বিশ্বজুড়ে 'ভাইরাল' চে গেভারার এই ছবিটিই! কীভাবে তোলা হয়েছিল এই ছবি?

Che Guevara Famous Photograph: চে গেভারার এই বিখ্যাত ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ। উপলক্ষ্য ছিল অন্ত্যেষ্টি।

সদ্য যে যুবক যুবতী সমস্ত পালটে ফেলার স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের একমাত্র প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠেন চে। তীক্ষ্ণ চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত হাসি আর বিপ্লবের দর্শন- সব কিছু এসে থিতু হয় চে আঁকা টি-শার্টে, চে আঁকা রিস্ট ব্যান্ডে, কপালের ফেট্টিতে, মাথার টুপিতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য বুকের বাঁদিকে স্থান পান। সেই আসন পাকা। তবে এই যে ঢালাও চে বন্দনা, লক্ষ্য করে দেখবেন মূলত এই সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় চে গেভারার একটি বিশেষ ছবি। এই ছবিটি ঠিক কখন তোলা? কোন মুহূর্তে কে চে-কে এভাবে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন? কেন চে'র সমস্ত ছবির মধ্যে বিখ্যাত হলো এই ছবিটিই? ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো এই ছবিটিকে ঘিরে রয়েছে এক অদ্ভুত ইতিহাস। কিউবান ফটোগ্রাফার আলবার্তো কোর্দা চে গেভারার এই ছবিটি তুলেছিলেন। পোস্টার, টি-শার্ট, তাস এবং আরও যা যা কিছু হয়, বিপণনযোগ্য বিপ্লব- সবেতেই সেই ছবিখানি ছাপানো। এই একটি ছবি তুলেই তবে বড়লোক হয়ে যেতে পারতেন আলোকচিত্রশিল্পী কোর্দা। এই একটি ছবির স্বত্বাধিকারের বদলেই কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবন, বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। কমিউনিজম এবং পুঁজিবাদের ঘোলা জলের মধ্য দিয়ে চে গেভারার এই ছবিটির যাত্রাপথ আসলে গভীর এবং গম্ভীরও।

আলোকচিত্রী

আলবার্তো ডিয়াজ গুটিয়েরেজ ১৯২৮ সালে হাভানায় জন্মগ্রহণ করেন। একটি স্টুডিওর সহকারী হিসেবে তখন ছবি তোলা শিখছেন আলবার্তো। বিয়ে, ব্যাপ্টিজম এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবিই মূলত তুলতে হতো তাঁকে। ১৯৫৩ সালে নিজস্ব স্টুডিও খোলেন তিনি এবং নিজের নাম পালটে করে দেন আলবার্তো কোর্দা। কয়েক বছরের মধ্যেই আলবার্তোর স্টুডিও কোর্দাস কিউবার প্রথম সারির ফ্যাশন ফটোগ্রাফি স্টুডিও হয়ে ওঠে। কোর্দা অবশ্য পরে স্বীকার করেছিলেন, তিনি ফ্যাশন ফটোগ্রাফিকেই বেছে নিয়েছিলেন কারণ, এখানে সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর একটা বড় সুযোগ ছিল।

ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে কোর্দার সাফল্য চূড়ায় পৌঁছলেও ১৯৫৯ সালে তা আকস্মিকভাবেই থেমে যায়। কোর্দা বলেছিলেন, “৩০-এর কাছাকাছি, সাধারণ, তুচ্ছ এক জীবনযাপনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ঠিক তখন এক ব্যতিক্রমী ঘটনা আমার জীবনকে বদলে দেয়: কিউবার বিপ্লব।" ফিদেল কাস্ত্রো এবং আর্নেস্তো চে গেভারা সেই বছরের জানুয়ারিতে হাভানায় আসেন এবং তাঁদের আসার পরপরই ফ্যাশন ফটোগ্রাফার কোর্দা হয়ে ওঠেন বিপ্লবী চে'র ফটোগ্রাফার এবং কাস্ত্রোর বন্ধু।

