ধৈর্যই ধর্ম! বিভাজন নয়, ভালোবাসার কথা বলেছেন বাংলার রাম

Ram Thakur : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার দুঃখী বাংলার মানুষের মাঝখানে ধর্মপ্রচার করতে এসে তিনি তুলে ধরলেন বাংলার এক লোকপ্রিয় পার্বণ সত্যপীর সত্যনারায়ণ পুজোকে।

দেহ মনের সুদূর পারে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছেন। নিজেকেই যেন ক্রমাগত বলছেন অকর্তা হও, অকর্তা হও। সমগ্রের কাছে সমর্পিত তিনি। সমগ্রের মুক্তির ডাকনামও যে ভালোবাসা, সেই প্রেম বোধে আচ্ছন্ন তাঁর মন। এই বোধে নিজেকে, নিজের অর্জনকেও বিলীন করতে চান তিনি। এই তাঁর প্রেম! যে প্রেমটুকু নিয়ে তিনি এসেছেন বিলিয়ে দিতে।

তখনও তিনি লিখে ওঠেননি সেই অমোঘ পংক্তি "তোমার সেবাতে হয় হৃদয়ের গ্রন্থিক্ষয়, তোমা বিনা কিছু নাহি জানে"। তখনও তো তিনি স্রেফ রান্নার ঠাকুর। ধনী ওভারসিয়ারের বাড়ি ছেড়ে এসেছেন আরেক শহরে। সরকারি ইমারত নির্মাণ হবে। উচ্চপদস্থ আমলা ইঞ্জিনিয়াররা এসেছেন। তিনিও এসেছেন পাচক ঠাকুরের কাজে। আরেকটু বেশি মাইনে, যাতে মা-কে পাঠাতে পারেন। সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর বড় শহরে আসা। বড় শহরে তখন সাজো সাজো রব। কত আয়োজন! বাবুদের আমোদ আহ্লাদের সুবাদেই শহরে এসেছে ফুর্তি-মেয়ের দল, বারবনিতারা।

রান্নার কাজ শেষে তিনি দেখেন, সেই সব মেয়েরা বেহেড মাতাল হয়ে ঘোরে, কেউ বমি করে। নখ দাঁতের নিগ্রহের শিকার হয়ে ফিরে আসে অন্ধকারে। ওদের যন্ত্রণার ভাগ নিতে কেউ আসে না। পাচক ঠাকুর এগিয়ে যান। অন্ধকার যত গাঢ় হয়, পতিতার দল দেখে এক শীর্ণকায় মানুষ তাদের মাথায় হাত রাখে, জল ঢেলে দেয় পরম স্নেহে। সেবা করে, শুশ্রূষা করে। তারা ভাবে, কে এই মানুষ যার স্পর্শে পিতার উষ্ণতা? এ কে, যে সমাজচ্যুতদের আশ্রয় দিতে দ্বিধা করেন না, এমনই তাঁর প্রেম! যে প্রেম তুলনীয় যিশু খ্রিস্টের সঙ্গে। ড্রনের গসপেলে বর্ণিত যিশুর সেই কাহিনি। পতিতা মেরি ম্যকদালেনকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে নগরের অধিবাসীরা। অস্পৃশ্য এই বেশ্যা কেন নগরের বাজারে এসেছে? আক্রোশে পাথর ছুঁড়ছে তারা। দীনের ত্রাতা যিশু যাছেন সেই বাজারের পাশ দিয়েই। সেদিন পাথরের হাত থেকে, অমানবিকতার হাত থেকে, পশুত্বের হাত থেকে ম্যকদালেনকে বাঁচান যিশু। পরে বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে যিশুর প্রধান শিষ্যদের একজন হয়ে উঠেছিলেন মেরি। আর যুগ-কাল-ইতিহাস পেরিয়ে মানুষের প্রতি মানবপ্রেমের অক্ষয় বন্ধন এভাবেই এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধেছিল চট্টগ্রাম আর জেরুজালেমকে, যিশু আর রামঠাকুরকে। দীনের সেবা, আর্তের সেবায় যে ধর্মবোধ লুকিয়ে থাকে সেই বোধই যুগে যুগে যিশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ, চৈতন্য, কবীর হয়ে রামঠাকুরে এসে মিশেছে। দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে মানবমুক্তির, মানবপ্রেমের সেই সনাতন ধর্ম বোধ! এই বোধই রাম ঠাকুরের হৃদয়বৃত্তি, উপাসনা।

