হেমন্ত আমার কেউ না

Late Autumn: স্মৃতি পরিত্যাজ্য, হেমন্ত পরিত্যাক্ত সেই স্মৃতির স্মারকের মতো। 

হেমন্ত আমার শিবুকাকু। আমার বাবার জেঠতুতো ভাই। অভাবের সংসারে আশ্রিতজন। সে আমাদের মধ্যেই ছিল। অথচ সে যে আছে আমরা কখনও ভাবিনি। সে ছিল না থাকার মতো করে। তার মৃত্যুর পর আমরা প্রথম একটু মন দিয়ে তাকালাম তার দিকে, প্রথম এবং শেষবার। জানলাম তার সারাজীবনের সঞ্চয় ছিল ২৬০ টাকা। জীবদ্দশায় সে একবারই আমার জেঠির সঙ্গে ঝগড়া করে দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ হয়ে যাওয়া দেশে ফিরতে যে পাসপোর্ট ভিসা লাগে সেটুকু তথ্যও তার জানা ছিল না। কাজেই বনগাঁয় গিয়ে অভিমানী শিবুকাকু দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে বাধ্যত ফিরে আসে।

হেমন্ত আমাদের জীবনে ফিরে আসে নিরুচ্চারে। প্রায় না আসার মতো করে। এসে মাটিতে বসে। আমরা তাকে উঠে সোফায় বসতে বলি না। সে বসে থাকে অনেকক্ষণ, দু'গাল মুড়ি খায়। দু'চারটে গেঁয়ো রসিকতা করে, উত্তর পায় না। তবু বসে থাকে, তারপর চলে যায়, যাওয়ার সময় মরিয়া হয়ে আবার আসব বলে যায়। এই গায়ে পড়া আত্মীয়তা দেখলে আমাদের গা জ্বলে যায়। কেননা আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি, এখন পিছনে ফিরে দেখার কোনো মানে হয় না। স্মৃতি পরিত্যাজ্য, হেমন্ত পরিত্যাক্ত সেই স্মৃতির স্মারকের মতো। 

অ্যাপার্টমেন্টের পুজোর ঢাকিকে দেখলেও তার কথা মনে পড়তে পারে। দূর গাঁ থেকে দু'চারদিনের বায়নায় আসা। পয়সা রোজগারের চাপ আছে বলেই আসা। দরদামে রাজি হয়ে যাওয়া। সারাদিন ঢাক বাজিয়ে রাতে শোয়ার জায়গা হয় আবাসনের গ্যারেজে, ক্লাবের মেঝেতে, খেতে হয় সব আলো নিভে গেলে, শুতে হয় চাটাই পেতে। সে চলে গেলে, সে যে এসেছিল আমাদের কারও আর মনে থাকে না। পুরনো জামাকাপড় দিয়ে তাকে বিদায় করার ভদ্রলোকি রেওয়াজ সম্বৎসর। ভদ্রবিত্তের অভ্যস্ত চেনাছকের জীবনে হেমন্ত টনসিলের মতো, অস্বস্তিকর, অতর্কিত নিম্নবর্গীয় আবির্ভাব। ভূত অনেকটা হেমন্তের মতো, আধচেনা মাথাব্যথা, সে কারণেই হয়তো সাহিত্যে যাবতীয় অশরীরীর ঈশারা পাই কুয়াশামাখা রাতে। অবশ্য এসবই আমার বিরস-দৃষ্টি। অকবির দেখা। কবিদের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। অকবির দেখা ছাড়িয়ে সেই দৃষ্টি চলে যায় ক্রান্তি অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত। এই কারণেই কবিকে সভ্যতা ক্রান্তদর্শী বলে চেনে।

রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দুই কবির কবিতাতেই হেমন্তের অরুন্তুদ উপাদান চাঁদ। রবীন্দ্রনাথের গান হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী গানটি লক্ষ্য করা যাক-

হেমন্তে কোন্‌ বসন্তেরই বাণী পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥

বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়।

কোন্‌ গোপন কানাকানি পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥

আবেশ লাগে বনে শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে।

ডাকছে থাকি থাকি ঘুমহারা কোন্‌ নাম-না-জানা পাখি।

কার মধুর স্মরণখানি পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥

দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় শুনলে দেখা যাবে, হেমন্তে শব্দটিতে তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়াচ্ছেন, যেমন কুয়াশা এক জায়গায় থম মেরে থাকে। এই নীরব, থম মারা হেমন্তের মৌতাত এক মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে চাঁদের সৌজন্যে। পূর্ণশশীর ছোঁয়ায় শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণ- তীব্র ইরোটিক ইশারা মনে হয়। চাঁদ প্রকৃতিকে পাগলপারা করে দিচ্ছে যেন, পাখিদের ঘুম ছুটে গেছে, গাছে গাছে কথা চালাচালি হচ্ছে। মনে পড়তে পারে এই গানে লেখা কবিতা রচিত হওয়ার ৫১ বছর পর এক বাঙালি কবি, বিনয় মজুমদার, ১৪০০ লাইনে ছ'টি কবিতা লিখছেন, নাম দিচ্ছেন, 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা'। সেখানেই রয়েছে- 

