রানিকে আস্ত মেলা উপহার! কেন দোল শেষে শুরু হয় প্রাচীন বারোদোল মেলা?

Barodol Mela: রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে বারোটি বিগ্রহকে দক্ষিণমুখে দোলনায় বসিয়ে সূচনা হয় পুজোর। অর্চনা চলে মূলত তিনদিন ধরে। তবে মেলা চলে আরও কয়েকদিন।

সন্ধেবেলার কৃষ্ণনগর। ফোয়ারার মোড়। আলেখ্য স্টুডিয়ো। এই স্টুডিয়োর আড্ডায় কয়েকবছর আগেও নিয়মিত আসতেন বিশিষ্ট কৃষ্ণনাগরিক সুধীর চক্রবর্তী। গত বছর, সন্ধের দিকে আলেখ্যর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কানে এল টিউশন থেকে ফেরা এক শিশুর নিষ্পাপ আবেদন, ‘মা, আজ বারোদোল মেলায় যাবা?’

হ্যাঁ ঠিকই, এটাই তো বারোদোল মেলার সময়। কতবার গেছি বারোদোলে, মা-ভাইয়ের সঙ্গে। কত ধরনের মাটির পুতুল, কাঠের কাজ, বাঁশের কাজ দেখেছি। মেলা ঘুরতে-ঘুরতে ঘেমে-নেয়ে উঠলে, পরিশ্রান্ত গলা ভিজিয়ে নিয়েছি হাঁসখালির সুগন্ধি সরবতে। কখনও ঠোঙাভরে কিনে এনেছি জিলিপি। বালিতে ভাজা খোলাসুদ্ধ বাদাম, বড় কুচকুচে কালো কড়াই থেকে তোলা নিমকি, কটকটি। যারপরনাই অবাক হয়েছি, গঙ্গা-যমুনা- জন্ম প্রতিবন্ধী দুই বোনের একত্র দেহসংস্থান কিংবা একটা ছাগলের দুটো মুখ দেখে কিংবা একটা গোলাকার নীচু গর্তের ভেতর জীবন হাতে নিয়ে মোটর বাইকের খেলা, সার্কাসের ছেলেমেয়েদের মরণপণ সব ট্রিক!

গ্রামীণ অথবা মফস্সলের বড় মেলায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই জানবেন মেলার এইসব বিনোদন-উপকরণ সম্পর্কে। কিন্তু অন্যান্য মেলার সঙ্গে বারোদোল মেলার কিছু পার্থক্য আছে। বিশেষত মেলাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজঐতিহ্যের আবেগ।

আরও পড়ুন- প্রকাশ্যে জুয়া খেলেন মহিলারাও, বাংলার বিচিত্র এই মেলার সঙ্গে জুড়ে আছেন বেহুলা-লখিন্দর!

প্রকৃত অর্থে, বারোদোল মেলার বয়স সঠিক জানা যায় না। কে বা কারা এই মেলার প্রবর্তক তা নিয়েও নানা তর্ক রয়েছে। মেলাকে ঘিরে বিভিন্ন জনশ্রুতি, লোকগল্প আজও চলমান। তবে এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, প্রায় দুই-শতাব্দীরও প্রাচীন এই মেলার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও রাজবাড়ির অনুষঙ্গ।

‘বারোদোল’ কথাটির মধ্যেই রয়েছে বারো সংখ্যাটি। রাজবাড়ির কুলবিগ্রহ হলো বড় নারায়ণ। তার সঙ্গে আরও বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহ পুজো করা হয় এই উপলক্ষ্যে। জানা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজত্বকালে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, তেহট্ট প্রভৃতি স্থানে বেশ কিছু মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেইসব মন্দির থেকেই ওই বারোটি বিগ্রহ আনা হয়। তিনদিন ধরে দেবতার পুজো চলে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে।

ইতিহাস কী বলে? বসন্ত উৎসব শেষ হওয়ার পর, আরও এক রংদোলের বিশেষ ইঙ্গিত পাওয়া যায় গোপালভট্টের লেখা ‘হরিভক্তিবিলাস’ নামক বৈষ্ণবঅর্চনার আকরগ্রন্থে। ‘হরিভক্তিবিলাস’-এর একটি শ্লোকে জানা যায়:

