নির্বাচনে জেতা আসলে ৩৬৫ দিনের কাজ! যেভাবে প্রমাণ করল মহারাষ্ট্র

Maharashtra Election Result 2024: প্রতি হাজার ভোটারের জন্য ১০জন কর্মীকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাদের কাজই ছিল বারবার ভোটারদের বাড়ি যাওয়া।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়-রিজওয়ানুরের মতো সরকার-বিরোধী ইস্যুর সুনামি না এলে, সরকার ফেলার বা গড়ার একটিই চাবিকাঠি রাজনৈতিক দলগুলির কাছে থাকে। আবার একটি রাজ্যের নির্বাচনী চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি রাজ্যের নির্বাচনকে দেখাও সঠিক নয়। ভারত যেমন বহু ভাষা-সংস্কৃতির দেশ, তার ভোট-সংস্কৃতিও ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন। তবে যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন, ওই সরকার-বিরোধী ইস্যুর সুনামি না এলে, ভোট জেতার একটিই চাবিকাঠি — সংগঠন ও জনসংযোগ।

মহারাষ্ট্রের নির্বাচন দেখিয়ে দিল, নির্বাচন পরিচালনা করতে শুধু মাস দুয়েক সময় দিলে হয় না। সারা বছর কাজ করতে হয় ভোটকে পাখির চোখ করে। অনেকেই এ রাজ্যের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো মহারাষ্ট্রের লড়কি বহিন যোজনাকে ভোট জেতার অন্যতম কারণ ভাবছেন। এটা ঠিকই যে মহিলাদের জন্য এই প্রকল্প মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে কাজ করেছে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা বলেনি।

মহারাষ্ট্রের বিজেপি নেতা ও বিদায়ী সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশ ও তাঁর দল বিভিন্নভাবে সংগঠন গোছানোর কাজটিই করে গিয়েছেন ভোটকে পাখির চোখ করে। ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী হতে হতেও কুর্সি হাতছাড়া হওয়ার পরেও হাল ছাড়েননি তিনি। কংগ্রেস, শরদ পাওয়ার ও উদ্ধব ঠাকরে একজোট হয়ে মহা বিকাশ আঘাড়ি সরকার গড়লেও, দেবেন্দ্র শরদের এনসিপি ও উদ্ধবের শিবসেনাকে ভেঙে দু'টুকরো করেছেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় হলেও, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও খুব সোজা পথে চলেনি কিন্তু তিনি মাথা ঠান্ডা রেখে এগিয়েছেন। বিজেপিও দল হিসেবে শরিক অজিত পাওয়ারের এনসিপি ও একনাথ শিণ্ডের শিবসেনাকে নিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচন যে খুব 'স্থানীয় নির্বাচন' হয়ে উঠছে, তা প্রার্থী মনোনয়ন পর্ব ও প্রচারের সময়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। যার জোর যে অঞ্চলে সেই জিতবে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। বিদ্রোহী ও নির্দল প্রার্থীদের প্রকোপে বেশ চাপে ছিলেন সব রাজনৈতিক দলের সরকারিভাবে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা।

আরও পড়ুন- কৌশলে বড়সড় বদল বিজেপির, তাতেই কি পদ্ম ফুটল মহারাষ্ট্রে?

ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে অন্তত ৪৫টি কেন্দ্রের ফলাফল হাজার পাঁচেক ভোটের ব্যবধানে নির্ধারিত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে একনাথ শিণ্ডের শিবসেনা। তারা ১৩টি আসন জিতেছে খুব কম ভোটের ব্যবধানে। আর ৪৫টির মধ্যে উদ্ধবের শিবসেনা ৭টি আসন জিতেছে। গতবার অবিভক্ত শিবসেনা এই ৪৫টির মধ্যে ১২টি জিতেছিল। অর্থাৎ এবারে শিবসেনা বিভক্ত না হলে, ২০টি না হোক আগের বারের থেকে বেশি আসন জিততে পারত। অন্যদিকে বিজেপি গতবার এই ৪৫টির মধ্যে ১১টি জিতেছিল। এবারে তারা জিতেছে ১০টি আসনে। কংগ্রেস গতবার ৭টি আসনে জিতলেও এবারে তার জিততে পেরেছে মাত্র ৩টি আসনে।

