ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির বাহুবলী পুরুষ নয়, সকলকে সঙ্গে নিয়ে থাকা নেতা চাই

PM Narendra Modi: গান্ধিবাবার অহিংসার বার্তায় যখন ভাসছিল আসমুদ্র হিমাচল, তখন ছোট্ট একটি ছেলের মনে হতো জাতির পিতা যেন বড় বেশি মেয়েলি।

মা বললেন, মা এসেছিলেন। বালকটি লাফিয়ে ওঠে, কোথায় দিদিমা! মা বুঝিয়ে বলেন, এ মা সে মা নন, সাক্ষাৎ মা কালী। শুধু দেখা দিয়েছিলেন তা-ই না, হাত বাড়িয়ে একখানা জবাফুলও নাকি দিতে চেয়েছিলেন। বালক ভাবে, সামনে বসা গরুটিও বুঝি সেই অলৌকিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। তাই এমন থ হয়ে বসে আছে, জাবর কাটতেও ভুলে গিয়েছে। সেই মুহূর্তেই ‘দিব্যদর্শনের গোরুত্ব’ মালুম হয় তার। বড় হয়ে আত্মজীবনীতে সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখবে সে। বালকের নাম শিবরাম চক্রবর্তী। বইটির নাম ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা।

ইদানীং পদে পদেই অসহায়ভাবে সেই ‘দিব্যদর্শনের গোরুত্ব’ উপলব্ধি করছি আর বলছি ‘‘চাই না।’’ দেবতা নয়, দেবতার নির্দেশে ধরাধামে আসা কোনও পয়গম্বর বা অ্যামিবা নয়, নেহাতই জৈবিক পদ্ধতিতে জন্মানো এক জন রক্তমাংসের মানুষকে দেখতে চাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী যদি দেবতা হন, তাঁর চেলাচামুণ্ডারাও একেক জন একেকটি অবতারে ধরা দিতে চাইবেন। পাড়ায় পাড়ায় উপ-ভগবানেরা তখন পুজো চাইবেন, পুজো বাড়ন্ত হলে মুড়ির বাটি হাতে দাঁত খিঁচোবেন। এমনিতেই দেবতার অভাব নেই দেশে, পুজো-পাঠের চোটে রাস্তায় চলাফেরা করাই দায়, এর উপরে নিত্যনতুন দেবতার জন্ম আর চাই না।

‘পলিটিক্স অব বিশ্বাস’ নামের একটি প্রবন্ধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার লিখেছেন, ভারতীয় রাজনীতির মূল বিষয় এখন বিশ্বাস বা অন্ধভক্তি। এই মডেলে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে একজন সবল এবং ব্যক্তিত্বশালী নেতার মধ্যে। তাঁর ভক্তেরা মনে করবেন, তিনি যা করবেন তাতেই ভালো। ঠিক যেমন বলা হয়, ‘‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য।’’

আরও পড়ুন- কাঁটা উপড়ে ফেলতে দক্ষ মোদি! ক্ষমতায় আসতে কাকে কাকে পথ থেকে সরিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি?

অথচ রাজনীতির সাধারণ মডেলটি তো এমন নয়! নেতা যিনি হবেন তাঁকে সকলের স্বার্থ দেখে কাজ করতে হবে, কতখানি প্রত্যাশা পূরণ করলেন তার হিসেব বুঝে নেবে মানুষ, মানুষের কাছেই তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। সাধারণ মডেল থেকে এ দেশে এমন বেয়াড়া বিচ্যুতি সম্ভব হল কীভাবে? এর দু’টি কারণ আলোচনা করেছেন গবেষকেরা। প্রথম, নেতার উপরে এই বিশ্বাস শুধুমাত্র ব্যক্তি নেতাটির উপরে বিশ্বাস নয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ মনে করেন, বাহুবলী এই নেতা আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের শক্তি এবং ঐক্যের প্রতীক। একচ্ছত্র ক্ষমতা পেলে হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে তিনিই এগিয়ে নিয়ে যাবেন দেশকে।