আরও পড়ুন- শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু- রহস্য আজও বহমানঃ ১

তিনি একই সঙ্গে বাংলার সহজিয়া বৈষ্ণবদের উত্তরসূরি, আবার পাশাপাশি প্রাচীন বাংলা তথা ভারতের ধর্ম সংস্কৃতির তিনি প্রতীক স্বরূপ। আবার একইসঙ্গে সমাজ যখন ধর্মীয় আধিপত্যবাদের শিকার, দু'ভাগে ভাগ হয়ে মানবতা জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজকে বিভাজনের রাস্তায় নিয়ে যায় যে ধর্মান্ধতা, সেদিন রামঠাকুর পাশে সরিয়ে রাখেন কৃষ্ণনাম, যোগের সম্ভ্রান্ত পরম্পরা, সাংখ্য দর্শনের গভীরতা। মানববন্ধনে আখরে ধরেন বাংলার এক সমন্বয়বাদী লোকাচারকে। হয়ে ওঠেন সত্য নারায়ণ। বন্দনা গান রচনা করেন সত্যপীরের। দেশ ভাগের মুহুর্মুহু সময়ে বলে ওঠেন, "হরি বলো পীরের পিরিতে"।
দেশভাগ আটকে থাকে না, তাঁর আশ্রিত শিষ্যরা নিরন্তর সংকটে পড়তে থাকেন। রাজনীতি জেতে, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য দখলে মরিয়া ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় পরিচয়ের জিগির তোলে, চক্রান্তের ক্রুরহাস্য জেতে। কিছুই ঠেকে থাকে না, তবুও শুধু জেগে থাকে এক মহা মানুষের মরিয়া প্রয়াস, হিন্দু আর মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে রাখতে এক ধর্মগুরুর অমলিন মানবিক প্রচেষ্টা।

শুধু তো হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব নয়, দেশভাগের বহু আগের থেকেই পদ্মাপারের হিন্দু সমাজে তখন ছেয়ে ছিল অস্পৃশ্যতার অভিশাপ। উচ্চবর্ণরা নিম্নবর্ণের ছোঁয়া খায় না, বাড়িতে পা রাখে না। রামঠাকুর নীরব প্রতিবাদের মানুষ। ছোঁয়াছুঁয়ির প্রাচীর ভেঙে তিনি হাজির হন নিম্নবর্ণের ঘরে। ভেঙে দিতে চান সামাজিক ব্যাধি। অনেকটা ভেঙে দিতেও পারেন। যে কৃষ্ণনামে প্রেম বিলিয়েছেন চৈতন্য সেই কৃষ্ণনামকেই মানববন্ধনের হাতিয়ার করেছেন যোগী রামঠাকুর। যোগের, দর্শনের গাম্ভীর্য নয় প্রাঞ্জল কৃষ্ণনামকে আখরে ধরেন বর্ণ-বর্গ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজকে এক সুতোয় বাঁধতে। এই কাজে রামঠাকুর চৈতন্য, নিত্যানন্দ, বীরভদ্রর উত্তরসূরি। তাঁর কাজ ধর্মের নামে এক ভারী বোঝা মানুষকে চাপানো নয়। বরং সহজের আশ্রয় নেওয়া। যাঁর মূল লক্ষ্য বিভাজন নয়, হাতে হাত মেলানো। বিভেদ নয়, প্রেম-মৈত্রী-সহাবস্থানের মহান শিক্ষাকে জাগিয়ে তোলা। এখানেই রামঠাকুর আর ধর্মগুরু থাকেন না, সহজেই হয়ে ওঠেন মানবপ্রেমের প্রতীক। আর্তের ত্রাতা এক মহাপুরুষ যিনি নিজে অবশ্য ভক্তের আপনজন হিসেবে থাকতে চান, গুরু হিসেবে না। আশ্রম প্রতিষ্ঠায় যাঁর গভীর অনীহা, গুরুগিরিতে যাঁর তীব্র আপত্তি। যিনি প্রতিষ্ঠান হতে চান না, ভক্তের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেরিয়ে তাদের সংসারের এক সদস্য হয়ে প্রেম বিলাতে চান। এই আত্মনির্মাণরহিত, হৃদয়ের গ্রন্থিক্ষয়ই রাম ঠাকুরের ধর্ম। আমি-র আমিচ্যুত হওয়া, সকলের মাঝে আত্মসত্ত্বার বিসর্জন- একথাই রামঠাকুর তাঁর সারাজীবন ধরে তুলে ধরেছেন। তাই এই হৃদয়ের গ্রন্থিক্ষয়, এই ইগো বিসর্জন, এই অকর্তা হওয়ার শিক্ষা নিজের জীবনেই প্রয়োগ করেছেন তিনি। যে দেশে গুরুগিরি ধর্মীয় আধিপত্যের রাস্তা প্রশস্ত করে, সে দেশে রামঠাকুর এক ব্যতিক্রম, এক দৃষ্টান্তও বটে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক কথায় তিনি অনন্য।