আবার এমন অন্তত ১৭টি আসন রয়েছে যেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীরা এত ভোট পেয়েছেন যে, সেখানে মূলত বিজেপি নেতৃত্বাধীন মহায়ুতি জোট লাভবান হয়েছে। বিজেপি বা শিবসেনার বিদ্রোহী নির্দল প্রার্থীরাও ভোট টেনে সুবিধা করে দিয়েছেন বিজেপি জোটের প্রার্থীদের।

যেমন, বেলাপুর আসনটিতে শিবসেনার বিদ্রোহী প্রার্থী ১৯,৬৪৬টি ভোট পেয়েছেন। আর সেখানে বিজেপি প্রার্থী মান্দা মাত্রে ৩৭৭টি ভোটের ব্যবধানে জিতে গেছেন। আবার ঘানসাওয়াঙ্গি আসনে বিজেপির বিদ্রোহী নির্দল প্রার্থী পেয়েছেন ২৩,৬৯৬ ভোট। সেখানে শিবসেনার প্রার্থী মহেন্দ্র দালভি ৩,৫৯৯ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন।

কংগ্রেস ও শরদ পাওয়ারের এনসিপি-র বিদ্রোহী নির্দল প্রার্থীরাও শিবসেনা বা বিজেপিকে জিতিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েকটি আসনে। যেমন, রামটেক আসনে কংগ্রেসের বিদ্রোহী প্রার্থী রাজেন্দ্র মুলক ৮১ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। কিন্তু সেখানে শিবসেনার প্রার্থী আশিস জয়সওয়াল ২৬,৫৫৫ ভোটের ব্যবধানে জিতে গেছেন। জিন্টুরেও একই কাণ্ড ঘটেছে। সেখানে কংগ্রেসের বিদ্রোহী প্রার্থী ৫৬ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন আর বিজেপির মেঘনা বোর্দিকর সাড়ে চার হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে গেছেন।

একমাত্র বিড় আসনটিতে বিজেপির বিদ্রোহী প্রার্থীর উপস্থিতিতে অজিত পাওয়ারের এনসিপি প্রার্থীকে হারিয়ে শরদের এনসিপি প্রার্থী যোগেশ ক্ষীরসাগর ৫ হাজারের সামান্য বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতে গেছেন।

এত পরিসংখ্যান দেওয়ার একটিই কারণ। যিনি স্থানীয় ভোটারদের নিজের দিকে টানতে পেরেছেন বা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে পেরেছেন, তিনিই বাজিমাত করেছেন মহারাষ্ট্র নির্বাচনে। এখানে না তো নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ বা যোগী আদিত্যনাথ, না তো দেবেন্দ্র ফড়নবীশ — কারও কোনও ম্যাজিক কাজ করেনি। স্থানীয় স্তরে অর্থবল, পেশিবল ও নিবিড় সংগঠনই একমাত্র কাজ করেছে।

সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে কাজ করেছে আবার আরএসএস-এর মাঠে নামা। লোকসভা নির্বাচনের ভোটের পরাজয়ের পর বিজেপি ও আরএসএস-এর নেতৃত্বের দূরত্ব প্রকট হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সংঘ পরিবার জানে নির্বাচনে জিতে সরকারে বিজেপির আসীন হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি দেবেন্দ্র ফড়নবীশ খোদ নাগপুরের বিধায়ক। সংঘের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও মোহন ভাগবতদের স্নেহভাজন। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লা মহল্লায় আরএসএস-এর কর্মীরা প্রচার চালিয়েছেন নিজেদের কায়দায়। অরাজনৈতিক সংগঠনের ছাতার তলায়।

