ষোলোকলাম: সুখের স্থির জলে মুঠো-মুঠো পাথর ছুঁড়ে দেয় এই বই

Sholo Column Book Review: বইটি শুরু হয় ভেমুলার চিঠি দিয়ে, লেখক অনুবাদ করেছেন। পাঠককে বিন্দুমাত্র প্রস্তুতিকাল না দিয়ে এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ থেকে বইটি শুরু হয়।

‘ষোলোকলাম’ অনির্বাণ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ। প্রথমটি, ‘মরা আলোর সিম্ফনি’, যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল লেখকের অনেকগুলি ব্যক্তিগত গদ্যের; সঙ্গে ছিল একটি হাড়-কাঁপানো হরর ফিকশন। এই বইয়ে মোট আটটি সাক্ষাৎকার এবং আটটি প্রবন্ধ রয়েছে, যার বিষয়বস্তুর সঙ্গে ‘মরা আলোর সিম্ফনি’-র দূরদূরান্তেরও মিল নেই। ‘মরা আলোর সিম্ফনি’-র প্রতিটি লেখাকে ধরে রেখেছে যেরকম অপূর্ব পেলব গদ্য; ‘ষোলোকলাম’-এর ক্ষেত্রে তার অবকাশ নেই, কারণ এই বই পাঠককে এক অনিবার্য সারসত্যির সামনে দাঁড় করাতে চায়। এই বইয়ের কোনও আবডাল নেই; প্রবন্ধে-সাক্ষাৎকারে যে বিপন্ন বাস্তবের কথা উঠে এসেছে, তার থেকে বাঁচোয়া নেই। ‘মরা আলোর সিম্ফনি’-তে লেখার মায়াবী আলো গদ্যের গুণেই সঞ্চারিত হয়েছিল পাঠকের জানালায়; এখানে লেখার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তি গদ্যের হাত ধরেই আক্রমণ করে পাঠককে। এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর কাজেই অনির্বাণ ভট্টাচার্য সফল— লেখক হিসেবে তাঁর প্রধান মুন্সিয়ানা এ-ই।

বইয়ের মুখবন্ধে সচরাচর লেখক বইটি লেখালেখির কারণ দর্শান। যে উৎস থেকে ফল্গুধারার মতো লেখারা নেমে এল, সেই মূলটিকে চিনিয়ে দেন। বইয়ের ভূমিকা পড়া তাই দরকার। কীরকম মানসিক অবস্থায়, কোন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত মাথায় রেখে লেখক এই লেখাগুলি লিখেছেন, তার একটা ধারণা থাকলে লেখাগুলির অবয়ব চিনতে, অভিমুখ নির্ণয়ে আরও সুবিধে হয়। ‘ষোলোকলাম’ বইয়ের ভূমিকার এক্কেবারে প্রথম বাক্য থেকেই লেখক অনির্বাণ ভট্টাচার্য ঘোষণা করে দিয়েছেন, এই বইয়ের আটটি লেখা এবং আটটি সাক্ষাৎকারের প্রতিটি জন্ম নিয়েছে এক নির্ভেজাল, নিরবচ্ছিন্ন অস্থিতি, নিদারুণ এক ক্রোধ থেকে। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা প্রত্যেকদিন নীচতার নয়া নয়া পাঠ শিখিয়ে যায় যেভাবে, তাতে এই অস্থিরতা, রাগ এতটুকু অপরিচিত, অন্যায্য ঠেকে না। আপনি হালের কথাই ভাবুন। পড়শি দেশে ছাত্রদের ওপর ক্রনিক নির্যাতন চলেছে, এই লেখাটা লিখতে লিখতে খবর ভেসে এল আরও একটা ট্রেন দুর্ঘটনার। তবু, একখানা পোস্ট সাকুল্যে যতক্ষণ ফিডে থাকে, ততক্ষণ খানিক শিউরে ওঠা (ভায়োলেন্সে ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এবং ‘ওদের হচ্ছে ওরা বুঝুক’ মানসিকতায় অবশ্য এই শিহরণেরও নিশ্চয়তা নেই) বাদে মোটের ওপর গড় লোক অবিচলিতই। বাজারের শিল্প-সাহিত্যও তার ছদ্মসুখের বলয় তৈরি করতে অব্যর্থ, নিরলস। এই বইটি সেই পরিস্থিতিতে আমাদের সুখের স্থির জলে মুঠো-মুঠো পাথর ছুঁড়ে দেয়। জল ঘুলিয়ে ওঠে। আমাদের ছদ্মস্বস্তির ঘোরটা সাময়িকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন- ঠোঁটকাটা কী করিয়া দিল Kiss-তিমাত?