এই ছবিটির বিশেষ মুহূর্ত

চে গেভারার এই বিখ্যাত ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ। উপলক্ষ্য ছিল অন্ত্যেষ্টি। হাভানায় অস্ত্র বহনকারী একটি ফরাসি জাহাজে নাশকতা এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। হাভানার রাস্তায় তখন অগণিত মানুষের ভিড়। কোর্দা সেখানে 'রেভোলিউশন' নামে এক সংবাদপত্রের জন্য কাজ করছিলেন। কাস্ত্রোর বক্তৃতা শেষ হতেই মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান কোর্দা। কাস্ত্রোর সঙ্গে তখন উপস্থিত বিপ্লবের অন্যান্য নেতারাও। ফরাসি লেখক জাঁ-পল সার্ত্র এবং সিমোন দ্য ব্যোভোয়ার এবং অবশ্যই চে ছিলেন মঞ্চে। কোর্দা যখন মঞ্চের কাছাকাছি আসেন, তিনি লক্ষ্য করেন মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা চে অনেকটা এগিয়ে এসেছেন।

আরও পড়ুন- “যে পেনাল্টিটা আটকালাম, ইতিহাসে খোদাই করা থাকবে”, চিঠিতে লিখেছিলেন কোচ চে গেভারা

"আমার মনে আছে তিনি রাস্তায় ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন,” স্মৃতিচারণে বলেছিলেন কোর্দা। কোর্দার আলোকচিত্রী চোখ বুঝতে পারে চে'র মুখে তখন যন্ত্রণা ফুটে উঠছে, একইসঙ্গে ফুটে উঠছে রাগ এবং ক্ষোভ। কোর্দা প্লাস-এক্স ফিল্ম ভরে একটি Leica M2 দিয়ে ছবি তুলছিলেন। তাতে তখন লাগানো 90mm Leica টেলিফটো লেন্স। চে সরে যাওয়ার আগে তিনি মাত্র দু'টি ফ্রেম তুলতে পারেন – একটি লম্বালম্বি ছবি, একটি আড়াআড়ি।

কোর্দা যখন তাঁর স্টুডিওতে ফিরে আসেন, তখন তিনি এই ছবির রিলটি থেকে Revolución সংবাদ পত্রের জন্য বেশ কিছু প্রিন্ট তৈরি করেন। চে গেভারার ছবিটির ক্ষেত্রে তিনি লম্বালম্বি ছবিটিই বেছে নেন, সেখান থেকে কেটে নেন কিছুটা।

তবে মজার বিষয়টি হলো, এই সংবাদপত্রটি চে গেভারার ছবিটি ব্যবহার করেনি। সার্ত্র এবং ব্যোভোয়ারের সঙ্গে কাস্ত্রোর একটি ছবি ছাপা হয় ওই কাগজে। বছরের পর বছর কেটে যায়, কোর্দার স্টুডিওর দেয়ালে পড়েই থাকে চে গেভারার ছবিটি। বন্ধুদের উপহার হিসাবে দেওয়ার জন্য অবশ্য কয়েকটি ছবি প্রিন্ট করিয়ে নিয়েছিলেন কোর্দা।

হঠাৎ যেভাবে 'ভাইরাল' চে গেভারার ছবি

১৯৬৭ সালের গোড়ার দিকের এক সকাল। রাতারাতি বদলে গেল সবটা! একজন ইতালিয় প্রকাশক, জিয়ানগিয়াকোমো ফেল্টরিনেলি, কিউবার সরকারের কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে আসেন। ওই চিঠিতে কোর্দাকে চে-র একটি প্রতিকৃতি খুঁজে দিতে সাহায্য করতে অনুরোধ করা হয়। কোর্দা তাঁর স্টুডিওর দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা চে গেভারার ছবিটির দিকে আঙুল তুলে বলেন, “এটা আমার তোলা"। ফেল্টরিনেলির ভীষণ পছন্দ হয় চে'র সেই ছবিখানি। দু'টি প্রিন্টের অর্ডার দিয়ে যান। পরের দিন যখন তিনি ছবিগুলি নিতে আসেন, তখন কোর্দা জানান, তিনি বিপ্লবীর বন্ধু। এই ছবির জন্য ফেল্টরিনেলির থেকে কোনও টাকাই নেবেন না তিনি।