এই বিশ্বাসের অনেকখানিই কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত নয়, নির্মিত। খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল দখল করে, হোয়াটস্যাপ আর ফেসবুকে সমুদ্রের মতো মেসেজ আর ছবি পাঠিয়ে অনেক দিন ধরে একটু একটু করে মগজধোলাই শুরু হয়। হঠাৎ হয়তো দেখলেন আপনার পেনশনভোগী, ভেতো, সুখী মেজকাকাটি হনুমান চালিশা পড়তে শুরু করেছেন। সকাল বিকেল ফোনে বার্তা পাঠাচ্ছেন শক হুন দল, পাঠান-মোগল সবাই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে ভারতের কাছ থেকে জগতের শ্রেষ্ঠ আসনটি ছিনিয়ে নিতে। উল্টো কথা মেজকাকার কানেই ঢুকবে না, শেষমেশ তাঁকে ব্লক করে ভয়ে ভয়ে থাকবেন, ফ্যামিলি গ্রুপের কোন সদস্যটি এর পরে যন্তরমন্তর ঘরে ঢুকতে চলেছেন।

হাজার তথ্য দিয়ে দেখান, বেকারত্ব, দারিদ্র, অপুষ্টির নিরিখে দেশের অবস্থান কী, দেখবেন চোরা না শুনে অর্থনীতি-রাজনীতির কাহিনি। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সর্বনাশ হবে বলে গলা ফাটানো গালগোটিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মতোই এই মেজকাকারাও ল্যাজেগোবরে হবেন যদি জানতে চান ঠিক কী সর্বনাশ হবে কংগ্রেসের হাতে। প্রতাপ ভানু মেহতা লিখেছেন, এই ধরনের রাজনীতির চরিত্রই এমন যে, সরকার আসলে কী করেছে তা জানার আগ্রহটাই আর থাকে না। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে এক ইস্যু থেকে অন্য ইস্যুতে সুচারুভাবে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তৈরি করা হয় নিত্য নতুন শত্রু।

গত দশ বছরে মোদি কী কী প্রত্যাশা পূরণ করলেন? তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের যে ধরন প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে তাঁর কাছে প্রত্যাশা করার পরিসরই বা কতটুকু ছিল! তা সত্ত্বেও যাঁরা তাঁর উপরে আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরা আসলে প্রত্যাশা নামক জিনিসটিই হারিয়ে ফেলেছেন। আখ্যান নির্মাণের অপূর্ব কৌশল আয়ত্ত করে যিনি দেশের মানুষকে হাওয়ার বেলুনে চড়িয়ে শিখিয়ে দিয়েছেন, নিজেরাই নিজেদের গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দেওয়া যায়, ‘গর্ভ্ সে’ বলতে হয়, ‘আমরাই বিশ্বগুরু’, তাঁর কি আর কোনওরকম প্রত্যাশা পূরণের দায় থাকে?

গান্ধি চাইতেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ‘স্থায়ী আত্মিক ঐক্য’। সুধীর কাকরের মতে, সে স্বপ্ন আজকের ভারতে একরকম অপূরণীয় হয়ে উঠেছে। এখন দু'টি সম্প্রদায় একসঙ্গে থাকার মতো একটি যৌথ জনপরিসর তৈরি করতে পারাই যেন যথেষ্ট। ব্যক্তিগত পরিসরে একে অপরের প্রতি যা থাকবে তা হয়তো ‘নিরীহ ঔদাস্য’ বা ‘benign indifference’। এমন প্রধানমন্ত্রী চাই যিনি সেই জনপরিসর নির্মাণের ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করার সদিচ্ছা এবং সৎ সাহস দেখাবেন।

আরও পড়ুন- যোগীর শাসন কি তালিবানি শাসনের চেয়ে ভালো? উত্তরপ্রদেশে বেঁচে থাকার শর্ত কী কী?