বইটি শুরু হয় ভেমুলার চিঠি দিয়ে, লেখক অনুবাদ করেছেন। পাঠককে বিন্দুমাত্র প্রস্তুতিকাল না দিয়ে এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ থেকে বইটি শুরু হয়। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল এই গোটা দেশকে; তার শেষতম বয়ানটি অনুবাদ করে লেখক যখন বই শুরু করছেন, পাঠক তাঁর উদ্দেশ্য, বইটির প্রবন্ধগুলির প্রকৃত লক্ষ্য নিয়ে নিঃসংশয় হয়ে যান— লেখক কল্পনার কাচের প্রাসাদ গড়তে নয়, সেটাকে সক্রোধে ঢিল মেরে ভাঙতে এসেছেন। লেখক যখন এই বইয়ে ইন্টারভিউয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তখনও এই অস্বস্তি থেকে গিয়েছে অন্তর্লীন। অবশ্য, এই বাক্যে একটা ভ্রান্তি হলো, সেটাকে পরেরদিকে শুধরে নেব; আপাতত, একটা উদাহরণ দিই। লেখক-গীতিকার-চলচ্চিত্রনির্মাতা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনির্বাণ, তখন এক আশ্চর্য অনতিপরিচিত সত্য পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়। চন্দ্রিল সোচ্চারে সচেতনভাবে বলেন, চন্দ্রবিন্দু বিশ্বাস করে না, ভবিষ্যতে এই সমাজের জন্য কোনও উত্তরণ বা কোনও সুদিন অপেক্ষা করে আছে। বরং, এই ক্রমপচনশীল সমাজে সকলের সম্মিলিত জাহান্নাম-যাত্রাই ভবিতব্য; চন্দ্রবিন্দু এমন বিলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমজা করার সাহসটুকু রাখে মাত্র। এই বাক্যটি পড়ে ধাক্কা লাগে। মনে হয়, চাঁদের দক্ষিণ-প্রান্তের মতো চন্দ্রবিন্দুর এই দীর্ঘশ্বাসটাও অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। মনে পড়ে ডুবন্ত টাইটানিকের বাজনদারদের কথা। মনে পড়ে বেলা তারের ছবি— তাঁর সুদীর্ঘ সাদা-কালো ফিল্মে মুহূর্তকালের জন্যও উঁকি মারে না আশাবাদ। এই অনিবার্যতার সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় লাগে, মনে হয়, শেষবিকেলের মায়াবী আলো-মোড়া আকাশে সন্তর্পণে কেউ ডুবিয়ে দিল কালো রঙে চোবানো তুলি— আকাশ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পিচ ব্ল্যাকের দিকে। মাঝে নীলের কোনও ট্রানজিশন নেই।

সব ক্ষেত্রে যে এই বিপন্নতা আকস্মিক, তা নয়। এক্ষেত্রে, আগের অনুচ্ছেদের ভুলটি সংশোধন করে নিই। শুধু ইন্টারভিউয়ার বললে এক্ষেত্রে অনির্বাণের প্রয়াসকে খানিক সীমিতই করা হয় বলে আমার মনে হয়। তিনি আদতে সংলাপে গেছেন উত্তরদাতার সঙ্গে; ফলে প্রশ্ন কেবলই উত্তরের পদাঙ্ক অনুসরণ করেনি, প্রশ্ন একটা প্রতর্কের পরিসর তৈরি করেছে। কখনও সহিংস বনাম অহিংস আন্দোলনের দর্শনের যুযুধান তৈরি হয়েছে, কখনও আশা-নিরাশার। যেমন, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে সমনামী অভিনেতা-পরিচালক-নাট্যকারের একটা কথোপকথন রয়েছে, তা সম্পূর্ণই আবর্তিত হয় ‘আমি অন্য কোথাও যাব না এই দেশেতেই থাকব’ গানটিকে কেন্দ্র করে। সেখানে উত্তরদাতার সঙ্গে হালের রাজনৈতিক হকিকত নিয়ে একটা নিরন্তর তর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন প্রশ্নকর্তা, ফলত, নেহাতই ‘গানটি করে কেমন লাগল’, ‘ফ্যাসিবাদ নিয়ে কী বলবেন’ জাতীয় বাজারি ভাসা-ভাসা ফঙ্গবেনে আলোচনায় বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি। রজতকান্ত রায়ের সঙ্গে সুভাষ-নেহরু প্রসঙ্গে দীর্ঘ প্রশ্ন-উত্তর, মত-দ্বিমতের পরিসর তৈরি হয়েছে। মূলধারার মিডিয়া এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইউটিউব চ্যানেলের— যার নাম ‘অল্টারনেট মিডিয়া’ — সৌজন্যে ইন্টারভিউ বলতেই লোকে একবগ্গা বাঁধাধরা প্রশ্নোত্তর বোঝেন, সেই নিগড় ভেঙে বইটি প্রকৃত সাক্ষাৎকার বলতে যা বোঝায়, সেই ভাবনাটিকে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে বলেই মনে করি। সব সাক্ষাৎকার অবশ্য একমুখী নয়, আছে ‘পথের পাঁচালি’-র সুর নিয়ে দেবজ্যোতি মিশ্রের কথাবার্তা; সামগ্রিক ফিল্ম-দর্শন নিয়ে সুধীর মিশ্রর কথাবার্তা; ডিলান নিয়ে শান্তনু মৈত্রের কথাবার্তা। এছাড়াও, পিকে ব্যানার্জির সঙ্গে একটি এবং রোজি লিইউয়েলিন জোনসের একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে এই বইতে।

