স্পষ্টবাদী, স্বাধীনচেতা বলেই মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কারের ছক সাজাল বিজেপি?
Mahua Moitra Expelled : ভারতীয় রাজনৈতিক জগত এই রকম একজন মহিলাকে বহিষ্কার করল কেন? তাহলে কি ভারতীয় রাজনীতিতে মহুয়ার মতো সোজাসাপ্টা কথা বলা মহিলার স্থান নেই?
মহুয়া মৈত্রকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হলো। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার সামনে এথিক্স কমিটি বা সংসদের নীতি নির্ধারক কমিটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শাস্তি যে বহিষ্কার ছাড়া অন্য কিছু হবে না, তা যে কোনও রাজনীতি সচেতন মানুষই বুঝতে পেরেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্ত যে পূর্ব নির্ধারিত তা-ও অনেকে বুঝতে পারছেন। এই প্রতিবেদন পেশ হওয়ার আগেই যখন মহুয়া মৈত্র সংসদে প্রবেশ করেন, তখন সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করছিলেন, তাঁর কেমন লাগছে? তাঁর স্পষ্ট উত্তর ছিল, "বাংলায় কাজী নজরুলের একটা কবিতা আছে, ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি করো শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’।" মহুয়া লড়লেন এবং বহিষ্কৃত হলেন। এথিক্স কমিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগে সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কার করা হবে, তারপরে তদন্ত হবে তিনি টাকা নিয়ে, অন্য কারও প্রশ্ন সংসদে তুলেছেন কিনা। তারপর যদি দেখা যায়, তিনি টাকা নেননি, তখন কী করবে এই এথিক্স কমিটি এবং সংসদ? তাঁর শাস্তি ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে?
আজ না হলে কাল, এই বহিষ্কার হতোই কারণ মহুয়া মৈত্র মহিলাদের সম্পর্কে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে অবজ্ঞা করেছেন। তিনি কারও মা, কারও দিদি বা কারও স্ত্রী হয়ে রাজনীতিতে জায়গা করার থেকেও নিজের যোগ্যতায় জায়গা করতে চেয়েছেন। তা বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের মতো মনুবাদী দল মেনে নেবেই বা কেন? অনেকেই বলতে পারেন, বিজেপিতেও তো মহিলা সাংসদ বা বিধায়ক আছেন, তাহলে মহুয়া মৈত্রতে সমস্যা কেন? ভারতীয় রাজনীতি তো ইন্দিরা গান্ধি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুষমা স্বরাজ কিংবা স্মৃতি ইরানিদের দেখেছে, তাহলে মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে সমস্যা কেন? আসলে আপত্তি থাকার অনেক কারণই আছে।
ভারতীয় রাজনীতিতে মহুয়া মৈত্রের মতো মহিলারা আজও ব্রাত্যই। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পার হয়ে গেল, 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ পালন হয়ে গেল কিন্তু মহিলাদের দেখার চোখটি বদলাল না। প্রধানমন্ত্রী মহিলা সংরক্ষণ বিল পাস করিয়ে দিলেন, তা নিয়ে দেশ জুড়ে প্রচার করল শাসক দল (যদিও কবে থেকে তা লাগু হবে, কেউ জানে না) কিন্তু তাতেও মহিলাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি না তো রাজনীতির জগতে বদলেছে, না সমাজে। এখনও ভারতীয় সমাজে, একজন স্বাধীন মতামত রাখা মহিলা, যিনি বিবাহ বিচ্ছিন্না, তাঁর কোনও পুরুষ সঙ্গী থাকতে নেই। এখনো একজন ‘একলা’ মহিলার রাত করে বাড়ি ফিরতে নেই, কোনও পুরুষের সঙ্গে রাতে টেলিফোনে কথোপকথন করতে নেই, সর্বসমক্ষে ধূমপান করতে নেই, মদ্যপান তো নৈব নৈব চ। যখন এই সমস্ত কিছুই কোনও একজন মহিলার মধ্যে দেখা যায়, তাঁকে হেয় করতে, তাঁর সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভারতীয় পুরুষদের বড় অংশই যে অগ্রণী ভূমিকা নেয়, তা মহুয়া মৈত্রের ঘটনায় ফের প্রমাণিত। ইন্দিরা গান্ধি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি নিজেকে তাঁর মন্ত্রিসভার একমাত্র ‘পুরুষ’ বলতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ‘দিদি’ সুলভ ভাব আগেও ছিল এখনও আছে। এমনকী প্রধানমন্ত্রী মোদিও তাঁকে 'দিদি' বলেই সম্বোধন করেন। জয়ললিতার মধ্যেও ‘মা’ ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিজেপির মহিলা সাংসদ কিংবা বিধায়কদের মধ্যেও ‘ভারতীয় নারী’ ধারণাটি প্রবল। তা বহিরঙ্গে হোক বা অন্তরঙ্গে। কোনওদিনই তা মহুয়া মৈত্রের মধ্যে নেই। ভারতীয় সমাজ মহুয়ার এই তথাকথিত 'ঔদ্ধত্য', 'বেপরোয়াভাব' মেনে নেবে কেন?
