মাইনাস ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে টানা অনশন! যে দাবিতে লাদাখে সরব বাস্তবের 'ব়্যাঞ্চো'
Sonam Wangchuk, Ladakh: চরম ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাস ১৭ ডিগ্রিরও নীচে। আর ওই ভয়াবহ আবহাওয়াতেই খোলা আকাশের নিচে বিক্ষোভে নেমেছেন লাদাখের প্রায় ২৫০ জন আন্দোলনকারী। ডাক দিয়েছেন আমরণ অনশনের।
কাশ্মীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে লাদাখ। ক্ষমতায় এসে থেকে একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছে মোদি সরকার। কখনও নোটবাতিল তো কখনও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল। ২০১৯-২০ সাল নাগাদ কাশ্মীর থেকে আলাদা করে দেওয়া হয় লাদাখকে। পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয় লাদাখকে। লাদাখের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার আশ্বাস দিয়েছিল বিজেপি সরকার। কিন্তু সেইসব ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি আদতে বাস্তবায়িত হয়নি। লাদাখের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বিজেপি সরকারের তরফে, তা রাখা হয়নি। গত ৬ মার্চ থেকে বিজেপির সরকারের সেই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে লাদাখের মানুষ। আর তার নেপথ্যে রয়েছেন পরিবেশকর্মী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক সোনম ওয়াংচু । ঠিকই ধরেছেন, সেই সোনম, যার ছায়ায় তৈরি হয়েছিল 'থ্রি ইডিয়টস' ছবির ফুংসুক ওয়াংড়ু তথা ব়্যাঞ্চো চরিত্রটি। ইতিমধ্যেই পনেরো দিনে পড়েছে তাঁর অনশন।
ভোটের সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভোট না যেতে যেতেই ভুলে যায় রাজনৈতিক দলগুলি। তেমনটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু লাদাখের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ভোট যেতে না যেতেই দেখা গেল, পরবর্তী লোকসভায় এসে সেই সমস্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ তো দূরের কথা, সেসব বেমালুম ভুলেই গেল মোদি সরকার। এমনই অভিযোগ তুলেছেন লাদাখের বিক্ষোভকারীরা। চরম ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাস ১৭ ডিগ্রিরও নীচে। আর ওই ভয়াবহ আবহাওয়াতেই খোলা আকাশের নিচে বিক্ষোভে নেমেছেন লাদাখের প্রায় ২৫০ জন আন্দোলনকারী। ডাক দিয়েছেন আমরণ অনশনের।
পরিবেশ, পড়াশোনা, ছাত্র, বিজ্ঞান নিয়ে মেতে থাকা সোনমকে কেনই বা পথে নামতে হল? বুধবার দেখতে দেখতে পনেরো দিনে পড়েছে তাঁর অনশন। সামনেই লোকসভা ভোট। ইতিমধ্যেই ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। ঘোষণা হয়ে গিয়েছে দিনক্ষণও। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দলের প্রার্থীঘোষণাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু লাদাখ রয়েছে লাদাখেই। গত চার বছর ধরে লাদাখবাসীর একটিও দাবি পূরণ করতে পারেনি মোদি সরকার। চার বছর আগে ঠিক এমনই সময়, যখন শিয়রে ভোট। লাদাখের বিভিন্ন বৈঠক, সভায়, মোদি সরকারের তরফে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলষ শুধু উনিশের লোকসভা ভোটেই নয়, কুড়ির পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনেও বলা হয়েছিল, লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিসের রক্ষাকবচ দেওয়া হবে। লাদাখে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিপুল ভোটে জয় পেয়েছিল বিজেপি। তারপর ক্ষমতায় এসে সে সমস্ত কিছুই ভুলেছে তারা। গত ৪ মার্চ স্পষ্ট ভাবে বিজেপি সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, ষষ্ঠ তফসিল হবে না।
আরও পড়ুন: অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ! ১৮০০০ ফুট উচ্চতায়, -৪০ ডিগ্রিতে কেন অনশনে বসছেন ওয়াংচুক?