এই দিনটির পর থেকেই বদলে যায় সবটা। ছবিটি একালের ভাষায় 'ভাইরাল' হতে শুরু করে। ১৯৬৭ সালের অগাস্টে প্যারিস ম্যাচ ম্যাগাজিনে 'লা গেরিলেরস' শিরোনামে একটি নিবন্ধে ছবিটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তবে ছবিটি কার তোলা তাতে উল্লেখ করা হয়নি এবং আজ অবধি কেউই জানেন না কীভাবে পত্রিকাটি এই ছবিটি পেয়েছিল। তারপর প্রায় একই সময়ে, জিম ফিটজপ্যাট্রিক নামে একজন আইরিশ শিল্পী একটি রঙিন পোস্টারের মডেল হিসাবে ছবিটি ব্যবহার করেছিলেন। ফিটজপ্যাট্রিক দাবি করেন, তিনি ছবিটি ডাচ নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী 'দ্য প্রোভোস'-দের থেকে পেয়েছেন। এই গোষ্ঠী আবার জানায়, তারা সার্ত্রের কাছ থেকে ছবিটি পেয়েছে।

কিন্তু ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে যখন বলিভিয়াতে চে-কে খুন করে ফেলা হয়, হত্যার নিন্দা জানিয়ে সারা বিশ্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ফেল্টরিনেলি চে গেভারার সেই ছবিটির হাজার হাজার পোস্টার ছাপিয়ে বিক্ষোভকারীদের কাছে বিক্রি করেন। ছবিটির নাম এখন গেরিলেরো হিরোইকো। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির সাবওয়ে বিলবোর্ডে শিল্পী পল ডেভিস এভারগ্রিন রিভিউ ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় বিজ্ঞাপন দিয়ে একটি চিত্রকর্ম হিসাবে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন- চে নয়, বাঙালির এক মরণজয়ী মাস্টারদা ছিল, সূর্য সেনকে ফিরে দেখা

ফিদেল সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজের সুরক্ষার জন্য বার্ন কনভেনশনকে স্বীকৃতি দেননি বা সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। ফলে কোর্দা বা চে গেভারার পরিবারের কেউই ছবিটি থেকে হওয়া কোটি কোটি টাকার ব্যবসা থেকে কিছুই বিশেষ অর্জন করেননি। কপিরাইট সুরক্ষা না থাকায় যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারে। ২০০০ সালে, কোর্দা একটি বিজ্ঞাপনে ছবিটি ব্যবহার করার জন্য ভোদকা কোম্পানি স্মার্নঅফের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কোর্দা বলেছিলেন, "চে গেভারা যে আদর্শের জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার একজন সমর্থক হিসাবে, যারা তার স্মৃতি প্রচার করতে চায় তাদের এই পুনরুত্পাদনের বিরুদ্ধে আমি বিরোধিতা করছি না। কিন্তু আমি স্পষ্টতই অ্যালকোহলের মতো পণ্যের প্রচারের জন্য বা চে'র সুনাম ক্ষুণ্ণ করে এমন কোনও উদ্দেশ্যে চে'র ভাবমূর্তি শোষণের বিরুদ্ধে।"

এই মামলার নিষ্পত্তি হিসেবে কোর্দা ৫০ হাজার ডলার পান। পুরোটাই তিনি কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় দান করেন। "চে এখনও বেঁচে থাকলে, তিনিও তাই করতেন,” কোর্দা বলেছিলেন। কিন্তু এই মামলাটিই প্রমাণ করে যে কোর্দা চে'র ছবি এবং যেকোনও ব্যবহারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। আজ বেশিরভাগ মানুষই চে'কে না জেনে, না বুঝেই 'দেখনদারি'র বিপ্লবের বেঞ্চমার্ক করে তুলেছে। চে'র বিপ্লবের ইতিহাস, কমিউনিজম সব আসলে এই মানুষদের কাছে মৃত। কেবল পণ্য বেঁচে আছে, বিপ্লবের খাস্তা পণ্য।

২০০১ সালে প্যারিসে তাঁর ছবিগুলির একটি প্রদর্শনীর সময়ই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আলবার্তো কোর্দা। তাঁকে হাভানায় সমাহিত করা হয়।

More Articles