ধর্ম অভিজ্ঞানে রামঠাকুরের মধ্যে মিশে রয়েছে বেদ ব্রাত্য বাংলার প্রাচীন ধর্ম সংস্কৃতি। নাথ যোগীদের প্রভাবও আছে, আবার প্রাঞ্জল সহজিয়াও। এভাবেই রামঠাকুরকে খুঁজতে বেরিয়ে এক বিরাট ধর্ম সংস্কৃতির চালচিত্রের সামনে এসে দাঁড়াব আমরা।

বেদের যুগেরও আগে, আর্য আগমনেরও আগে প্রাচীন ভারতে যোগসাধনা ছিল। মহেঞ্জোদারোর সেই যোগীর মূর্তিই এই সাক্ষ্য বহন করে। সেই অনার্য ভারতে ব্যবসা, নগর সভ্যতা, কারিগরি উৎকর্ষের পাশেই ছিল অতি সূক্ষ্ম দর্শনচর্চা। ঐতিহাসিক অধ্যাপক জিমার এহেন সাংখ্য দর্শনকে প্রাগবৈদিক অনার্য চিন্তার নির্যাস বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। সাংখ্য দর্শনের বহুপুরুষবাদ বা সৎকার্যবাদের মতো জটিল দার্শনিক ব্যাখ্যার পাশেই এই মতের প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আশ্রয় ছিল যোগ। প্রায়োগিক যোগ আর সাংখ্যর দার্শনিক ব্যাখ্যা মিলে সাধনার চার স্তরের ব্যাখ্যা করা হলো। সমাধি, সাধন, বিভূতি ও কৈবল্য। সুখ, দুঃখ সকল অনুভূতির অতীত এই কৈবল্য স্তরের ভাবনা বৌদ্ধধর্মের নির্বাণ তত্ত্বের ভাবনার কাছাকাছি। শ্রীমদ্ভবদ্গীতা, মহাভারতসহ প্রাচীন গ্রন্থে সাংখ্য দর্শনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো আছে। এদেশে হিন্দুধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অন্যতম উদ্গাতা আদি শঙ্করাচার্য গভীর শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন প্রাচীনতম এই সাংখ্য দর্শন ও যোগ সাধনা নিয়ে। বেদ বৃত্তের বাইরে এই সাধনধারার অন্যতম স্রষ্টা কপিল মুনি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই সাংখ্য দর্শনের গভীর প্রভাব দেখেছেন।

এত কথার অবতারণা শুধু একজন ধর্ম প্রচারকের সাধন মার্গের সুলুকসন্ধান পেতে। তিনিই ভারতের পাঁচ হাজার বছরের এক অতি প্রাচীন সাধনধারার উত্তরাধিকার বহন করে কৈবল্য তত্ত্বের প্রতিভূ কৈবল্যনাথ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। হিমালয়ের নিষিদ্ধ ভূমি জ্ঞানগঞ্জের এই যোগী নিজেকে অপ্রকট রেখেছেন বরাবর। ব্যক্তি জীবনে এক ধনী ওভারসিয়ারের বাড়ির রাঁধুনি হিসেবে কাজ করেছেন। নিজের সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলতেন না। তবু পুষ্প যেমন না চাইলেও গন্ধ ছড়ায় তেমনই তাঁর জীবন সাধনার টানে মুগ্ধ হয়েছেন তার ভক্তকুল, কবি নবীনচন্দ্র সেন তার মধ্যে অন্যতম। তবে কৈবল্যনাথই তাঁর একমাত্র প্রকাশ নয়।

