অধীরের মন্তব্যই ভোট-বাজারে অস্ত্র মোদির! কংগ্রেস-অধীর দ্বৈরথের ফায়দা তুলতে পারবে বিজেপি?

Adhir Chowdhury: লোকসভা ভোটের আগেও দলের সঙ্গে মতানৈক্য বারবার চওড়া হয়েছে অধীর রঞ্জনের সঙ্গে কংগ্রেসের। তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে কিছুতেই একমত হতে পারেননি অধীর।

পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের কার্যত একা কুম্ভ অধীর রঞ্জন চৌধুরী। প্রায় পাঁচ দশক ধরে বহরমপুর একা রক্ষা করে গিয়েছেন অধীর। গোটা রাজ্যে যখন সবুজ ঝড়, সে সময়েও বহরমপুরের রাশ কখনও হাত থেকে বেরোয়নি তাঁর। নিজের যুক্তিতে, নিজের রাজনৈতিক বোধে সবসময়ে অনড় থাকতে দেখা গিয়েছে বর্ষিয়ান এই রাজনীতিককে। কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্বর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে মতানৈক্য হয়েছে তাঁর। লোকসভা ভোটের আগেও দলের সঙ্গে মতানৈক্য বারবার চওড়া হয়েছে অধীর রঞ্জনের সঙ্গে কংগ্রেসের। তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে কিছুতেই একমত হতে পারেননি অধীর। সম্প্রতি সেই নিয়ে ফের দলের সঙ্গে ব্যবধান বাড়ে তাঁর। আর ভোটের বাজারে সেই সুযোগকে ব্যবহার করেই সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতে চাইছে বিজেপি।

দিন কয়েক আগেই মোদি একটি জনসভায় বলেছিলেন, আদানি-অম্বানির মতো শিল্পপতিদের থেকে টাকা নিয়ে তাঁদের আক্রমণ করা বন্ধ করে দিয়েছে রাহুল গান্ধিরা। মোদির সেই উবাচ ঘিরে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। রাহুল গান্ধি পাল্টা আক্রমণ করে আদানিদের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি তদন্তেরও দাবি জানিয়ে বসেন। একদা মোদি-ঘনিষ্ঠ আদানি-অম্বানিদের সঙ্গে কেন কংগ্রেসের যোগ খুঁজতে চাইছে বিজেপি, তা নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়। এরই মধ্যে সামনে এসেছে অধীর চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার। যেখানে প্রশ্নকর্তা অধীরকে বলেন, অধীররা তো সাংসদে আদানি-অম্বানিকে জোরদার আক্রমণ করেন। তার উত্তরে মজা করেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বলে বসেন, "তিনি বিপিএল, আদানি-অম্বানির থেকে টাকা পেলে আক্রমণ করা বন্ধ করে দেবেন।" কটাক্ষের সুরে তিনি এ-ও বলেন, "আগে তো পাঠাক, তার পর কী হবে বিচার করা যাবে।"

আরও পড়ুন: অধীরের লড়াইয়ে জল ঢালছে কংগ্রেস হাইকমান্ডই

আর এর পরেই অধীরবাবুর সেই বক্তব্যকে নিয়ে আসরে নেমে পড়েছে গেরুয়া শিবির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দাবি, "অধীর চৌধুরী তো বরাবরই নিজের তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মন্তব্যের জন্য চর্চায় থাকেন। তবে এবার আমার পর্যবেক্ষণ একেবারে সঠিক। তিনি আমার কথায় কার্যত সিলমোহর বসিয়েছেন। কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর রঞ্জয় চৌধুরী মেনে নিলেন টেম্পো ভর্তি করে টাকা এলে তাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যায় না।"

আর এর পরেই ওয়াকিবহাল মহলের কেউ কেউ দাবি করেছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে অধীরের। দুদিন আগেই অধীরকে ভালোই বকাঝকা করেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে। লোকসভা ভোটের প্রচার পর্বে মমতাকে পদে পদে আক্রমণ শানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। বহরমপুরে ভোটের প্রচারে গিয়ে অভিষেকও সরাসরি নিশানা শানিয়েছেন অধীরকে। বাংলায় ইন্ডিয়া জোটের সমীকরণ কাজ না করার জন্য দায়ী করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকেই। গত শনিবার অধীরকে কড়া বার্তা দিয়েছিল কংগ্রেসের দিল্লি নেতৃত্ব। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোটের সঙ্গে আছেন, সেটা স্পষ্ট। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অধীর নন, দলের হাইকমান্ডই শেষ কথা। কেউ সেটা মানতে না পারলে, তিনি বেরিয়ে যেতে পারেন।

খাড়্গের বক্তব্যের পাল্টা দেন অধীরও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সাফ জানিয়ে দেন, ‘কংগ্রেসকে কেউ খতম করবে, আমি তাঁকে খাতির করব, তা হতে পারে না। এটা পশ্চিমবঙ্গে আমার পার্টিকে রক্ষা করার জন্য লড়াই। এই লড়াই আমি কোনওভাবে থামাতে পারি না।’ তারপর থেকেই প্রদেশ কংগ্রেসের অন্দরে ক্ষোভের ছবি সামনে এসেছিল। রবিবার দেখা গেল প্রদেশ কংগ্রেস অফিসের বাইরে মল্লিকার্জুন খাড়গের একাধিক ছবিতে কালি লাগানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার উপর লিখে দেওয়া হয়েছে 'তৃণমূলের দালাল'। সে ঘটনার অবশ্য কড়া নিন্দা করেন অধীর। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এই ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার। সেই মতো থানায় গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। পাশাপাশি ওই হোর্ডিংগুলি থেকে কালি মুছে দেওয়ার কাজ চলছে। কিছু হোর্ডিং খুলে ফেলা হচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের কথায়, দলের মধ্যে এমন মনোমালিন্য থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে কেউ বা কারা জলঘোলা করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ। তাদের দাবি, কংগ্রেসের মধ্য়ে কেউ এই ঘটনা ঘটায়নি, বাইরের কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মী রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য এই কাজ করতে পারে।