‘চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে দক্ষিণাভিমুখং হরিম, দোলারূঢ়ং সমভ্যরচ্য মাসমান্দোলয়েৎকালৌ’।

বারোদোল মেলার তিথিগত এই ধারণাটি ‘হরিভক্তিবিলাস’ থেকে গৃহীত এবং সেই অনুযায়ী চৈত্রের শুক্লা একাদশীতে আবির প্রদান করে সমস্ত বিগ্রহদের অর্চনা করা হয়। রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে বারোটি বিগ্রহকে দক্ষিণমুখে দোলনায় বসিয়ে সূচনা হয় পুজোর। অর্চনা চলে মূলত তিনদিন ধরে। তবে মেলা চলে আরও কয়েকদিন। প্রথমদিন, সোনার অলংকার দিয়ে রাজবেশ, দ্বিতীয়দিন ফুলবেশ এবং তৃতীয়দিন দরিদ্র রাখালবেশে বিগ্রহদের পুজো করা হয়।

এবারে জেনে নেওয়া যাক এই মেলার সূত্রপাতের ইতিহাস-কথনগুলি। অনেক গবেষক মনে করেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় আসলে বারোদোল মেলার প্রবর্তক নন। কারণ, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে তাঁর সভার রাজকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখিত ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থে এই মেলার কোনওরকম উল্লেখ নেই। তবে এর পালটা-যুক্তি হিসেবে অনেকেই বলেন, ‘অন্নদামঙ্গল’-এর রচনাসাল ১৭৫২। আর বারোদোল মেলার জন্ম ১৭৬৪। তাই ‘অন্নদামঙ্গল’ বইয়ে এই মেলার প্রসঙ্গ না-থাকলেও, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই এই মেলার প্রবর্তক। কুমুদনাথ মল্লিক লিখিত, ১৩১৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত, ‘নদিয়ার কাহিনীতে’ এই মেলার নেপথ্যের জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয় মহিষী একইসঙ্গে ছিলেন রূপবতী ও গুণবতী। কথা ছিল, মহিষীর সঙ্গে রাজা বীরনগরের রাঘব রায় কর্তৃক নির্মিত জলবাটিকায় কয়েকদিন একত্র অবস্থান করবেন। দেখবেন স্থানীয় উলার জাতের মেলা। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের রাজকার্যের জন্য তা সম্ভব হলো না। তাই বাদ পড়ে গেল রানির সঙ্গে মেলা দেখা। সেই কারণে রাজবাড়ির সামনের প্রশস্ত মাঠে এক মেলার প্রবর্তন করেন রাজা, যেখানে রাজমহিষী ও অন্তঃপুরবাসিনীরা রাজপ্রাসাদ থেকে মেলা দেখবার সুযোগ পাবেন।

আরও একটি ভিন্ন মত আছে। নদিয়ারাজ গিরিশচন্দ্র রায় নাকি বারোদোলের প্রবর্তক। তাঁর রাজত্বের সময়কাল ১৮০২ থেকে ১৮৪১। এক্ষেত্রেও অনেকের ধারণা, গিরিশচন্দ্রের রাজমহিষীর অনুরোধেই বারোদোল মেলা প্রবর্তিত হয়।

আরও একটু অতীতের দিকে গেলে দেখা যাবে, ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত সংস্কৃত ‘ক্ষিতীশবংশাবলিচরিতে’ বা ১৮৫৭-এ দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় রচিত বাংলা ‘ক্ষিতীশবংশাবলিচরিত’-এ এই মেলার কোনওরকম উল্লেখ নেই। তবে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জে. এইচ. ই. গ্যারেট রচিত ‘বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গ্যাজেটারস: নদিয়া’ বইয়ে কিন্তু বারোদোলের উল্লেখ একটু অন্যভাবে আছে। সেখানে রয়েছে অসংখ্য সাধারণ মানুষের উৎসাহের ধারায় বছরের পর বছর ধরে এই মেলা বয়ে চলেছে।

