গুলি খেয়েও বলতেন খচ্চরে লাথি মেরেছে! শ্যাম বাহাদুরের মতো যোদ্ধা আর পায়নি ভারত...

Sam Bahadur: শ্যাম এককালে বলেছিলেন, “যদি কোনও সেনা কখনও বলে থাকে যে সে মরতে ভয় পায় না, তাহলে হয় সে মিথ্যে কথা বলছে অথবা সে গোর্খা”।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে কোনও সৈনিকের নাম সারা দেশজুড়ে এতটা জনপ্রিয় হয়নি যতটা হয়েছে শ্যাম মানেকশর ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র ভারতবাসী নয় বরং সারা বিশ্বই তাঁকে আজীবন মনে রাখবে, আর সবটাই তাঁর বিবিধ কাজে ভূমিকার জন্য। ১৯৭১ সালে ইন্দো–পাক যুদ্ধের আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মানেকশ স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, এই যুদ্ধের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী একেবারেই প্রস্তুত নয়। অথচ ১৯৭১-এর এই যুদ্ধে সমস্ত অসম্ভবকে পেছনে ফেলে রেখে তাঁরই নেতৃত্বে ভারতবর্ষ শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবার প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ইতিহাস তৈরি করেছিল। সেই কারণেই প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর এই দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় ভারতবর্ষে।

১৯৪২ সালে বার্মায় জাপানিদের বিরুদ্ধে সিটাং ব্রিজের যে যুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধে মানেকশকে পরপর নয় বার গুলি করা হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রায় মরণাপন্ন শ্যামকে তাঁর বিশ্বস্ত সিপাহী শের সিং উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসকের কাছে। সেই সময় অস্ট্রেলিয়ান এক সার্জেন এই মানেকশর মৃত্যুর আশঙ্কা দেখে অপারেশন করতে অস্বীকার করলেও হাল ছাড়েননি সহযোদ্ধা ও বন্ধু শের সিং। জ্ঞান ফিরলে চিকিৎসক যখন জানতে চান কী ঘটেছিল, তার উত্তরে শ্যাম মানেকশ জানিয়েছিলেন, “একটি খচ্চর আমাকে লাথি মেরেছে তাই আজ এই অবস্থা”। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তাঁর এমন ধারা উত্তর শুনে বোঝাই যাচ্ছে কতটা সাহসী এবং মজার মানুষ ছিলেন তিনি। উজ্জ্বল এবং রঙিন ব্যক্তিত্বের ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ শ্যাম বাহাদুর নামেও পরিচিত। তার ৪০ বছরের কাছাকাছি কর্মজীবনে মোট পাঁচটি যুদ্ধ দেখেছেন তিনি। যার মধ্যে সব থেকে ভয়ানক ছিল ১৯৭১-এর ইন্দো-পাক যুদ্ধ। যা শুধুমাত্র ভারতকে জিতিয়েই দেয়নি বরং নতুন দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকেও প্রশস্ত করেছিল অনেকটাই।

আরও পড়ুন- ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা

৩ এপ্রিল, ১৯১৪। অমৃতসরের এক চিকিৎসক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শ্যাম মানেকশ। ছোটোবেলা থেকে বরাবরই মেধাবী ছিলেন তিনি। কলেজ এবং স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন নৈনিতালে। ১৫ বছর বয়সেই ডাক্তারি পড়তে তাঁকে লন্ডনে পাঠানোর চেষ্টা করেন তাঁর বাবা। তবে তিনি রাজি হননি। বরং বাবার সঙ্গে দীর্ঘ মতবিরোধের পর তিনি দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি আকাডেমির (আইএমএ) প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেন এবং প্রথমবারেই পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন এই কৃতী ছাত্র। ব্যাস তারপরে আর কখনই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শ্যাম মানেকশই সম্ভবত একমাত্র ব্যাক্তি যিনি ইন্দিরা গান্ধিকে ‘প্রধানমন্ত্রী' বলে সম্বোধন করেছিলেন।

ভারতবর্ষে এখনও পর্যন্ত দু’জন সেনা প্রধান ফিল্ড মার্শালের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। একজন ছিলেন কে এম কারিয়াপ্পা এবং দ্বিতীয়জন শ্যাম মানেকশ। ফিল্ড মার্শাল ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ পদ। একজন ফিল্ড মার্শাল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজের পদে বহাল থাকেন, তিনি কোনও ভাবেই তাঁর দায়িত্ব থেকে অবসর নিতে পারেন না।