তার পরেই অবশ্য সুর নরম করেন কংগ্রেস সভাপতি খাড়্গে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীকে কংগ্রেসের ‘লড়াকু নেতা’ বলে সম্বোধন করে তিনি জানান, “আমি কোনও ব্যক্তির বিষয়ে বলতে চাই না। তিনিও আমাদের লড়াকু নেতা। কেউ কেউ বিষয়টি রঙ চড়িয়ে বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা হবে না। কংগ্রেস মজবুত দল। এখানে আমরা একে অন্যকে বুঝি। এখানে সবসময়ই হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে জোটের বিষয়ে। সেই মতোই আমরা চলে আসছি।”

তবে এই যে দলের সঙ্গে বেড়ে চলা দূরত্ব, তার প্রভাব কি পরবর্তীকালে পড়তে চলেছে অধীর চৌধুরীর রাজনীতির সিদ্ধান্তে। বহরমপুরে এবার তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল দাঁড় করিয়েছিল রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে। শুধুমাত্র ক্রিকেটারের জনপ্রিয়তা নিয়ে বহরমপুরের মতো কঠিন কেন্দ্র থেকে সত্যিই কি জয় ছিনিয়ে আনতে পারবেন পাঠান? এদিকে বহরমপুরের পঁচিশ বছরের সাংসদ অধীর। সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা কার্যত আকাশচুম্বি। নিজের এলাকা নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী তিনি, তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, বহরমপুরে যদি তৃণমূল জিতে যায়, তাহলে রাজনীতি থেকেই অবসর নেবেন অধীর।

 

অধীর চৌধুরী বরাবরই জেদি। একদা বামেদের বিরুদ্ধে দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। পরে তৃণমূল জমানাতেও একরোখা। বাংলায় তৃণমূল সরকার গঠনের পর প্রথম লোকসভা ভোটে বহরমপুরে সাড়ে তিন লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন তিনি। সর্বভারতীয় স্তরে সেই ভোটে কংগ্রেসের খুবই করুণদশা ছিল। কংগ্রেসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে জিতেছিলেন অধীর। বহরমপুর লোকসভা আসনে অধীর চৌধুরীকে পরাস্ত করতে এর পরের ভোটে মমতা দায়িত্ব দেন শুভেন্দুকে। শুভেন্দু মুর্শিদাবাদের দায়িত্ব নিয়েই সেখানে কংগ্রেসকে ভাঙাতে নেমে পড়েন। কান্দির তৎকালীন বিধায়ক তথা একদা অধীরের অনুগামী বলে পরিচিত অপূর্ব সরকার তথা ডেভিডকে তৃণমূলে সামিল করান শুভেন্দু। তাঁর পরামর্শেই মমতা উনিশের ভোটে বহরমপুরে ডেভিডকে প্রার্থী করেন। ভোটের দিন ডেভিড বাহিনীর বিরুদ্ধে বিস্তর ভোট লুঠের অভিযোগ উঠেছিল। আর দেখা যায়, বহরমপুরের বুথে বুথে ছুটে বেড়াচ্ছেন অধীর। বিকেল ৫টায় ভোট শেষ হতেই তিনি জানিয়ে দেন, জিতে যাব, এখন এই মুহূর্তেই বলে রাখলাম। শুভেন্দুও দলের মধ্যে দাবি করেছিলেন, তৃণমূল জিতে যাবে। দেখা যায়, শেষ হাসি হাসেন অধীরই। এবারেও কি সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে।

আরও পড়ুন: ২৫ বছরের সাংসদ! এবারও ম্যাজিক ঘটাতে পারবেন বহরমপুরের ‘রবিনহুড’ অধীর?

এদিকে, দলের সঙ্গে অধীরের মতানৈক্য যখন তুঙ্গে, এমনকী অধীরের প্রচারে তেমন করে দেখা যায়নি দলের শীর্ষনেতৃত্বকেও, সে সময়ে অধীরের পাশে থেকে সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করছে বিজেপি। বিজেপির রাজ্যসভাপতি সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রায় সকলেই হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির দরজা তাঁর জন্য খোলা। তবে বাংলা কংগ্রেসের একা কুম্ভকে কি এত সহজে টলানো যাবে নিজের জায়গা থেকে। দলের সঙ্গে ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব কি ক্রমশ বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যেতে চলেছে বাংলা কংগ্রেস ও অধীর চৌধুরীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে? বহরমপুরে যদি শিকে না-ও ছেড়ে, তাহলে কি বানপ্রস্থের পথই বেশি সহজ হতে চলেছে অধীর চৌধুরীর জন্য? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মিলবে ৪ জুনের পরেই।

More Articles