তারপরেই ৬ মার্চ থেকে বিক্ষোভে নামেন সোনম-সহ লাদাখের অসংখ্য বাসিন্দা। ওই বিপুল ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে ভুখা পেটে বসে রয়েছেন তাঁরা। প্রতিশ্রুতি না পূরণ হলে আন্দোলন বন্ধ করবেন না। আমরণ চলবে তাঁদের অনশন। সেই অবস্থায় কম্বল গায়ে জড়িয়ে পরিবেশকর্মী সোনমের গলায় ঝড়ে পড়ল বিপুল হতাশা। সোনমের কথায়, "আমাদের পাহাড়গুলোকে বিভিন্ন শিল্প সংস্থা আর আর খনি সংস্থার কাছে বেচে দেওয়াটাই লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার আসল উদ্দেশ্য নয় তো? লাদাখের মানুষ সেটাই জানতে চায়।" যে আশা-ভরসা নিয়ে বিজেপি সরকারকে জিতিয়ে ক্ষমতায় এনে বসিয়েছিলেন মানুষ, সেই সরকারের প্রতি লাদাখের মোহভঙ্গ হয়েছে অচিরেই। সোনমের বক্তব্য, লাদাখে এখন না আছে স্থানীয়দের জন্য সংরক্ষণ, না আছে গণতান্ত্রিক কাঠামো। এখানে বিধানসভা নেই, নির্বাচিত নেতা নেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত একটি আমলাতান্ত্রিক শাসন চলছে লাদাখে। ফলে এক কালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চেয়ে আসা মানুষেরই আজ মোহভঙ্গ হয়েছে। লাদাখি সেনাদেরও মনোবল একই কারণে ভেঙে গিয়েছে বলে দাবি করেন সোনম। বলেন, "ওঁরা শুধু ভোটের কথা আর কতগুলো আসন জেতা যেতে পারে, সেই কথা ভাবেন। কিন্তু মানুষের কথা ভুলে যান। আমরা কেন্দ্রের কাছে এই নিশ্চয়তা চাই যে, ভবিষ্যতে তারা এ ভাবে প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করবে না।" কেন্দ্রের সঙ্গে একটি বহুপাক্ষিক আইনি চুক্তিই তাঁরা চাইছেন বলে সোনম জানিয়েছেন। তাঁদের লক্ষ্য ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্তি তো বটেই, সেই সঙ্গে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদাও।
কিছুদিন আগেই লাদাখের গালোয়ান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এগিয়ে এসেছিল চিনের ড্রাগন সেনা। তৈরি হয় যুদ্ধের পরিস্থিতি। অবস্থানগত ভাবে চিনের খুব কাছাকাছি হওয়ায় যুদ্ধের ভয় সবসময় লেগেই থাকে লাদাখবাসী। তার উপর পরিবেশগত দিক দিয়েও বসবাসের পক্ষে বেশ বন্ধুর এই এলাকা। তার পর কেন্দ্রীয় সরকারের এই অবহেলা! আরও একটা লোকসভা ভোট, তার ঘোষণা যেন প্রতিমুহর্তে লাদাখবাসীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে তাঁদের সঙ্গে বঞ্চনা করা হয়েছে।
ম্যাগসাইসাই জয়ী সোনমের আন্দোলনে সহমর্মিতা জানিয়ে কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (কেডিএ) বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। তবে এই আন্দোলন কিন্তু প্রথম নয়। ২০২৩ সালের গোড়াতেও একই রকম ভাবে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল লাদাখবাসীকে। দাবি না পূরণ হওয়ায় অনশনে বসেছিলেন সোনম-সহ কয়েকশো নাগরিক। প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখে সোনম জানিয়েছিলেন, ‘অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ’। পাথর এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য নির্বিচারে ডিনামাইট ফাটিয়ে লাদাখের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। পাশাপাশি জনজাতি অধ্যুষিত এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল কেন সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের মর্যাদা পাবে না সে প্রশ্নও তুলেছিলেন সোনম। সেসময় তাঁকে গৃহবন্দি করারও অভিযোগ উঠেছিল।