জেআরএফ জ্যাকব তাঁর লেখায় শ্যাম মানেকশর বিষয়ে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, এমন দায়িত্ববান নেতা ভারত কেন যে কোনও দেশের ইতিহাসে খুব কমই দেখতে পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র ভারতীর সেনাবাহিনীর সম্মান এবং মর্যাদাই শ্যাম বজায় রাখেননি, প্রয়োজনে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়িয়ে ছিলেন। সততার কারণে প্রায়শই মতের পার্থক্য হয়ে যেত বিভিন্ন আমলাদের সঙ্গে। সিভিল সার্ভেন্ট পিআর চারি জানাচ্ছেন, ১৯৪৭ সালে এমন এক পরিস্থিতি হয়েছিল যখন শ্যাম মানেকশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে সহজেই যোগদান করতে পারতেন। যদি সত্যিই তেমনটা হতো তবে ১৯৭১-এর ইন্দো-পাক যুদ্ধের ইতিহাস অন্য কথা বলত।

আরও পড়ুন- মগজাস্ত্র ক্ষুরধার, ফোনে ফোনে বানচাল করেন আক্রমণ! ভারতের প্রকৃত জেমস বন্ড অজিত ডোভাল

গোর্খা রেজিমেন্টের সঙ্গেও শ্যাম বাহাদুরের সম্পর্ক মন্দ ছিল না। তিনি এককালে বলেছিলেন, “যদি কোনও সেনা কখনও বলে থাকে যে সে মরতে ভয় পায় না, তাহলে হয় সে মিথ্যে কথা বলছে অথবা সে গোর্খা”। গোর্খা সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর এই গভীর মনোভাবের কারণে আজও তাঁর নাম গোর্খা রেজিমেন্টের কাছে খুবই সম্মানের।

অনেকেরই জানা নেই, দেশ ভাগের সময় মানেকশ এবং পাকিস্তানের মহাম্মদ ইয়াহা খান একইসঙ্গে দেশভাগ সংক্রান্ত নানা কাজ করতেন। দেশভাগের পর দুই মিলিটারি অফিসার নিজের দেশে ফিরে গেলেও বন্ধুত্ত কিন্তু একটুও তিক্ত হয়েনি। বরং ইয়াহা মানেকশকে তাঁর লাল মোটর সাইকেলটি ১০০০ টাকার বিনিময়ে দিয়ে দিতে বললে তিনি রাজিও হয়ে যান। অথচ দুঃখের বিষয় সেই টাকা মানেকশকে পাঠানোর আগেই শুরু হয়ে যায় ১৯৭১-এর যুদ্ধ। এই ঘটনা প্রকাশ্যে এলে মানেকশ বলেছিলেন, “ইয়াহা কখনই আমাকে মোটরবাইকের ১০০০ টাকা দেয়নি, কিন্তু আজ ওর দেশের অর্ধেক দিয়ে আমার ঋণ শোধ করেছে”।

নিজের কাজের প্রতি যেমন দায়িত্ববান ছিলেন তেমনই মানবিকতার দিক থেকেও কখনই পিছপা হননি শ্যাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করার পরমুহূর্তেই পাক সেনার ঘাঁটিতে গিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে। এমনকী যে সকল সৈনিকরা মারা গিয়েছেন তাঁদের স্ত্রী এবং পরিবারের সঙ্গে গিয়েও দেখা করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাবার থেকে শুরু করে রাতে শোয়ার জায়গার ঠিকঠাক ব্যবস্থা রয়েছে কিনা নিজে গিয়ে দেখে এসেছিলেন। এই ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন পাক যোদ্ধারাও। তাদের একজন মানেকশকে বলেছিলেন, “আপনার নেতৃত্বে ভারতের কেন জয়ী হয়েছে এবার তা বুঝতে পেরেছি। আসলে আপনি আপনার সহযোদ্ধাদের জন্য ভাবেন। আমাদের নিজেদের সেনা প্রধান এসেও আমাদের জন্য এভাবে খোঁজ নেয়নি যেভাবে আপনি নিয়েছেন।”

২০০৮ সালের ২৭ জুন মৃত্যুর দিন পর্যন্ত নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে গেছন এই যোদ্ধা । তবে ভারতবর্ষ কি সুদূর ভবিষ্যতে এমন আরেকজনকে পাবে? সংশয় অমূলক নয়।

More Articles