ঠিক যেভাবে ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ও আরএসএস-এর সংগঠন কাজ করেছিল, ভিন রাজ্য থেকে কর্মীরা এসে কাজ করেছিলেন, ঠিক একই কায়দায় সংঘ পরিবার এবার মহারাষ্ট্রেও কাজ করেছে। প্রতি হাজার ভোটারের জন্য ১০জন কর্মীকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাদের কাজই ছিল বারবার ভোটারদের বাড়ি যাওয়া। কখনও 'ঘর ঘর তিরঙ্গা' বা কখনও 'হর ঘর মোদি' বা কখনও সদস্য সংগ্রহ অভিযানের নামে গেরুয়া শিবিরের কর্মীরা ভোটারদের কাছে গেছেন। নেতারা ভোটের জন্য যা করুক, নিচুতলায় এই কাজ প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে। অন্যদিকে, আরএসএস কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট দেওয়ার মাহাত্ম্য বুঝিয়েছেন। কোনও রাজনৈতিক দলের নাম নেননি কিন্তু সবাই বুঝেছে কাকে ভোট দিতে হবে। ভোটের কয়েক মাস আগেই সংবিধান নিয়ে যাত্রা করেছে সংঘ পরিবারের সংগঠন। পার্শ্ববর্তী গুজরাত, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক থেকে কর্মীরা এসে গ্রামে গ্রামে কাজ করেছেন।

মারাঠা এবং ওবিসি ভোটারদের নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিল না মহায়ুতি জোটের। দেবেন্দ্র ফড়নবীশ মুম্বইয়ে নিজের বাড়ির পিছনে শামিয়ানা খাটিয়ে ওবিসি নেতাদের ডেকেছেন, সাধারণ মানুষের কথা শুনেছেন। তাঁর অফিসের লোকেরা নোট নিয়েছেন বিভিন্ন ওবিসি গোষ্ঠীর লোকেদের। সেই মতো বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা কমিশন তৈরি করেছেন একনাথ শিণ্ডে-দেবেন্দ্র ফড়নবীশেরা। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই সেই সব ঘোষণা করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। মারাঠাদের শান্ত করার ভার মারাঠা নেতাদের হাতেই দিয়েছিলেন। যদিও জারাঙ্গে পাটিলের সরকার-বিরোধী আন্দোলন ও পরোক্ষে শরদ পাওয়ারের প্রতি সমর্থন নিয়ে চিন্তায় ছিলেন মহায়ুতি সরকারের নেতারা কিন্তু দিনের শেষে মারাঠাওয়াড়ার বেশিরভাগ আসনই গেছে মহায়ুতির পক্ষে। ৪৬টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসনই তারা জিতেছে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের ৫৮টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসনে জয়ী হয়েছেন মহায়ুতির প্রার্থীরা।

এছাড়া লড়কি বহিন যোজনার সুফলও ঘরে তুলেছেন মহায়ুতির প্রার্থীরা। মুম্বইয়ের বাইরেও যে মহারাষ্ট্র রয়েছে, সেখানে মহিলাদের যেমন কাজ চাই, তেমন এই হাত খরচের টাকাও তাঁদের কাজে এসেছে। এর বিপরীতে মহা বিকাশ আঘাড়ি জোট বিশ্বাসযোগ্য আরও ভালো কোনও প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি।

মহায়ুতির এত কাণ্ডের কথা বলার একটিই কারণ, এই সংগঠন গোছানোর কাজে খামতি থাকলেই যে বিরোধীরা যে কোনও রাজ্যে পিছিয়ে পড়বে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কংগ্রেস মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করেছিল, তার অন্যতম কারণ যেমন ছিল শরদ পাওয়ার ও উদ্ধবের সঙ্গে জোট, তেমনই রাহুল গান্ধির 'ভারত জোড় যাত্রা' কংগ্রেসের সংগঠন ও জনসংযোগকে অনেক চাঙ্গা করে দিয়েছিল। সেই গতি বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি তারা।

আরও পড়ুন- এক হ্যায় তো সেফ হ্যায় মন্ত্রেই ম্যাজিক? কীভাবে মহারাষ্ট্র দখল করল বিজেপি?