লাদাখের প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন সোনমরা। পাশাপাশি সেসব রক্ষার্থে কোনও পদক্ষেপও করেনি এ দেশের ক্ষমতাসীন সরকার। লাদাখের হিমবাহ বাঁচিয়ে রাখে গোটা ভারত উপমহাদেশকে। মার্চের শুরুতেই ভয়াবহ জলসঙ্কট দেখা গিয়েছিল দেশের দক্ষিণে। সেসময় লাদাখের আশীর্বাদেই উত্তর ভারত রক্ষা পায় বলে দাবি করেছেল লাদাখবাসী। লাদাখ সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হলে, এখানকার জমির উপর বহিরাগতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অবাধে জমি অস্তান্তর ও জমিবিক্রির আশঙ্কা কমবে বলেই মত বাসিন্দাদের।
তবে সোনম ও অন্যান্য বাসিন্দাদের এক বছপ আগের সেই অনশন, বিক্ষোভে আসলে ভেজেনি বিজেপি সরকারের চিড়ে। লাদাখের সমস্যা নিয়ে মাথা ব্যথা করেনি কেন্দ্র। প্রতিশ্রুতি দিয়েও মুনাফা লাভের আশায় লাদাখের জমি গোপনে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন সোনমরা। সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রের ভুল নীতির কারণেই চিন আস্তে আস্তে ভারতের ভূমি দখল করে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। অথচ এই সোনম কিন্তু এর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একাধিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। গালওয়ান সীমান্তে ভারত-চিন অশান্তির পর চিনা দ্রব্য বয়কটের প্রসঙ্গে মোদির পাশে দাঁড়াতেও দেখা যায় তাঁকে। অথচ সেই সোনমের মুখেই এখন বিজেপি বিরোধিতার সুর। ওয়াংচুক সাফ জানিয়েছেন, তিনি মহাত্মা গান্ধীর পথ অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সে কারণেই বেছে নিয়েছেন '২১ দিনের অনশন'।
আরও পড়ুন:লাদাখে চিনা টাওয়ার! ফের আগ্রাসনের ষড়যন্ত্র করছে চিন?
পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের তকমা, নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজস্ব বিধানসভা গড়ার সুযোগ-সহ একাধিক দাবি নিয়ে আপাতত খোলা আকাশের নিচে মাইনাস পনেরো ডিগ্রি তাপমাত্রায় অনশন করে চলেছেন এতগুলো মানুষ। এ লড়াই তাঁদের নিজেদের। নিজস্ব জমি, আদিবাসী সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াই। গোটা দেশের মানুষ যাতে লাদাখের এই লড়াইয়ে শরিক হতে পারেন, সে জন্য খোলা হয়েছে 'ফ্রেন্ডস অব লাদাখ' নামে একটি ভার্চুয়াল গ্রুপ। গোটা দেশের মানুষের সাড়া মিলেছে। সোনমের মতে, দেশের ২২টি মধ্যে বিজেপি শুধু ২৩তম ভাষাটিকেই বোঝে। আর সেটি হল বন্দুকের ভাষা। এবার বিজেপিকে ২৪তম ভাষা শেখাতে চান লাদাখবাসী। ওই সাংঘাতিক চরম আবহাওয়ার মধ্যে শান্তির পথেই নিজেদের অধিকার বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে চান সোনমরা। অনশন-বিক্ষোভে কাজ না হলে এক হাজার জন মানুষকে নিয়ে লাদাখ সীমানা পর্যন্ত হাঁটার পরিকল্পনাও রয়েছে বিক্ষোভকারীদের।