নিজের উদ্যোগে তৈরি সমাধি বাক্সের উপরেই বিছানা পেতে ঘুমিয়েছেন অশোক ঘোষ

Life of Forward Block Leader Ashok Ghosh : ট্রেনি রিপোর্টারটিকেও স্বাভাবিক সৌজন্যে কাছে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে এক অন্য মাপের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা এনে দিয়েছিল

নিজের সামান্য সঞ্চয়ে তাঁর শেষকৃত্যের খরচটুকুও রেখে গিয়েছিলেন। আর তাঁকে সমাধিস্থ করার জন্য আপন উদ্যোগে তৈরি শব-বাক্সটির উপরেই বিছানা পেতে ঘুমিয়েছেন বছরের পর বছর। মৃত্যু যে অমোঘ সত্য এই অনিবার্য দর্শনকে নিজের চলার পথে পাথেয় করেছিলেন আজকের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিরল প্রজাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতীক, প্রয়াত বামপন্থী নেতা অশোক ঘোষ। বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের কথায়, যারা নিজেদের জীবনচর্চায় উদাহরণ তৈরি করে অনায়াসে বুঝিয়ে দিতে পারতেন আশ্রমিক জীবনযাপন কাকে বলে।

বাংলা কাগজে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার কাজ করছেন এমন নানা প্রজন্মের অংশ একটি বিষয়ে নির্দ্বিধায় একমত হবেন অন্তত ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বটির নাম প্রয়াত অশোক ঘোষ। অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন, সকলের সাথে আন্তরিক ব্যবহার, অমায়িক আচরণ, দলমত নির্বিশেষে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর দলের কনিষ্ঠতম কর্মী থেকে সদ্য খবরের সন্ধানে আসা ট্রেনি রিপোর্টারটিকেও স্বাভাবিক সৌজন্যে কাছে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে এক অন্য মাপের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা এনে দিয়েছিল রাজনীতির সব মহলে। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন এই রাজ্য সম্পাদককে তাই অনায়াসেই শ্রদ্ধার আসনে বসাতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অথবা অধীর চৌধুরী থেকে বিমান বসু, দিলীপ ঘোষরা।

আরও পড়ুন : ৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই

রাজনীতিতে স্বীকৃত কোনও দলের শীর্ষ পদে টানা ৬৫ বছর দায়িত্ব সামলানো অন্তত এদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নজিরবিহীন বিষয়। তথ্য অনুযায়ী খতিয়ে দেখলে অশোকবাবুর দায়িত্ব নেওয়ার শুরু ১৯৪৮ সালে। তখন ফরওয়ার্ড ব্লক বিভাজন হয়ে দুটি আলাদ দল তৈরি হয়েছে। সেই সময় থেকেই একটি অংশের সম্পাদক ছিলেন অশোকবাবু। পাঁচের দশকের শুরুতে হরেন ঘোষের মৃত্যুর পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের রাজ্য সম্পাদক পদে আসেন তিনিই। দুই দল তখন মিলে গিয়েছে। পদের নাম রাজ্য সম্পাদক হলেও ফরওয়ার্ড ব্লকে অশোকবাবুই আসলে ছিলেন শেষ কথা। অশক্ত শরীর নিয়েও কেন দীর্ঘ দিন শীর্ষ পদে ছিলেন, তা নিয়ে দলে মাঝেমধ্যেই কেউ কেউ আপত্তি তুলেছে। কেউ কেউ বলেছেন, এমন আমৃত্যু দলের শীর্ষপদে খাকা যথাযথ নয় মোটেও! কিন্তু ঘটনাটি যে ঐতিহাসিক সে ব্যাপারে সহমত ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কেমন ছিল তাঁর জীবনযাপন? উদাহরণ হিসাবে জানানো যায়, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তাঁর মৃত্যুর পর সেন্ট্রাল এভিনিউয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক রাজ্য দফতরে অশোকবাবুর জন্য নির্দিষ্ট ছোট্ট শোওয়ার ঘরেই পাওয়া যায় একটি শব-বাক্স। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ক্যাসকেট। কিন্ত কে তৈরি করেছিলেন এই বাক্সটি? খোঁজখবরের পর দলীয় সতীর্থরা জানতে পারেন ওই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন স্বয়ং অশোক ঘোষ! কাঠের মিস্ত্রীকে বরাত দিয়ে বাক্স তৈরি করিয়ে রাখা ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়। ছিল একটি চিঠিও। যেখানে ব্যাখ্যা করা ছিল, হিন্দু পরিবারের সন্তান হয়েও কেন তিনি চেয়েছিলেন যেন তাঁর দেহ সুদূর পুরুলিয়ার সুইসা আশ্রমে সমাধিস্থ করা হয়। এতেও শেষ হয়নি! ওই কাঠের বাক্সের ডালা খুলে ফব নেতারা আবিষ্কার করেছিলেন কিছু টাকা রাখা ছিল ভিতরে। অশোকবাবুর দেহ সমাহিত করার পরে প্রথা মেনে শেষকৃত্যের খরচ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য যার প্রয়োজন হবে। সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে যে সামান্য ভাতা দলের কাছ থেকে পেতেন তার থেকেই জমিয়ে এই আগাম এমন ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। নিজের শেষকৃত্যের খরচ মেটানোর ব্যবস্থা নিজেই করে রেখেছিলেন মৃত্যুর অনেক আগে। আর এই প্রসঙ্গ অশোকবাবুর মৃত্যুর পরে জানতে পেরে ফরওয়ার্ড ব্লক তো বটেই অন্য দলের রাজনীতিকরাও সেসময় কপালে হাত ঠেকিয়েছিলেন!