শুধু রাহুল গান্ধির উপর ভরসা করে যে রাজ্যের নির্বাচন জেতা যায় না, স্থানীয় সংগঠক নেতার দরকার হয়, তা দেখিয়েছে কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানা। কর্ণাটকের ডিকে শিবকুমার ও সিদ্ধারামাইয়া বা তেলেঙ্গানার রেবন্ত রেড্ডিরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থনে সরকার দখল করেছেন। মহারাষ্ট্রে নানা পাটোলে আগ্রাসী মনোভাব দেখালেও অনেকাংশেই পাওয়ার ও ঠাকরেদের চটিয়েছেন বা তাদের সমর্থনের ভরসায় থেকেছেন।

লোকসভা নির্বাচনের সময় শরদ পাওয়ার ও উদ্ধব ঠাকরের প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগ কাজ করলেও, বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা হতে হতে তা অনেক স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। শরদ পাওয়ার খুঁজে খুঁজে স্থানীয় শক্তিশালী নেতাদের প্রার্থী করলেও, উদ্ধব তা পেরে ওঠেননি। পুরো সংগঠনই যে প্রায় একনাথ শিণ্ডের সঙ্গে চলে গেছে, তা তিনিও বুঝেছেন বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু হতে। শিরুর কেন্দ্রে উদ্ধবের পুণে জেলার বড় নেতা অজিত পাওয়ারের হাত ধরে প্রার্থী হয়ে গেছেন। জিতেছেন শরদের দলের প্রার্থীকে হারিয়ে। আবার শরদ পাওয়ার খুঁজে খুঁজে প্রাক্তন কংগ্রেস ও বিজেপি নেতা বাপু পাথারেকে বড়গাঁও শেরি থেকে প্রার্থী করেছেন। অজিতের এনসিপি প্রার্থী সুনীল তিংরের উপর এমনিতেই ক্ষোভ ছিল সাধারণ মানুষের। তিনি পুণের নাবালক চালিত পোর্সে গাড়িতে চাপা পড়ে দু'জনের মৃত্যুর ঘটনায় নাবালককে বাঁচানোর চেষ্টায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় বিজেপি নেতা-কর্মীরাও চাননি তিনি প্রার্থী হন। এই সুযোগে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন শরদের প্রার্থী কিন্তু এই সমীকরণ সব জায়গায় কাজ করেনি।

সার্বিক প্রভাব ফেলার মতো ইস্যু এবারে মহারাষ্ট্রে ছিল না। 'বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে'-র মতো স্লোগান মুসলমান অধ্যুষিত আসনে প্রভাব ফেলেছে বটে, তবে তা সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে নয়। আবার 'এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়' হিন্দুদের মধ্যে যতটা না প্রভাব ফেলেছে, তার থেকে বেশি ওবিসি ভোটাদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে বলেই ফলাফলে দেখা যাচ্ছে। রাহুল গান্ধির জাতিগণনার দাবিকে উল্টে দিয়েছে এই স্লোগান। তপশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত ২৯টি আসনের মধ্যে ১৯টি আসনই জিতেছে মহায়ুতি জোট। আর তপশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ২৫টি আসনের মধ্যে ২২টিতেই জিতেছে মহায়ুতি। সুতরাং ইস্যু না থাকলে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প, তৃণমূল স্তরে নিবিড় সংগঠন, সারা বছর জনসংযোগ, অর্থবল, পেশিবলই যে নির্বাচন জিততে সাহায্য করে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

More Articles