ধর্মীয় হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার দুঃখী বাংলার মানুষের মাঝখানে ধর্মপ্রচার করতে এসে তিনি তুলে ধরলেন বাংলার এক লোকপ্রিয় পার্বণ সত্যপীর সত্যনারায়ণ পুজোকে। যে পুজো হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই হয়। বাংলার নবাব হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় চালু হওয়া প্রায় সাত- আটশো বছরের পুরনো এক হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়বাদী লোকাচারকেই আখরে ধরলেন রামঠাকুর। ১৯৪২ সালে কলকাতায় এক ভক্তের বাড়িতে বসে বললেন, "সত্যনারায়ণ পুজোই এই সময়ের দাবি"। কোন সময়? সেই সময় যখন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এক হানাহানির দিকে এগোচ্ছে। আর চার বছর পরই কলকাতা ক্ষতবিক্ষত হবে ৪৬-সালের রক্তস্নাত দাঙ্গায়। এহেন এক জটিল পরিবেশে, ধর্মের নামে বিভাজন রুখতে এক ধর্মগুরু দুই সম্প্রদায়কে এক জায়গায় আনার মরিয়া চেষ্টা করলেন। বাংলার প্রাচীন সত্যনারায়ণ পাঁচালীর আদলে লিখলেন নতুন পাঁচালী। সে পাঁচালীর ছত্রে ছত্রে সুফি, দরবেশদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। লিখলেন, "সুফি খাঁ পীরের পায়ে প্রচুর প্রণতি"। লিখলেন, "সাতশত আউলিয়া বন্দী করো জোরে/ ফণীন্দ্র নগেন্দ্র ইন্দ্র কাঁপে যার ডরে"।

আরও পড়ুন- ভয় দেখানো হিন্দুস্তানি পুরুষোত্তম নয়, বাংলার ছিল শূদ্রপ্রিয় এক রাম…

পাঁচালীর আরেক জায়গায় তিনি লিখছেন, "হরি বলো পীরের পিরিতে"। রক্তস্নাত চল্লিশের দশকে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় হানাহানি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি রুখতে এক ধর্মগুরুর এমন ভাবনা সমীহ জাগায় না কি? কৈবল্যধাম গড়ে তোলার পর্বে এক ধর্মচক্র বানান তিনি। সকল ধর্মের প্রতীককে নিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছেন এক সমন্বয়বাদী ধর্ম সাধনার পথ। এই আমার বাংলা। পীর, ফকির, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, সহজিয়া, উদার হিন্দু আউল বাউলের বাংলা। এই বিভেদহীন, আধিপত্যবাদ বিরোধী এক উদার ধর্মভাবনা আর অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় সাধন পদ্ধতির সেতুবন্ধন করে এক মানবিক ধর্ম ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন ঠাকুর। অদৃষ্টবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন, বলেছেন ধৈর্যই ধর্ম, বলেছেন ধৈর্য ধরেই প্রারব্ধ ভোগ ক্ষয় করতে হয়।

আজকের এই ছুটন্ত সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে রাখতেই হবে ধর্মের নামে বিভেদ করে যাননি রামঠাকুর। যে মঙ্গলকামনা সকল ধর্ম, সকল বর্গের মানুষকে একইভাবে, একই সুরে মঙ্গল প্রার্থনায় ব্রতী করে সেই সবার মঙ্গলের ভাবনাই ছড়িয়ে গেছেন তিনি। ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে বাটোয়ারা করেননি। তাই তো গভীর দর্শন, যোগ সাধনা নিজের জীবনে ধারণ করেও সাধারণ মানুষের ভাষায় সাধারণ লোকাচারকেই প্রচার করে গেছেন রামঠাকুর। এমন অসময়ে এমন রামেরই তো দরকার।

More Articles