এভাবে সময় যায়, কেন যেন ফুল ফের অবাক হয়েছে

এত বেশি অবাক যে হঠাৎ হাঁ হয়ে যায়, হাঁ করে তাকায়

রবীন্দ্রনাথের গানের শ্বেতকরবীও তো আবেশে হাঁ হয়ে আছে! আর এসবের সাক্ষী কবি কোথায় তখন? এই হেমন্তের চাঁদ তাকে এনে দিচ্ছে স্মৃতি, প্রিয়মুখ। হয়তো সে নেই, হয়তো কেন, সে নেই-ই, কেন না এই গান লেখার চল্লিশ বছর আগে লেখা, 'সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে।' আজ সেই চাঁদের আলো যখন গায়ে এসে পড়ছে, তখন পাল্টা ভেসে আসছে যে চলে গেছে তাঁর স্মৃতি। ভাবলে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথের এই উদযাপনভঙ্গিমার ঠিক উল্টোমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জীবনানন্দ, যাঁর কবিতায় একদিন শান্তির অভাব খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনানন্দ হেমন্তের আবহে মন্বন্তরকে মনে করেন। লেখেন-

এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক
এ-পাড়ার বড়ো মেজো…ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত;
এখন টুঁ শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও;
মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়;
সময়ের হাতে অন্তহীন।

(১৯৪৬-৪৭ কবিতার অংশবিশেষ)

হেমন্ত নবান্নের কাল। ঘরে ঘরে ফসলের সুষমাবিস্তার হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলার গ্রামের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে দুর্ভিক্ষে। ফলে গ্রামে আর কাকপক্ষীটিও আর অবশিষ্ট নেই। মানুষের হাড় খুলি গুণে শেষ করা যাবে না, এমনই অবস্থা। ধান ওঠার সময়, প্রথম ফসল ওঠার সময়, তার শ্রীটুকু ছিঁড়ে ফেললেন জীবনানন্দ। বাংলার গ্রামের এখন-তখন তাঁর বর্ণনায়-

বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন
আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী
হ’তে পেরেছিলো প্রায়; নিভে গেছে সব।

(১৯৪৬-৪৭ কবিতার অংশবিশেষ)

বাংলা সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্রের সমস্ত আধুনিক কুশীলব জীবনানন্দের অন্ধকার আত্মার ধারক, সেই কারণেই তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন 'সাড়ে সাত সের চাল', যেন জীবনানন্দের পটের মতো গ্রামটির নিভে যাওয়াই গদ্যে লেখা সেখানে। চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হো়ড় গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে ছবি এঁকেছেন তার মূল সুরও তো এই নিভে যাওয়া। তালিকায় জুড়ে নেওয়া যাক বাড়ি থেকে পালিয়ে অথবা আকালের সন্ধানে।

হেমন্তসন্ধানে বেরিয়ে এক অন্য জীবনানন্দের সঙ্গেও দেখা হলো। অপ্রকাশিত কবিতায় চোখ বোলাতে বোলাতে খুঁজে পাচ্ছি হেমন্তের জোৎস্নায় নামক কবিতা। তার শুরুয়াত-

মনে হয় হেমন্তের জ্যোৎস্নায়
সাদা তাম্বুর মতো কুয়াশায়
আজও ঢের লোক দূর-দূর প্রান্তরের ক্যাম্পে
নারী মেষ গাভীযূথ লয়ে আদি পিতাদের মতো সন্নিবন্ধ
হয়তো- বা দীর্ঘ দেহ তাহাদের-জটায় ধবল;
এখনও শৈশব প্রাণে
কিংবা আরও শৈশবের সুর ভেসে আসে মাইক্রোফোনে
বালটিক সমুদ্রের তীর থেকে

শরতের শেষে, হেমন্তের শুরুতে কোজাগরী পূর্ণিমা। লক্ষ্মীপুজোর, শ্রী-কে ডাকার এই রাতেই তো আগুন দেখেছে বাংলা। দাঙ্গা বেঁধেছে নোয়াখালিতে। কত মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, স্ত্রী-সন্তান সহ কত অসহায় পিতা ঠাঁই নিয়েছেন ক্যাম্পে। হেমন্তের জ্যোৎস্নায় সেই ক্যাম্প, সেই বিষণ্ণ করুণ ছিন্নমূল প্রাণের লাইনই কি ভেসে ওঠে কবির চোখে? কবির ক্রান্তদর্শী মনটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। আমার মনে পড়ে প্যালেস্টাইন। কী অনাদর, কী অনাদর, মানুষের শব খুঁটে খায় শকুন। সমুদ্রতীর থেকে ভেসে আসে শিশুর ক্রন্দন।  শিশুর হাড় মাংসের উপরেই নতুন সভ্যতার মহাপ্রাণের মিনার গড়ে কেউ। আমরা দ্রুততার সঙ্গে হাঁটি আধুনিকতার দিকে। শিবুকাকুদের ভুলে যেতে চাই, ভুলে যেতে চাই সমস্ত অতিরিক্তকে, আমরা হেঁটে চলি অনবধানে, অবনমনে, অন্ধকারের দিকে। আমরা তো জানি--

হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে

(জীবনানন্দ দাশ রচিত নাবিকী কবিতার প্রথম লাইন)

More Articles