আরও পড়ুন- মহুয়া মৈত্রের ‘চরিত্র’ নিয়েই চর্চা স্রেফ! কোথায় গেল আদানির দুর্নীতির প্রশ্নগুলি?
ভারতীয় রাজনৈতিক জগত এই রকম একজন মহিলাকে বহিষ্কার করল কেন? তাহলে কি ভারতীয় রাজনীতিতে মহুয়ার মতো সোজাসাপ্টা কথা বলা মহিলার স্থান নেই? না কি এর পিছনে কর্পোরেট জগতের কিছু নিজস্ব হিসেবনিকেশ আছে? মহুয়া মৈত্র প্রথম যেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে ক্লাসিকাল ফ্যাসিবাদের শর্তাবলীর সঙ্গে আজকের নরেন্দ্র মোদির ভারতবর্ষের তুলনা করেছিলেন, সেদিনই ভারতের শাসক শ্রেণি বুঝতে পেরেছিল, এই মহিলার মধ্যে যে বাগ্মীতা আছে, যে যুক্তিবোধ আছে, তা নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে বাধ্য। সেদিনই মহুয়ার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। বলেছিল, ওই বক্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার, মার্টিন লংম্যানের ২০১৭ সালের, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিরোধী একটি প্রবন্ধ থেকে হুবহু টুকে দেওয়া। সারা দেশের নরেন্দ্র মোদি সমর্থক এবং বেশ কিছু গণমাধ্যমের সঞ্চালকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহুয়ার বিরুদ্ধে। পরে খোদ মার্টিন লংম্যান, টুইট করে জানান মহুয়া মৈত্র তাঁর লেখা থেকে চুরি করেননি। তখন বিতর্ক থামে ঠিকই কিন্তু সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, মহুয়ার রাজনৈতিক পথচলা খুব মসৃণ হবে না। দ্বিতীয়ত, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক ভারতীয় শিল্পপতির অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের কথা ফাঁস করেছেন। সেই বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে দেশের রেল থেকে শুরু করে বিমানবন্দর ওই শিল্পপতি কিনে নিচ্ছেন, সেই অভিযোগও বারবার সর্বসমক্ষে তুলে এনেছেন।
সামনেই লোকসভা নির্বাচন। যে কয়েকটা দিন সংসদ বসবে, সেই কয়েকদিনে যদি মহুয়া যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে আবারও মোদি এবং তাঁর সেই শিল্পপতি বন্ধু আদানির কথা বলেন, তাহলে দেশবাসীর কাছে শাসকদলের ভাবমূর্তি খানি আঘাত তো পাবেই। বিজেপি তা জানে। সুতরাং এখনই যদি মহুয়াকে বহিষ্কার না করা হতো, তাহলে মহুয়া মৈত্রেকে অনুকরণ করে আরও যদি কেউ উঠে এসে এই সব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করত, তাহলে সমস্যা আরও গুরুতরই হতে পারত।