তবে এত শত তথ্য উল্লেখের পাশেই বলা প্রয়োজন, কৃষ্ণনগরবাসীর এক প্রধান বিশ্বাস এখনও মেলাটিকে ঘিরে রেখেছে। তা হলো, একজন রাজা তাঁর রানিকে উপহার দিয়েছিলেন আস্ত একটি মেলা। সেই প্রেম-উপহারের নামই বারোদোল। ইতিহাস যে কথাই বলুক, রানির প্রতি রাজার প্রেমকর্তব্যের এই আখ্যান এখানে জনশ্রুতির রূপ নিয়েছে।

বারোদোল মেলার গায়ে তাই প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ এখনও অমলিন। বর্তমানে, এই মেলার বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে। বারোটি বিগ্রহের সব ক'টি বিগ্রহ আর শুক্লা একাদশীতে আসতে পারে না। কোষ্ঠীপাথরে গড়া অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মূর্তি এখন আর আসে না। এই নিয়ে অকল্যাণের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা যায়, তৈরি হয় নাগরিক মঞ্চ। বর্তমানে পটের গোপীনাথ পূজিত হন। আর মেলায় বিশ্বায়নের প্রভাবে প্রত্নস্বর অনেকটা পালটে গেছে। গ্রামীণ লোকজ দ্রব্যের পাশাপাশিই দেখা যায় বিগ বাজার, কলকাতা বাজার প্রভৃতি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত স্টলের ঝলকানি। এই মেলার স্থান রাজবাড়ির মাঠ হলেও এটি চালিত হয় স্থানীয় প্রশাসক ও এক বিশেষ কমিটি দ্বারা।

আরও পড়ুন- কলকাতার হস্তশিল্প মেলার মুখ চেয়ে বাঁচেন না বাংলার কারিগরেরা

সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মেলার আদিরূপ বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। বারোদোলের বিবর্তন চিহ্নগুলির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে খুব সহজেই উন্মোচিত হতে পারে সভ্যতা, সংস্কৃতির বদল ও অর্থনীতির সঙ্গে তার পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল সূক্ষ্ম খতিয়ানগুলি। যার মাধ্যমে বিশেষ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মায়।

আলেখ্য স্টুডিয়ো, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে যখন কানে ভেসে আসে পথচলতি সরল শিশু-উচ্চারণ, ‘মা, আজ, বারোদোল যাবা?’ সঙ্গে-সঙ্গে ধরা পড়ে সেই অকৃত্রিম শৈশবের আনন্দ, কিছুটা লোকায়ত সুরটানে। আর মনে পড়ে সুধীর চক্রবর্তীর লেখা সেই বইয়ের কথা, ‘উৎসবে মেলায় ইতিহাসে’। বইটির একটি জায়গায় তিনি লিখেছিলে, ‘যত উৎসবে আর মেলাতে আমি যাই, পা রাখি যত ইতিহাসাশ্রিত জনপদে, কানে আসে যত জনশ্রুতি আর কিংবদন্তি সেই সব কিছুর মধ্যে আমি কেবলই দেখি সাধারণ মানুষের উৎসুক মনের অনাবিল প্রসন্নতা। খুঁজে পাই তাদের জীবনস্পন্দ থেকে বেঁচে থাকার উদ্বৃত্ত আনন্দ, সেবা প্রবৃত্তির স্বতোচ্ছল প্রবাহ, আত্মদানের অমিতপুণ্য’।

আজ এই পরিবর্তমান সময়ে মেলার চরিত্র আর চালচিত্রের বদল বস্তুগতভাবে যেমন বোঝা সম্ভব তেমনই এর সমাজবিন্যাসের গভীর তলে থাকা পরিবর্তিত জটিল মনের হদিশও পাওয়া সম্ভব। তাই সামান্য সতর্ক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বারোদোলের সরেজমিন ভ্রমণে গেলে অনায়াসে ধরা পড়ে যায় জনমানসের জীবনস্পন্দের নতুনতর খোঁজ। যে খোঁজ শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে কোন পুরাতনী প্রেমকে, বাঁচিয়ে রাখে লোকায়ত ঐতিহ্যকে।

More Articles