আরও পড়ুন- ক্ষমতা আর যৌন শোষণের আখ্যান; মহাভারতকে নতুন করে জানতে কেন পড়তেই হবে ‘পাঞ্চালী’

এই বইয়ে ফিরে-ফিরে এসেছে সমকালীন রাজনীতি, বিশেষত প্রবন্ধের সরণি ধরে। হিন্দুত্ববাদী র‌্যাপের মাথাচাড়া দেওয়ার পেছনের সামাজিক প্রেক্ষিতটি খতিয়ে দেখা, বা হিন্দুত্ববাদীদের সনাতনের ধারণায় শুদ্ধতা পরিমাপ করার মতো সরাসরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তো আছেই; এর পাশাপাশি বিকল্প ভিজিল্যান্টিজমের মতো বিষয়কে নেড়েচেড়ে দেখে বৃহত্তর রাজনৈতিক অলিন্দে পৌঁছোনোর প্রয়াসটিও লক্ষণীয় এবং প্রশংসনীয়। তবে, এই বইয়ের দু'টি প্রবন্ধ ‘মরা আলোর সিম্ফনি’-র সঙ্গে এই বইকে জুড়ে রেখেছে সেতু হয়ে। একটি হল, ‘পরমেশ্বরবাবুর ঘরে ফেরার ঘ্রাণ নাকি প্রকৃত যাবজ্জীবন?’ এবং আরেকটি সদ্য মুক্তি পাওয়া বহু-চর্চিত ছবি নিয়ে লেখা ‘মানিকবাবুর মেঘ যেন আদরে ভেসে যাওয়া নৌকো’। যাঁরা ছবিটা দেখবেন, তাঁদের কাছে ছবির অংশ হিসেবেই ভেসে পৌঁছে যেতে পারে এই লেখা। প্রথম বইয়ের সমস্ত লেখার শেষেই যেমন গ্রাস করত এক মনখারাপ, তেমন বিষাদ এই লেখাদু'টির শেষেও পাঠকের পাশে এসে বসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিষণ্ণতা ব্যাপারটা আমাদের নিত্যসঙ্গী। ফুলের গন্ধের মতো, গানের সুরের মতো সে থাকে; আমরা তার উৎসটি চিহ্নিত করতে পারি না সবসময়, কিন্তু এরকম লেখা আমাদের সেই চেনা দুঃখের সামনে দাঁড় করায়। অতএব, ‘ষোলোকলাম’ এবং ‘মরা আলোর সিম্ফনি’-র সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই দু'টি প্রবন্ধ। আর একটি মিল হলো, দু'টি বইয়েরই অনবদ্য প্রচ্ছদ করেছেন অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি আবার পরিচালকও বটে। তাঁর হাত ধরেই বাংলায় এসেছে ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর মতো ছবি। চাপা সাদা রঙে অনেকগুলো এলোমেলো অক্ষর যেন লেখকের ক্রনিক অস্বস্তিরই পরিচায়ক হয়ে ওঠে।

এ-বাদে ‘মরা আলোর সিম্ফনি’-র সঙ্গে ‘ষোলোকলাম’-এর বিশেষ মিল নেই। সচরাচর যে প্রবণতা বাইরে আগুন লাগলে এসির তাপমাত্রা একপর্দা কমাতে বলে, এই ছবি সেই প্রবণতার সামনে আয়না ধরে। যে প্রবণতা সহ-নাগরিকের সমস্যাকে আপন মনে করতে বাধা দেয়, সেই প্রবণতার মুখে কালি ছেটায় এই বই। এখন, আপনি যদি চান বাইরের বাস্তবটি ভুলে গিয়ে বাতানুকূল ঘরে পিৎজা খেতে খেতে ছবি দেখতে, তাতে আপত্তি নেই। বইটি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছে, এসির তাপমাত্রা একটা অঙ্কের পর আর নামবে না। ফুরিয়ে আসবে পিৎজা, শেষ হবে সিনেমাও। তখন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যে অচেনা হলকার সম্মুখীন হবেন, তা সামলানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন তো?

 

বই: ষোলোকলাম
প্রকাশনা: এবং অধ্যায়
মুদ্রিত মূল্য: ২৭৫.০০

More Articles