বিজেপি খুব ভালো করে জানে, কোন বিতর্ক কোন সময়ে কোন দিকে চালনা করতে হয়। তাই মহুয়া মৈত্রের বক্তব্য এবং সামাজিকভাবে তাঁর উপস্থিতিকে এই মুহূর্তে সরানো খুব জরুরি ছিল। ভারতীয় নির্বাচকদের মধ্যে মহুয়া মৈত্রের কথার প্রভাব যাতে না পড়ে তাই বিতর্কের বর্শামুখ ঘোরানো জরুরি ছিল। সেই কারণেই প্রথমে রাহুল গান্ধিকেও সংসদ থেকে সরানোর চেষ্টা হয়। সেই কাজে প্রথমে সফল হলেও পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে, আবার তাঁর সাংসদ পদ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। মহুয়া মৈত্রের বহিষ্কারের প্রস্তাবের মধ্যেও বেশ কিছু ফাঁকফোকর আছে। বিজেপি জানে, একজন মহিলা সাংসদের বিরুদ্ধে ঠিক কোন কোন অভিযোগ তুলতে বিষয়টিকে বাজারে 'উপভোগ্য' করানো যাবে। একজন সাংসদ, মহুয়া মৈত্র এক শিল্পপতির থেকে টাকা নিয়ে, অন্য শিল্পপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর বদনাম করছেন- বিষয়টি সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সন্দেহ জাগানো যায়।
আরও পড়ুন- লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত মহুয়া মৈত্র! কেন একটি কথাও বলতে দেওয়া হলো না সাংসদকে?
মহুয়ার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে, সামাজিকভাবে তাঁর ও তাঁর পদমর্যাদার সম্মানহানি করা যে সম্ভব তা শাসক দলের কুখ্যাত আইটি সেল জানে। যে ছবিগুলো ছড়ানো হয়েছে, সেগুলো মহুয়া মৈত্রের প্রাক্তন এক বন্ধুর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকেই স্বেচ্ছায় নেওয়া বলেই জানা গেছে। আসলে এসবই একজন স্পষ্টবাদী মহিলার, প্রশ্ন করা মহিলাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি। এর সঙ্গে আর্থিক অসঙ্গতিকে যুক্ত করে দিয়ে বড় চাল খেলেছে বিজেপি। বিজেপি চেয়েছে, 'টাকার বদলে প্রশ্ন’ ইস্যু নিয়ে কথা বলুক মানুষ, মানুষ মহুয়া মৈত্রের ব্যক্তিগত কেচ্ছা নিয়ে আলোচনা করুক, যাতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা প্রশ্ন, আদানি-মোদি সম্পর্ককে অস্বস্তিতে ফেলা সব বন্ধ করা যায়। কী প্রশ্ন করছেন মহুয়া, তার থেকেও বড় হয়ে ওঠে তিনি কোন পদ্ধতিতে প্রশ্ন করেছেন সেই বিতর্ক।
বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবে, যিনি মূলত এই আক্রমণ শানাচ্ছেন, তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন মহুয়া। যার উত্তর দিতে পারেননি তিনি। মহিলার 'আস্পর্ধা' রুখতেই কি তবে এত সাজ সাজ রব? বহিষ্কারের পরে মহুয়া কী করবেন, তা তিনিই ঠিক করবেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যাবেন কি না, তা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তাঁর নিজের দলও কতটা তাঁকে সাহায্য করবে, তা সময় বলবে। তবে, একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, মহুয়ার মতো স্বাধীনচেতা মহিলা আসলে পিতৃতন্ত্রেরই শিকার। এই জায়গায় এক পুরুষ থাকলেই অভিযোগের ধারা ঠিক অন্য হয়ে যেত। কার সঙ্গে কার কী ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কার কেমন বেশভূষা তা ছবিতেই আসত না! স্পষ্টবাদীদের অবস্থা দেশে শোচনীয়। আর সেই স্পষ্টবাদী যদি একজন মহিলা হন, তাহলে ফল কী, মহুয়ার বহিষ্কারই তার প্রমাণ।