সেই সংবেদনশীলতা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি মাপের ছাতির বড়াই করা বাহুবলী পুরুষের কাছে আশা করি না। ইতিহাসবিদ এবং সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বিশ্বাস করে, অহিংসার পথ সাধ করে বেছে নেয় এক মাত্র দুর্বলরাই। হিন্দুধর্মের কেন্দ্রে রয়েছে অহিংসা, এই অভিনব ধারণাটিকে প্রচার করেন গান্ধি। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি সর্বোচ্চ আসনটি দিত পুরুষত্বকে, তার নীচে নারীত্ব এবং সব শেষে ক্লীবত্ব। পুরুষের মধ্যে নারীত্বের প্রকাশ ছিল চরম অগৌরবের। নারীত্বকে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়ে এই ছকটিকে সম্পূর্ণ উল্টে দিলেন গান্ধি। তাঁর মত, ক্ষমতা এবং প্রতিবাদের সঙ্গে পুরুষত্বের চেয়ে নারীত্বের যোগ নিবিড়তর। নারীত্বের এই মডেলটির ভিত্তি অবশ্যই মাতৃত্বের ধারণা। সাহসের প্রচলিত সংজ্ঞাটিকেও উল্টে দেন গান্ধি। সত্যিকারের পুরুষ সে-ই, যে কাপুরুষত্ব ত্যাগ করে নিজের ভিতরের নারীত্বকে স্বীকার করে নিতে পারে। প্রতিরোধ এবং সাহসের সঙ্গে নারীত্ব এবং মাতৃত্বের কোনও বিরোধ নেই এবং নির্ভীকতার অর্থ উগ্রতা নয় — একথা বলে গান্ধি হিন্দুধর্মের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাইলেন অহিংসার ধারণাটিকে।

১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য মেন হু কিল্‌ড গান্ধি’ বইতে মনোহর মালগাঁওকর লিখেছেন, গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে, গান্ধিবাবার অহিংসার বার্তায় যখন ভাসছিল আসমুদ্র হিমাচল, তখন ছোট্ট একটি ছেলের মনে হতো জাতির পিতা যেন বড় বেশি মেয়েলি। সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে সওয়াল চালিয়ে যাওয়া হিন্দুত্ববাদী নেতা বীর সভারকরকেই বরং মনে হতো আদর্শ পুরুষ। পুত্রসন্তানেরা বাঁচে না, তাই নাকে নথ পরিয়ে মা-বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন নাথুরাম— নাথুরাম বিনায়ক গডসে। মা-বাবা বিশ্বাস করতেন, তার উপরে কুলদেবীর ভর হয়, দেবীর কাছে কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে, তার মাধ্যমেই উত্তর মেলে।

ভগবান, ভগবানের দূত বা বাহুবলী পুরুষ, কাউকেই চাই না প্রধানমন্ত্রীর আসনে। জৈবিক পদ্ধতিতে জন্মানো, রক্তমাংসের এক জন মানুষকে চাই, ছাতির মাপ নিয়ে যাঁর পুরুষালি অহঙ্কার থাকবে না। তিনি কতখানি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেন, সেই হিসেবনিকেশ করবে মানুষ, না পারলে জবাবদিহি চাইবে। সবচেয়ে বড় কথা, সকলের একসঙ্গে বসবাস করার মতো একটি সভ্য জনপরিসর পুনর্নিমাণ করার সদিচ্ছা এবং সৎ সাহস থাকবে যাঁর। ‘পাপ্পু’ বলে ডেকে যাঁর পুরুষকারের অভাব নিয়ে হরবখত ঠাট্টাতামাশা করেন মোদি, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই সমস্ত লক্ষণগুলি তাঁর মধ্যেই দেখতেই পাচ্ছি।

More Articles