বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকুতি! বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে লাইফ জ্যাকেটের এই পাহাড়!

Life Jacket Mountain: পৃথিবীর বিস্ময় জাগানো পাহাড়, লাইফ জ্যাকেটের পাহাড়! পাথুরে জমিতে স্তূপ হয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের লাইফজ্যাকেট।

ঘরছাড়া মানুষ কোনদিকে যায়? যেদিকে দু’চোখ যেতে পারে? বাস্তুভিটাহীন মানুষ কী ফেলে আসে? শিকড়? স্মৃতি? লাইফজ্যাকেট? বিপুলা এই পৃথিবীর যতটুকু মোবাইলে ধরা যায়, তার বাইরেও যে অনিশ্চিত যাপন রয়েছে বারেবারে তা সপাটে থাপ্পড় মেরে যায় শিকড়ভোলা, আরামমুখী মানুষের গালে। তাঁকে সুযোগ পেলেই ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় জীবনের দগদগে ঘায়ের সামনে। এমনই এক ঘা পৃথিবীর এই বিস্ময় জাগানো পাহাড়, লাইফ জ্যাকেটের পাহাড়! পাথুরে জমিতে স্তূপ হয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের লাইফজ্যাকেট। দিনে দিনে ঘা বাড়ছে, দিনে দিনে ফুলে উঠছে পাহাড় অথবা কবর। ইউরোপে নিরাপত্তার সন্ধানে যে মানুষরা এই গ্রিক দ্বীপের মধ্য দিয়ে পেরিয়েছেন তাঁদের স্মৃতি হিসেবে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে এই পাহাড়।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) বলছে, লেসবোসের তীরে জমে উঠেছে লাইফ জ্যাকেটের বিশাল ঢিবি, রাবারের ডিঙি। প্রতিদিন এখানে নেমেছেন প্রায় ৩,৪০০ শরণার্থী এবং অভিবাসী। পরণের লাইফ জ্যাকেট পেছনে ফেলে এখান থেকেই তাঁরা ইউরোপে নিরাপত্তার সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন।

আরও পড়ুন- ২০৭১ সাল দেখাবে এই ‘ভবিষ্যতের জাদুঘর’! কী কী আছে এর অন্দরে, জানলে আঁতকে উঠবেন

লেসবসের রাজধানী মাইটিলিনের মেয়র কার্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছিল, কমপক্ষে ৫০০,০০০ লাইফ জ্যাকেট এবং অন্যান্য ভাসমান বিষয় এখানে রয়েছে, প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি করে। কত কত মানুষ ঠিক ইউরোপে যাওয়ার আগে এই লাইফজ্যাকেট ফেলে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা মেলে না।

লাইফ জ্যাকেটগুলি এখন লেসবসের গ্রাম মোলিভোসের কাছে ৪০,০০০ বর্গ মিটারের বেশি এলাকা জুড়ে ৫ মিটার লম্বা স্তূপ তৈরি করেছে। একসময় পর্যটনের জন্য বিখ্যাত ছিল এই দ্বীপটি। এখন শান্তি, আশা এবং একই সঙ্গে হতাশার নাম লেখা স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত হয়েছে এই ছোট্ট দ্বীপ। বাঁচতে চাওয়ার আকুতির তীব্র উজ্জ্বল-কমলা রঙ এখানে ইতিহাসকে অতীত হতে দেয় না। বাসাছাড়া হওয়ার, সর্বস্ব খোয়ানোর গ্লানি মেখে থাকা লাইফ জ্যাকেট এখানে জীবনকে আড়চোখে দেখে মুচকি হাসে।

সিরিয়ার আলেপ্পোর রক্তপাত থেকে পালাতে চেয়েছিলেন বছর পঁচিশের মাইস, সুইডেনে আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিলেন। তুরস্কের একটি উপকূলীয় শহরে পৌঁছে গ্রিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে লাইফ জ্যাকেট খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি। শরণার্থীদের সাগর পেরোতে তখন বাধ্য হয়ে কিনতেই হবে জ্যাকেট, অথচ এই জ্যাকেট প্রাণ বাঁচাবেই বা কীভাবে! মান অত্যন্ত খারাপ, দাম অত্যন্ত বেশি! তবু, উদ্বাস্তুদের বাঁচতে হবে, বাঁচতে গেলে জলের সঙ্গে লড়তে হবে, ডাঙায় লড়তে হবে রাজনীতির সঙ্গে।

আরও পড়ুন- চুলের ওজন এক কেজি, দৈর্ঘ্যে ৭ ফুট! যা দেখতে এই গ্রামে আসেন সারা পৃথিবীর পর্যটক

লাইফ জ্যাকেটের এই কবরস্থানে গেলেই দেখা যাবে প্লাস্টিক এবং ফোমের স্তূপ! কোথাও নাইলন কোথাও বা কাগজ দিয়েই ঠেসে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে জ্যাকেট। মানুষের ওজন বওয়া এই জ্যাকেটের কম্মই নয়। তবু, মনকে আশ্বস্ত করা। UNHCR জানিয়েছে ২০১৫-র শুরু থেকে সমুদ্রে ডুবে কত মানুষ মারা গেছে তা এখনও সঠিক হিসাব কষে বলাই যাচ্ছে না। হাজারে হাজারে সিরীয় উদ্বাস্তু নৌকাডুবির মুখে পড়েছেন, লাশ ভেসে গিয়েছে উপকূলে।

লাইফ জ্যাকেটের এই টিলা পরিবেশের উপর চরম প্রভাব ফেলছে নিঃসন্দেহে। জ্যাকেট পুনর্ব্যবহার করার মতো বন্দোবস্ত এই দ্বীপে নেই। পুনর্ব্যবহারের যোগ্য করার জন্য মূল ভূখণ্ড, মানে গ্রিসে পাঠানোও ব্যয়বহুল। ফলে ‘প্লাস্টিকের সুনামি’র আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ। তবে গ্রিস এবং ইউরোপের নানা জায়গা থেকেই স্বেচ্ছাসেবকরা লেসবসে আসছেন এবং যতটা সম্ভব লাইফ জ্যাকেট আর নৌকার ধ্বংসাবশেষ তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব কাজে লাগিয়েই ব্যাগ এবং তাঁবুর মতো জিনিস তৈরি করার কাজও চলছে। আর কবরের মধ্যেকার গোঙানি? ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার গ্লানি? সে হাওয়ায় মিশে মিশে পাড়ি দিচ্ছে দেশান্তর। তার কোনও বাধা নেই, কোনও পিছুটানও নেই।

More Articles