁধেন লোকে, এও অনেকটা তেমনই।

লুজকভ সেতুর উপরে এই সবকটি গাছই আসলে লোহার। তবে লোহার বলে তার মাহাত্ম্য কিছু কম ভাববেন না মোটেই। দলে দলে লোক প্রায় প্রতিদিন এই লুজকভ ব্রিজে আসেন এবং নিজেদের সম্পর্কের নামে একটি করে তালা বেঁধে দেন ওই সব গাছের শরীরে। তারপর তালাটি ছুঁড়ে ফেলে দেন মস্কো নদীর জলে। তাঁরা মনে করেন, ওই নদীর বুকে সযত্নে থাকবে তাঁদের সম্পর্কের ডোর। চিরকালীন সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি বুকে নিয়ে তাঁরা ফেরেন বাড়িতে।

খ্রিস্টান বিবাহবাসরে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার একটি চূড়ান্ত আচার বোধহয় চুম্বন। অন্য়ান্য় উপাচার, শপথ শেষে যাজক বলে ওঠেন, 'ইউ মে কিসড ইওর ব্রাইড'। সেই চুম্বনের পরেই সম্পন্ন হয় বিয়ে। রাশিয়ার এই প্যাডলক ট্রি পার্কের পাশেই রয়েছে ক্রিস্ট দ্য সাভিয়ার ক্যাথিড্রাল। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে একছুট্টে এই পার্কে চলে আসেন নববিবাহিতরা। এই পার্কে বিবাহচুম্বনটি খাওয়ার পরে তাঁরা সম্পর্কের তালাটি বেঁধে ফেলেন সেউ প্যাডলক গাছে। ওই সব ধাতব গাছ, ব্রিজ আর মস্কো নদী যে দীর্ঘদিন ধরে কত শত সহস্র ভালোবাসার সাক্ষী, তা গুনে শেষ করা অসম্ভব।

কেন এই সেতুর গাছে প্রেমের তালা ঝোলানোর এমন বাড়বাড়ন্ত। কবে থেকে শুরু হল এই রীতি। জানা যায়, নাদা নামে এক স্কুলশিক্ষিকা প্রেমে পড়েছিলেন রেলিজা নামে এক সার্বিয়ান অফিসারের। প্রণয়ের প্রতিশ্রুতিতে বাঁধা পড়ার পরে রেলিজা চলে যান গ্রিসে, যুদ্ধ করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নাদার কথা ভুলে প্রেমে পড়েন কোর্ফু নামে এক স্থানীয় মহিলার। তার পর যা হওয়ার তাই হয়। নাদার সঙ্গে বাগদান ভেঙে দেন রেলিজা। সেই ধাক্কা সহ্য করতে পারেননি নাদা। অল্পদিনের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান নাদা।

নাদা-রেলিজার প্রেম ভাঙার গল্প থেকে শিক্ষা নিয়েছিল স্থানীয় মেয়েরা। এর পর নিজেদের প্রণয়কে মজবুত করতে তাঁরা ওই ব্রিজে এসে নিজের ও ভালোবাসার মানুষের নাম লিখে তা তালাবন্দি করে ঝুলিয়ে দিতে লাগলেন। আর চাবিটা ফেলে দিতেন ছুঁড়ে ওই নদীর জলে। রাশিয়ার ওই বিশেষ সেতুটিতেই দেখা করতে আসতেন নাদা ও রেলিজা। ক্রমে সেই সেতুই হয়ে উঠল প্যাডলক ট্রি পার্ক। আসলে এর ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে প্রাচীন লোককথায়। সম্ভবত সেখান থেকেই এই রীচি আয়ত্ত করেছিলেন রুশরা। রূপকথাপ্রেমী মাত্রেই জানেন, রুশ রূপকথার ভাণ্ডার ঠিক কতটা সমৃদ্ধ।

তবে আগে নাকি ওই গাছে তালা ঝোলানোর ব্যাপারটি ছিল না। সেসময় প্রেমিক-প্রেমিকারা তালা ঝোলাতেন সেতুর রেলিংয়ে। ভারী ভারী তালার ওজনে ক্রমশ বেহাল হয়ে পড়ছিল সেতুর স্বাস্থ্য। তেমন ভাবে চললে অচিরেই ভেঙে পড়তে পারে ঐতিহ্যশালী লুজকভ সেতু। প্রমাদ গোনে প্রশাসন। সেতুর বুকে লাগিয়ে ফেলা হয় বেশ কয়েকটি ধাতব কাজ। এবার থেকে আর সেতুর গায়ে নয়, ওই ধাতব গাছেই প্রেমের তালা বেঁধে আসবেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। সেই থেকেই প্যাডলক ট্রি-র প্রসিদ্ধি।

আরও পড়ুন: ভালুকের সাজে প্যান্ট পরা মানুষ! চিনের এই চিড়িয়াখানায় যা ঘটেছে আসলে…

সেখানকার মানুষের বিশ্বাস, একবার তালা ঝুলিয়ে নদীর জলে ফেলতে পারলেই সেই সম্পর্ক লম্বা রেসের ঘোড়া। এবার সেই সম্পর্ক ভাঙতে গেলে নদীর বুক থেকে খুঁজতে হবে চাবিটি, খুলতে হবে তালা। আর সে কাজ তো চাড্ডিখানি কথা নয়। নদীর বুকে শুয়ে থাকা অযুত নিযুত চাবির মধ্যে আপনার প্রণয়-চাবিটি খুঁজবেন কোথায়! ফলে এ জন্মে সম্পর্ক ভাঙার প্রশ্নই দূরতম দ্বীপ।

আসলে মানুষ তো যুথবদ্ধ জীব। বেঁধে বেঁধে থাকাই তাঁদের চিরকালীন আর্তি। প্রতিদিন সম্পর্ক ভাঙে, সম্পর্কের তিক্ততায় ছারখার হয় জীবন। তবু মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। একজোট হয়ে থাকার স্বপ্ন দেখে, প্রতিজ্ঞা করে। আর সেই প্রতিজ্ঞার বুকেই আসলে একটা করে তালা আটকে দেয় এই প্যাডলক ট্রি পার্ক। যার চাবি রাখা থাকে নদীর বুকের কাছে। যার চাবি থেকে যায় সভ্যতার কাছে। আসলে যুথতাই যে একমাত্র স্রেয়, সেই বার্তা নিয়ে তিরতির করে বয়ে চলে নদী মস্কো।

 

More Articles