ওই বিষয়ে আরও চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। সমাধি-বাক্সের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি জানিয়েছিলেন ওই বাক্সটি তৈরি হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন নিজের ছোট্ট ঘরটিতে ওই বাক্সের উপর বিছানা পেতেই ঘুমাতেন তাঁদের সকলের প্রিয় অশোকদা। নরেনবাবুর কথায়, নৃত্যু যে অমোঘ আর অনিবার্য এই সত্যটিকেই আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন অশোক ঘোষের মত ব্যক্তিত্ব।

আরও পড়ুন : বারবার সুযোগ পেয়েও ‘ঐতিহাসিক ভুল’, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে অন‍্যভাবে লেখা হত ভারতের ইতিহাস

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন দিল্লি ব্যুরো চিফ, অধুনা ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের কনসালটিং এডিটর জয়ন্ত ঘোষালের মতে, আজকের পরিস্থিতিতে যখন রাজনীতিতে দুর্নীতির খবর আর পাঠক বা শ্রোতার কাছে কোনও বাড়তি আগ্রহ তৈরি করে না তখন অশোক ঘোষের মত মানুষরা এই অন্ধকারেও যেন এক অনাবিল নৈপুন্যে আশার আলো ছড়িয়ে দেন। আলোচনা প্রসঙ্গে জয়ন্তবাবুর বিশ্লেষণ, অমায়িক সৌজন্যের সঙ্গে ঋজু দৃঢতায় আর তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তববোধের মিশেলে দলের সংগঠনে যেমন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছেন ঠিক তেমনই অনিল বিশ্বাস থেকে কমল গুহ আবার বিমান বসু থেকে জ্যোতি বসুর মত নানান মাপের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখেছেন আজীবন। ছয়ের দশকে যুক্তফ্রন্ট এবং ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি ছিলেন অশোকবাবু। দলের সংগঠন দেখেছেন কিন্তু কখনও মন্ত্রী, বিধায়ক বা সাংসদ হওয়ার কথা ভেবেও দেখেননি। জয়ন্তবাবু যে পত্রিকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন সেই বর্তমান পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তের সঙ্গে অশোক ঘোষের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ভোরবেলা প্রাতঃভ্রমণে যেতেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে, দিনের পর দিন সেখানে বসেই গল্প-আড্ডা হত বরুণবাবুর মত আরও অনেকের সঙ্গে।

দীর্ঘদিন ধরে দৃষ্টিশক্তি ছিল না। এই দৃশ্য সাংবাদিকদের চোখেও পড়েছে, টেবিলের উপরে চেকবই একটু তেরছা করে ধরে আছেন দলের এক কর্মী। আর তিনি পেনটা তুলে সই করে দিচ্ছেন। অর্বাচীন কোনও সাংবাদিক এক বার জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর কখনও আশঙ্কা হয় না? তাঁর দৃষ্টিহীনতার সুযোগ নিয়ে যদি কেউ ভুল কিছুতে সই করিয়ে নেয়? স্বাক্ষরকারী অশোক ঘোষের জবাব ছিল, ‘‘আমার দলে কে কী করতে পারে, আমি সব জানি! বিশ্বাসের উপরে চলে এটা।’’ অভূতপূর্ব বিশ্বাস এবং নিয়ন্ত্রণের টানটান সেই পর্ব ২০১৬ সালের ৩ মার্চ অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছানোর পর বামফ্রন্ট হোক বা তৃণমূল, বিজেপি থেকে কংগ্রেস, সব দলের নেতারা এক বাক্যে বলেছিলেন— রাজ্য রাজনীতিতে একটি যুগের অবসান হল।

তথ্যসূত্র - মহীরুহ- অশোক ঘোষ, এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ সংকলন- ফরওয়ার্ড ব্লক, বাংলা কমিটি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ মার্চ, ২০১৬

তথ্যসূত্র - মহীরুহ- অশোক ঘোষ, এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ সংকলন- ফরওয়ার্ড ব্লক, বাংলা কমিটি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ মার্চ, ২০১৬

বিশিষ্ট জনেদের প্রতিক্রিয়া প্রতিবেদকের নেওয়া

More Articles